দেশটা একটা মধ্যবিত্ত পরিবার হয়ে উঠুক : রাজীব হাসান

  • তানজিলা খান
  • ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৮

রাজীব হাসান একাধারে একজন লেখক এবং সাংবাদিক। কিছুদিন আরজে হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। বর্তমানে দেশের স্বনামধন্য এক পত্রিকার ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন। গতবছর প্রকাশিত তার প্রথম উপন্যাস ‘হরিপদ ও গেলিয়েন’-এর জন্য কিছুদিন আগেই কালি ও কলম পুরুষ্কার পেয়েছেন এই তরুণ লেখক। এবার একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তা লেখা "আমাদের শহরে বাঘ এসেছিল" বইটি। ওমেন্স কর্নারে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নানা জীবনের নানা গল্প করেছেন।  সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন তানজিলা খান। 

ওমেন্সকর্নার : প্রথমেই জানতে ইচ্ছে করে রাজীব হাসান কি জাদু জানে? রাজীব হাসানকে এতো মানুষ ভালোবাসে কেন? 

রাজীব হাসান: আমার জীবনের যে গল্প, এটা আসলে আরও অনেক মানুষের গল্পের মতো। প্রায় সবার জীবনে এমন অনেক লড়াই করার গল্প আছে। ফলে আমার গল্পটাকে অনেকে নিজের গল্প ভাবেন। আমার সাফল্যকে তারা নিজেদের সাফল্য মনে করেন। আমি যখন কালি ও কলম পুরস্কার পেয়েছি, এটা নিয়ে এমন অনেকের উচ্ছ্বাস আমার চেয়ে বেশি ছিল। অনেক তরুণ আছে যারা বিশ্বাস করে, রাজীব হাসান পারলে আমি কেন পারবো না! আর আমিও জানি, আমি আজ যতটুকু পথ পাড়ি দিয়েছি, এই সাধারণ মানুষগুলোর ভালোবাসা আর প্রার্থনায়। এদের কথা আমি কখনো ভুলি না। ভুলবও না। আমি তারকা নই, কোনো দিন হবোও না। মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক। এ কারণেই হয়তো মানুষ আমাকে ভালোবাসে। যদিও আমরা কেন কাকে ভালোবাসি এর সহজ ব্যাখ্যা হয় না। হয় না বলেই হয়তো ভালোবাসি।

ওমেন্সকর্নার : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, আরজে; কোন উপাধি আপনার সবচেয়ে পছন্দের? 

রাজীব হাসান: লেখক পরিচয়টা আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমি আমার শৈশব থেকে শুধু লেখকই হতে চেয়েছি। কেন হতে চেয়েছি এই গল্প এতবার বলা হয়েছে আর বলতে চাই না। শুধু এতটুকু বলি, কোনো লেখা তৃপ্তি নিয়ে লিখতে বসলে আমি নাকে সাদা ভাত আর মাংস ভুনার ঘ্রাণ পাই। এটাই আমাকে লেখক হিসেবে তাড়িত করে। জানি না লেখক হয়ে উঠতে পারব কি না।

ওমেন্সকর্নার : কোনো বই বা কোনো লেখকের গল্প পড়ে কি মনে হয়েছিল আপনি ওরকম একটি বই লিখবেন বা তাঁর মতো হতে চান ?

রাজীব হাসান: ​​​​​​​ আগে তো শুধু পড়তাম, বইপোকা ছিলাম খুব। আমি ঈদের দিনও পড়ছি এমন একটা গল্প আমাদের পরিবারে প্রচলিত আছে, সত্যি মিথ্যা জানি না। তখন অতশত ভাবিনি। একটু বড় হওয়ার পর যেকোনো ফিকশন, বা ফিচার পড়ার সময় পেছনের কারিগরি ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করতাম। কোনো লেখা এখনো ভালো লাগলে বোঝার চেষ্টা করি, কেন ভালো লাগল। তবে ওই বইটার মতোই বা ওই গল্পটার মতোই লিখব এমনটা কখনো ভাবিনি। হ্যাঁ, প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপোতা আবিষ্কার পড়ে চমকে গিয়েছিলাম। যে ঘোরটা এখনো আছে। এখনো মনে হয়, এই রকম একটা গল্প আমিও লিখব একদিন!

ওমেন্সকর্নার : বিভিন্ন সময়ে আপনি বলেছেন আপনার শৈশব কেটেছে অনেক কষ্ট, অভাব অনটনের মধ্যে। আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখি যে সংসারে আর্থিক সংকট থাকলে ছেলে মেয়েরা এমন কিছু করতে চায়, যেখান থেকে কিছু অর্থ উপার্জন করা যায়। অথচ এ ক্ষেত্রে আপনি ব্যতিক্রম। অসচ্ছল পরিবারের সন্তান হয়েও আপনি নিজেকে কিছু সৃষ্টিশীল কাজে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন; যেমন লেখালেখি, সাহিত্য সংগঠন, গ্রুপ থিয়েটার ইত্যাদি। এই যে স্রোতের বিপরীতে চলার সাহস, সেটা কোথা থেকে পেয়েছেন? 

রাজীব হাসান​​​​​​​:  আমাদের নানা বা দাদার বংশে কেউ কখনো কিছু লেখেনি। আব্বা শৈশবে অনেক সৃষ্টিশীল ছিলেন বলে দাদির কাছে শুনেছি। আব্বার মধ্যে যে একটা সৃষ্টিশীল শিশুমন আছে, সেটা নিজেও বুঝেছি। তবে সংগঠন করাটার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিল আমার বড় বোন ও ভাই। ওরা দুজনই গার্লস গাইড ও স্কাউট করতো। মনে আছে, মায়ের সঙ্গে একবার বোনের স্কুলে গার্লস গাইডের একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। মেয়েদের স্কুল, সেখানে দেখি 'নাও ছাইড়া দে পাল উড়াইয়া দে'র সঙ্গে বেশ কজন গোঁফওলা ছেলে নাচছে। পরে যখন জানলাম এই গোঁফওলাদের মধ্যে আমার বোনও ছিল, খুবই চমকে গিয়েছিলাম। এ তো জাদু! আবার বড় ভাইয়ের স্কাউটের ক্যাম্প জীবন দেখতে আম্মার সঙ্গে গিয়েছিলাম। তাঁবুর মধ্যে তিন ছিল ওরা। আমাদের দুপুরে মাছ-ভাত খাইয়েছিল। ফলে সংগঠন ব্যাপারটা আমাকে আমার শৈশবে আকৃষ্ট করে। 

বন্ধু আদনান নিজে ১০ টাকা চাঁদা দিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য বানিয়েছিল, এটাও মনে আছে। আমাদের পরিবারে অভাব ছিল, কিন্তু কোনো কিছু করতে চাওয়ার বাধা ছিল না। নিদারুণ অভাব, পাওনাদারদের হম্বিতম্বি, বাড়িওলার বকুনি এসব একটা শিশুর জন্য খুবই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ছিল। সংগঠন আমার জন্য ছিল সেই অভিজ্ঞতা থেকে পালিয়ে বাঁচাও। ফলে আমি সংগঠন করেছি, এটা স্রোতের বিপরীতে সাঁতরানো এসব বাহবা না নেওয়াই ভালো। সংগঠনই আমাকে তৈরি করেছে। আমি সংগঠনকে কখনো কিছু দিতে পারিনি। কদিন আগে পরিবর্তন চাই বলে একটা সংগঠন আমাকে ওদের ক্যাম্পে ডেকেছিল। সেখানে আমি একটা কথা বলেছিলাম। আপনারা সংগঠন করবেন। সংগঠনটা সফল নাও হতে পারে। সংগঠনটা হয়তো একদিন ব্যর্থ হবে। কিন্তু যে মানুষটা মন দিয়ে কোনো ভালো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়, সে কখনো ব্যর্থ হয় না।

ওমেন্সকর্নার : আপনি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ছাত্র ছিলেন। আপনার ক্যাম্পাস জীবন কেমন ছিল? ক্যাম্পাস জীবনের কোনো স্মরণীয় ঘটনা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করবেন? 

রাজীব হাসান​​​​​​​: ক্যাম্পাস জীবন উপভোগ করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমি দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই চাকরি শুরু করে দেই। এখন খুব আফসোস হয়। টিএসসি বা ক্যাম্পাসের আড্ডায় যখন একদল তারুণ্যকে হইচই করতে দেখি। আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই আসলে গেছে। কিছুই থাকেনি বাকি। চাইলেও তো আর ঘড়ির কাঁটা পেছনে ঘোরাতে পারব না। ফলে ক্যাম্পাস নিয়ে আমার স্মরণীয় কোনো স্মৃতি নেই। হ্যাঁ, হল জীবনে আমি বন্ধু হিসেবে ফয়সাল আবদুল্লাহকে পেয়েছি, যিনি ওই সময়েই অবিশ্বাস্য সব গল্প ও উপন্যাস লিখতেন বা ভাবতেন। কত রাত আমরা দুজন কাটিয়েছি শুধু গল্পের গল্প করে। লেখা নিয়ে দুজনের প্যাশন শেয়ার করে। ফয়সাল ভাই পরে ধ্রুব নীল নামে লিখে বেশ জনপ্রিয় হয়েছেন। এ ছাড়া হল জীবনে আমার অসংখ্য খুচরো কিন্তু আজীবন মনে থাকবে এমন স্মৃতি আছে। সেগুলো আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, বাকিদের কাছে হয়তো নয়। এগুলো কখনো কখনো আমার লেখায় এসেছে, হয়তো আসবে। তবে হল জীবনের শেষটা খুব বাজে ছিল। আমি তখনকার ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের সাধারণ ছাত্রদের ওপর করা মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে হল ছেড়েছিলাম। যেহেতু আমি সাহসী মানুষ নই, প্রতিবাদ করতে পারিনি। আবার ওই জীবনটা মেনেও নিতে পারছিলাম না। এ কারণে হলেও আসলে তিন বছরের মতো ছিলাম, অনেকে যেখানে সাত-আট বছরও থাকে। হল জীবনটাও এখন মিস করি খুব। 

ওমেন্সকর্নার : লোকপ্রশাসনে পড়াশোনা করে ক্রীড়া সাংবাদিক হয়ে ওঠার পেছনের গল্প কি? ক্রীড়া সাংবাদিক রাজীব হাসান খেলোয়াড় হিসেবে কেমন? আপনার প্রিয় ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব কে? 

রাজীব হাসান​​​​​​​: ​​​​​​​​​​​​​​ আমি আসলে লেখালেখি, পত্রিকার এসবের সঙ্গে খুব ছোটবেলায় জড়িয়ে গিয়েছিলাম। আমি জানতাম আমি সাংবাদিক বা লেখকই হতে চাই। অনেক আগেই আমি আমার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করেছিলাম। আমি সৌভাগ্যবান, লক্ষ্যটা পূরণ করতে পেরেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই আমি প্রথম আলোর প্রদায়ক প্রতিবেদক হিসেবে কাজ শুরু করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় সাংবাদিকতার বদলে লোকপ্রশাসন বেছে নিয়েছিলাম এ কারণে, প্রথম আলোতে কাজ করতে করতে বেসিক সাংবাদিকতা এমনিতেই শিখতে পারব বলে। ভাবলাম অন্য আরেকটা বিষয় পড়ে রাখি। নামটাও শুনতে ভালো লাগত, লোক প্রশাসন! আব্বা ভাবতেন এখান থেকে পাস করে আমি ম্যাজিস্ট্রেট হব। কিন্তু আমি পাস করার আগেই পুরোদস্তুর পেশাদার সাংবাদিক হয়ে গেছি।

ওমেন্সকর্নার : জীবনের প্রথম উপন্যাসই আপনাকে দু হাত ভরে দিয়েছে। অগণিত পাঠকের ভালোবাসা পেয়েছেন সঙ্গে "কালি ও কলম" এর মতো এত সম্মানজনক পুরস্কার। কতটা প্রত্যাশিত? 

রাজীব হাসান​​​​​​​: ​​​​​​​ হরিপদ ও গেলিয়েন থেকে পাওয়া আমার প্রথম পুরস্কার পাঠকের ভালোবাসা। আমি পত্রিকায় অনেক দিন থেকেই লেখালেখি করি, এফএম রেডিওতে কিছুদিন উপস্থাপনা করেছি একটা বেশ জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। কিন্তু ফিকশন লেখক হিসেবে সেভাবে কেউ আমাকে চিনত না। হরিপদ ও গেলিয়েন কীভাবে পাঠক গ্রহণ করবে এ নিয়ে আমার ভীষণ দুশ্চিন্তা ছিল। সেই বইটার চারটা সংস্করণ হয়েছে, পঞ্চম সংস্করণ দ্রুত চলে আসবে বলেই জানি। সবাই আমার বই পড়বে, আমি পুরস্কার পাব এসব প্রত্যাশা করিনি বললে মিথ্যা বলা হবে। কিন্তু সে তো আমরা কত কিছুই প্রত্যাশা করি, কোনো দিন সত্যি হবে না জেনেও করি। আমাদের প্রত্যাশা বেশির ভাগ সময় মেলে না বলে কষ্ট লাগে। তবে সত্যিটা হলো, জীবন কখনো কখনো আপনাকে এমন দুহাত ভরে দেবে, সব উপচে যাবে। আমরা অনেকে সেই মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা না করেই হতাশ হয়ে পড়ি, হাল ছেড়ে দিই।

ওমেন্সকর্নার : "কালি ও কলম" পুরস্কার হাতে পেয়ে প্রথমেই কার কথা মনে পড়েছে? 

রাজীব হাসান​​​​​​​: আমার মায়ের কথা মনে পড়েছে। আমার ক্ষীণ একটা আশা ছিল পুরস্কারটা যদি পাই আম্মাকে দর্শকসারিতে রেখে পুরস্কারটা নেব। কিন্তু এই পুরস্কারটা নিয়ে অনেকের মধ্যে অনেক কৌতূহল থাকে। আয়োজকেরাও কৌতূহল ভাঙতে দেন না বলে পুরস্কারজয়ীদের নাম হয়তো অনেক দেরিতে ঘোষণা করেন। আম্মা ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলেন, মাঝেমধ্যে এসে তার নাতি-নাতনিদের দেখে যান। তাকে বলেছিলাম কিছুদিন অপেক্ষা করতে। পরে আয়োজনের তারিখ ঘোষণার পরও যখন ওরা আমাকে কিছু জানাল না, ভেবেছিলাম পাইনি। আম্মাও তখন চলে যান রংপুরে। এর একদিন পরেই ফোনে জানলাম পুরস্কারটা পেয়েছি। আফসোস হয়েছিল। আম্মার পক্ষেও আবার সেই রংপুর থেকে আসা সম্ভব ছিল না।

ওমেন্সকর্নার : অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্বের পর অবশেষে প্রকাশ পেয়েছে আপনার দ্বিতীয় উপন্যাস "আমাদের শহরে বাঘ এসেছিল"। নতুন এই উপন্যাসের প্লট কি? 

রাজীব হাসান​​​​​​​: আমার গল্পটা কিছু মানুষকে নিয়ে। রাশেদকে নিয়ে গল্প, যে স্বপ্ন দেখে একদিন ট্রেনের চালক হবে। একজন ফুলবানু, যে স্বপ্ন দেখে রাশেদকে বিয়ে করে সেই ট্রেনে ঘর বাঁধবে। আমার গল্পটা শাওন-রনির। যারা স্বপ্ন দেখে রংপুরে তাদের দুইটা বাড়ি থাকবে, দুইটা বাড়ি থাকলে ভোকাট্টা ঘুড়ি তাদের বাড়িতে এসে পড়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ হবে; অথচ তাদের বাবা বাড়ি ভাড়াই দিতে পারেন না। আমার গল্পটা চিত্রার, যে বাবর ভাইকে ভালোবাসে ভীষণ। বাবর ভাইয়ের জন্য বুকে আতরের গন্ধ ফোটাতে চায়। আমার গল্পটা বু নামের এক আশ্রয়হীন বৃদ্ধার, খুব কৈশোরে বৈধব্যের সাজ নেওয়া বু তাঁর অতৃপ্ত সংসারের স্বপ্ন পূরণ করতে চায় নাতির সংসারের মধ্যে দিয়ে। নাতিটার একটা ঘোমটা দেওয়া কিশোরীবধূ থাকবে, হাটে একটা গোলামালের দোকান। 

এই গল্পটা আসলে নব্বই দশকের রংপুর শহরের। শহরে হঠাৎ করে গুজব রটে এক বহুরূপী বাঘ নেমেছে। সেই বাঘ যাঁকে আঁচড় দেয়, শরীরে থেকে যায় তিনটা দাগ। সে কী আতঙ্ক শহরজুড়ে!  তবে আমার গল্পটা হরর গল্প বা পিশাচকাহিনি নয়। রহস্য উপন্যাসও না। কিন্তু এখন আমি যখন পেছন ফিরে তাকাই, অনেকের শরীরে তিনটা আঁচড়ের দাগ পাই। শনাক্তকরণ চিহ্নের মতো। এই দাগগুলো তাহলে কে দিল, কোত্থেকে এল। সেটা খোঁজার গল্পই হলো আমাদের শহরে বাঘ এসেছিল। বাকিটা পাঠক আবিষ্কার করে নিক।

ওমেন্সকর্নার : এক সময় আপনি ফেসবুকে দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট বিষয় নিয়ে নিয়মিত লেখালিখি করতেন। সবাইকে আপনার স্ট্যাটাসের প্রেমে ফেলে, এখন আর নিয়মিত লিখেন না। আপনার ফলোয়ারেরা অধীর অপেক্ষায় থাকে। আপনি এবিসি রেডিও তে একটা অনুষ্ঠান করতেন "মেন্টস বাত্তি জ্বালাও" নামে। অসংখ্য শ্রোতা শুধুমাত্র আপনার কণ্ঠের জাদু আর রসবোধে বিমোহিত হয়ে থাকত। হঠাৎ সেই অনুষ্ঠান করা ছেড়ে দিলেন। আজও আপনার অগণিত ভক্ত শ্রোতা আপনার সেই অনুষ্ঠানকে মিস করে। প্রথম উপন্যাসের এত সাফল্যের পরও দ্বিতীয় উপন্যাস প্রকাশ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। তাই শঙ্কা জাগে আমরা আবার আর. জে রাজীব হাসানের মতো ঔপন্যাসিক রাজীব হাসানকে মিস করব না তো? 

রাজীব হাসান​​​​​​​: আমি খুবই দ্বিধাগ্রস্ত একজন মানুষ। অসম্ভব প্রতিভাধর কোনো কালেই ছিলাম না। ছাত্র হিসেবে ছিলাম পেছনের বেঞ্চের। পরীক্ষার খাতায় অঙ্ক করতে করতে টেনশন হতো, হচ্ছে কি অঙ্কটা? ভুল হলেই তো বিপদ! ইংরেজির প্যাসেজ ট্রান্সলেশন করার সময় ভয় হতো ভুল হচ্ছে না তো! খুব শৈশবে বুঝে গিয়েছিলাম, আমি খুব বেশি সুযোগ পাব না। একটাই তির ছুড়তে পারব, সেই তিরটা লক্ষ্যভেদী হতেই হবে। এরপর কেউ আমার হাতে তির-ধনুক আর তুলে দেবে না। ব্যর্থ হওয়ার এই ভয়টা সব সময়ই আমাকে তাড়া করে। যখন রেডিও শো করতাম, একপর্যায়ে মনে হলো, যতটা ভালো করা উচিত পারছি না। ফলে এখানেই থেমে যাওয়া দরকার। যখন ফেসবুকে জীবনের ছোট ছোট গল্পগুলো লিখতাম, মনে হলো, কোনো গল্পই আর আগের মতো হচ্ছে না। নটে গাছটি মুড়াল, আমার গল্প ফুরালো। লেখক হিসেবেও আমার সংশয় কাটে না। পরের বার উপন্যাস কি লিখব? নিশ্চিত না।

ওমেন্সকর্নার : আপনি নিজে একজন আর. জে ছিলেন। বর্তমানে আরজেদের নিয়ে সবচেয়ে বড় সমালোচনা হচ্ছে ভাষার সংমিশ্রণ ও বিকৃতি নিয়ে। একজন আরজে হিসাবে আপনি বিষয়টিকেই বিভাবে দেখেন? এখান থেকে উত্তরণের উপায় কি? 

রাজীব হাসান​​​​​​​: আমি নিজে এত ভুল উচ্চারণে কথা বলতাম, তোতলামিও আছে কিছুটা। ফলে বাংলাদেশের আরজেতে নিয়ে আমি কিছু বলি, এটা শোভা পায় না। তবে ভুল উচ্চারণ আর ভাষা বিকৃতি দুটি আলাদা। শ্রোতা হিসেবে এখানে আমার কিছু বক্তব্য আছে। আমাদের আরজেদের কে বুঝিয়েছে জানি না, তারা ইংরেজি ধাঁচে বাংলা বলেন। আরজেদের এটাই একটা ধরন দাঁড়িয়ে গেছে। একটা বাক্যের মধ্যে আমরাও অনেক সময় ইংরেজি ব্যবহার করি। কিন্তু আরজেদের কথা বলার ধরন আর ইংরেজি অতিব্যবহার দুটোই কৃত্রিম লাগে, আরোপিত মনে হয়। মনে হয় নিজেকে জাহির করার, অতি স্মার্ট বোঝানোর একটা চেষ্টা। কিন্তু আমি প্রায় আড়াই বছর রেডিওতে কাজ করে ভুল উচ্চারণ নিয়ে শো করে এত মানুষের ভালোবাসা পেয়ে বুঝেছি, এখানে শুদ্ধ বাংলায়, যতটা সম্ভব কম ইংরেজি বলে, আপনাকে শ্রোতাদের মতো করেই কথা বলা উচিত। তাহলে আরজেরাও অনেক জনপ্রিয় হবেন। বাংলাদেশে আরজে হিসেবে যে কজন অন্য মাত্রার জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, তারা কেউ কিন্তু প্রচলিত আরজেদের মতো নন। তারা সবাই সুন্দর করে, শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন। প্রথম শোনায় হয়তো তাদের কথাকে আকর্ষণীয় মনে হয় না। তবে এরাই সত্যিকারের ভক্তশ্রোতা তৈরি করতে পারেন, বাকিরা হারিয়ে যায়। রংবাহারি চটকদার জিনিস বেশি দিন টেকে না।

ওমেন্সকর্নার :  লেখালেখির দিক দিয়ে বাংলাদেশি নারীরা কতটুকু এগিয়ে বা ভবিষ্যতে কি রকম সম্ভাবনা আছে বলে আপনি মনে করেন? 

রাজীব হাসান​​​​​​​: গুণগণ মানে নারীরা অনেক এগিয়ে। কিন্তু সংখ্যায় অনেক কম। আমাদের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী, সাহিত্যকেও আমরা নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের বাইরে রাখতে পারব না। বইমেলার পাঠকদের অর্ধেকের বেশি নারী, এটা আমি সহজ পর্যবেক্ষণ দিয়ে বুঝেছি। নারীর আবেগ, নারীর অনুভূতি আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের গল্প একজন পুরুষ লেখক কখনোই ধারণ করতে পারবে না। কেবল রবীন্দ্রনাথ পেরেছিলেন, হুমায়ূন আহমেদও অনেকটা। রবীন্দ্রনাথের অনেক গানের লিরিক খেয়াল করলে দেখবেন, ওটা নারীদের হয়েই বলা। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ সখী ভালোবাসা কারে কয়। এই এক গানে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি নারীদের ভালোবাসার আবেগটা যেভাবে ধরতে পেরেছেন, বিশাল উপন্যাসেও তা সম্ভব না। সেই মাপের শিল্পী তো আমরা পাব না, তাহলে নারীদের আবেগটা কে তুলে আনবে? আমাদের বুদ্ধিজীবী মহলের সমস্যা হলো, নারীদের নিয়ে কোনো নারী যদি ফিকশন করতে চান, দ্রুত তাঁকে নারীবাদী লেখক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হবে। কোনো দিন তো শুনলাম না ওই লেখকটা পুরুষবাদী। তাহলে নারীবাদী লেখক হিসেবে কাউকে আখ্যায়িত করা হবে কেন?

ওমেন্সকর্নার : স্বপ্নবাজ রাজীব হাসানের স্বপ্নের বাংলাদেশ কেমন? 

রাজীব হাসান​​​​​​​: আমি চাই দেশটা একটা মধ্যবিত্ত পরিবার হয়ে উঠুক। যে পরিবারে ঝগড়া থাকবে, রাগ-অভিমান-মন কষাকষি থাকবে। ভাইবোনদের মধ্যে একটু-আধটু চুলোচুলিও না হয় হলো। কিন্তু দিন শেষে সবাই যেন এক টেবিলে বা মাদুর পেতে বসে ভাত খায়। সকালের দুপুরের অভিমানটা, ঝগড়াটা ভুলে যায়। নিজের পাতের মাছের মুড়ো কি মাথাটা অন্যজনের প্লেটে তুলে দেয় যেন। আমরা বলি না, দেশটা মায়ের মতো? দেশটা আসলেই মা। আমাদের জাতীয় সংগীতই কিন্তু এই মায়ের গল্পটা বলে, যে মা স্নেহের আঁচল বিছিয়ে রেখেছে। এই জাতীয় সংগীতটা শুধু গাইলে হবে না, রক্তের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলতে হবে। তা হলেই না আমরা পরিবার হয়ে উঠব। মনে রাখবেন, যে পরিবারে নিজেদের মধ্যেই ঐক্য নেই; বাইরে থেকে তাদেরই খুব সহজে আক্রমণ করতে পারে, পথভ্রষ্ট করবে পারে সুযোগসন্ধানীরা। মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি!

ওমেন্সকর্নার : আপনার মূল্যবান সময় থেকে আমাদের এতো সময় দেওয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। 

রাজীব হাসান​​​​​​​: ওমেন্স কর্নারকেও অনেক ধন্যবাদ। চলার পথ শুভ হোক। 

Leave a Comment