আধুনিক যুগ ও উপহার নামী যৌতুক প্রথা! 

  • ডা: রীপা চক্রবর্তী
  • ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৮

দৃশ্যপট এক :

রিজিয়া ( ছদ্মনাম ) ও রাজিব ( ছদ্মনাম ) এর বিয়ে পারিবারিকভাবেই নির্ধারিত হয়েছে । দুজনেই সম্ভ্রান্ত পরিবারের ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত । দেনা-পাওনা বিষয়ক কোনো কথা ওঠানো হয়নি । আত্মীয় - পরিজন সবাই খুশি হয়েই অংশগ্রহণ করেছেনও নব - দম্পতিকে বহুবিধ উপহার সমেত তাদের মঙ্গলময় সুখী দাম্পত্যের কামনা করছেন । বিয়ের পর রিজিয়া ও রাজিবকে রিজিয়া এর পরিবার থেকে উপহার হিসেবে নতুন ফ্লাট, নতুন গাড়ি এমনকি তাদের ব্যবহার্য সাংসারিক সমস্ত জিনিসপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয় । হবেই বা নয় কোনো !! রিজিয়া যে একমাত্র সন্তান । তাই সন্তানের মঙ্গলার্থে বাবা মা এর প্রধান কর্তব্যই হলো আদরের কন্যা ও জামাতাকে সম্মান দেয়া সাথে যথাযথ ভাবে তাদের সুখ ও সমৃদ্ধির খেয়াল রাখা । রিজিয়া ও রাজিব দুজনেই শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও পরিবারের উপরে আজও এভাবে নির্ভরশীল কিন্তু তারা সুখেই রয়েছে সার্বিকভাবে । আধুনিক যুগ ও তার প্রভাবই বটে.!!!

লেখিকা

দৃশ্যপট দুই :

সালমা ( ছদ্মনাম ) ও শাহীন ( ছদ্মনাম ) বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই খুব ভালো বন্ধু ও একে অপরকে মন দেয়া নেয়া শেষে তাদের সম্পর্ককে বিয়েতে রূপান্তরিত করতে আগ্রহী । কিন্তু বিধি বাম । দুজনেরই কচি বয়স কিনা । এখনো শাহীন প্রতিষ্ঠিতও হয়নি ঠিক মতো । উপরন্তু সালমা যে শ্যামবর্ণ..!! 'ছেলেটাকে আমার নিশ্চয়ই পটিয়েছে, আজকাল ছলাকলায় কি না হয় মেয়েদের !!, নাহলে কেন যাবে আমার অমন হীরার টুকরো ছেলেটা এভাবে রসাতলে ?' কি উপায় তাহলে ? শাহীনের কথায় ' ভেবে দেখো, আমাদের ভবিষ্যতের ভালোর জন্যেই বলছি, তোমার ও তো সম্মান আছে | বাবা মা কে তুমি এখন খুশি করো, দেখবে পরে তুমি ছাড়া তারা আর কিছুই বুঝবেনা । আর আমার তো পাশে দাঁড়াবার মতো কাউকে চাই । অগত্যা, সালমার পরিবার যৌতুক এর ঘোর বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও শ্যামবর্ণ মেয়েটা উদ্ধার পাবে, সুখী হবে এই আশায় মোটা অংকের উপহার প্রদান করলেন শাহীন ও তার পরিবার কে। তারা দুজনে সুখী হয়েছে বটে তবে শান্তিতে কেউ নেই । শশুর বাড়ির উপহার পৌঁছতে একটু বিলম্ব হলেই সালমা কে অকথ্য ভাষা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয় । কিন্তু সংসার এর স্বার্থে হেসে খেলে দিন পার করে দেয়ার অভিনয় সালমা ভালোই রপ্ত করে উঠেছে ।

দৃশ্যপট তিন :

রোকেয়া ( ছদ্মনাম ) দেখতে কালো ও মোটেই ভালো নয়, দিনমজুর পিতা ও গৃহকর্মী মায়ের কন্যা | অল্প বয়স হলেও মেয়ের বিয়ে তো দিতেই হবে, নাহলে কিভাবে উদ্ধার পাবে ! ঘটক মামা খবর দিলো "ভালো ছেলে পাওয়া গেছে | আকাশের চাঁদ পাইলা মিয়া । ছেলে বিদেশে ছিল । এখন নামি কোম্পানির গাড়ি চালায় । গ্রামে বাড়ি-ঘর জায়গা জমি খাসা । আর দেরি কইরোনা । এমন সম্বন্ধ আর পাইবানা । 'দেন পাওনা ? ... বেশি কিছু না , মেয়েরে সাজে দিবা , আর জামাই কে স্বর্ণের আংটি , চেন, একখান মোটর সাইকেল আর নগদ দুই লক্ষ টাকা দিবা | ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, ব্যবসা করবো , মেয়ে তোমার সুখী হইবো |'  গরিব হতদরিদ্র পিতা মাতা অনেক চেষ্টায় ধার-কর্জ করেও সব দেন পাওনা মিটাতে পারলেন না । হাতে পায়ে ধরে কোনোক্রমে বিয়েটা দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু একমাসের মধ্যে সব না দিলে মেয়েকে তারা ফেরত পাঠিয়ে দিবেন । এক মাস পর, মেয়ে বাপের বাড়ি ফিরে আসলো কিন্তু লাশ হয়ে, সাথে আরো দুটি জীবনের ইতি ঘটলো!

তিনটি ঘটনায় বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থা কে ফুটিয়ে তোলার একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করা হয়েছে। তিনটি ঘটনাই বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার আধারে লিখিত । যুগ আধুনিক হয়েছে বটে, কিন্তু আমরা কি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে অগ্রবর্তী হয়েছি ??? না পশ্চাৎবর্তী পদক্ষেপ করছি বা বাধ্য হচ্ছি ??? আসলে শিক্ষা কি বলে ? মূল্যবোধ কি বলে ? আমিও নিজেকে হারিয়ে ফেলছি আজ বাস্তবতার এই প্রতিচ্ছবি অনুধাবনে বার্থ হয়ে। ‘' একেই কি বলে সভ্যতা নাকি বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো ???'’ |

Leave a Comment