গল্প : হরেক রকম বড়া ( দ্বিতীয় পর্ব )

  • ফারজানা আক্তার 
  • ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২০

গল্প : হরেক রকম বড়া ( দ্বিতীয় পর্ব )


সেদিন পালিয়ে যাওয়ার প্রথম সংসারের প্রথম দিন ছিলো। রাবেয়া এর আগে কখনো নিজের প্লেট ধুয়ে ভাত খায় নি। খাবে কিভাবে? বড়লোক বাবা মা একমাত্র আহ্লাদী কন্যা রাবেয়া।

তার কোনকিছুর প্রয়োজন হলে সে কথা বলার জন্য হা করার সাথে সাথে সামনে তিন চারজন এসে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই রাবেয়া যেদিন প্রথম ভাত রান্না করার জন্য রান্নাঘরে ঢুকে!

সেদিন চুলার উপরে থাকা গরম পাতিলের ঢাকনা সরাতে গিয়ে হাতে গরম তাপ লাগে। তাপ লাগার সাথে সাথে হাত সরাতে যেয়ে ফুটন্ত পাতিলে আঙ্গুল ঢুকে যায়। মনের উপর খুব চাপ থাকায় যতটা না ব্যথার সেদিন কাঁদছিলো, তার থেকে বেশি ভয়ে।

যার সাথে রাবেয়া তার প্রথম সংসার শুরু করেছিলো সেই কবির হাসান সেদিন রাবেয়াকে বলেছিলো, 'রান্নাবান্না করতে গেলে হাত পা কমবেশি সবারই পুড়ে। এতো কাঁদার কিছু হয় নি। তোমার বাপের মতো আমার লাটসাহেবী এতো ধোন সম্পদ নেই। কোন দাসী বান্দীর ব্যবস্থা আমি করে দিতে পারবো না। '

সেদিন রাবেয়া আগুনে পোড়া হাতের ব্যথা ভুলে গিয়ে সদ্য বিয়ে করা তার প্রথম ভালোবাসার মানুষের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলো। এই সেই মানুষটা যার জন্য সে বাবা মা আত্মীয় স্বজন সবাইকে ছেড়ে চলে এসেছে।

এই সেই মানুষ যে তার হাত ধরে বলেছিলো বিশালবহুল জীবনযাপন দিতে না পারলেও যে তাকে বুক দিয়ে সারাজীবন আগলে রাখবে। এই সেই মানুষ! সত্যিই কি এই সেই মানুষটা!

কবির হাসান সম্পর্কে রাবেয়ার শিক্ষক ছিলো। প্রতিদিন বিকেলে রাবেয়াকে পড়াতে বাসায় আসতো। কৈশোরে পা দেওয়া রাবেয়ার তখন উড়ু উড়ু মন।

কবির হাসানের সুন্দর চেহারা, মায়াবী চোখ আর সিনেমার হিরুদের মতো চমৎকার বাচনভঙ্গীতে রাবেয়া খুব অল্প সময়ে কবির হাসানের প্রেমে পড়ে যায়। পড়া বাদ দিয়ে রাবেয়া সারাক্ষন এই সেই প্রশ্ন করে বেড়াতো কবির হাসানকে।

কবির হাসান একটু চুপ করলেই যেন রাবেয়ার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতো। কবির হাসানের প্রতিটি কথায় কি যে মায়া থাকতো সে কথা শুধু রাবেয়াই জানে!

'আরে দেখি দেখি হাত কতটুকু কাটলো? সেই কখন হাত ধুইতে বললাম তোমাকে আর তুমি বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে কি ভাবছো বলো তো দেখি?' রফিক সাহেবের কণ্ঠে রাবেয়া চমকিয়ে উঠে।

'তুমি এতো অস্থির কেন ? হাত বেশি কাটে নি।' রাবেয়া একটু হেসে কিছুটা জোরে কথাটা বললো। কিন্তু মনে মনে সবসময় চায় রফিক সাহেব এতো অস্থির থাকুক ওর জন্য। সামান্য একটু অস্থিরতায় যে পরিমান ভালোবাসা মেশানো থাকে কোটি বছর ভালোবাসার প্রমান দিয়ে গেলেও তার ছিটেফোঁটা বুঝানো যাবে না।

'আরে অস্থির হবো না! একদিকে আমার স্বাদের চিংড়ির বড়া, অন্যদিকে আমার ভালোবাসার মানুষটা! কোনদিকে যাই বলো তো?' রফিক সাহেব সরল গলায় কথাটা বলে অদ্ভুর অসহায়ের লুক দিয়ে রাবেয়ার দিকে তাকালো। রাবেয়া জোরে হাহাহা করে হেসে দিলো।

'আসো আসো! তোমার চিংড়ির বড়ার কাছেই আসো। এই চিংড়ির বড়ার কাছে তুমি দেখি সত্যিই অসহায়। একটা মানুষের চিংড়ির বড়া এতো প্রিয় হয় কিভাবে বলো তো? '

'ঘরে বানানো তেঁতুলের টক, গরম গরম চিংড়ির বড়া আর শুকনো মরিচ ভাজা! আহা অমৃত! আর এই তেঁতুলের টকে যদি সামান্য লেবুর রস মিশিয়ে দাও পুরো খাবারের স্বাদই বদলে যাবে।

এই চিংড়ির বড়ার সাথে যদি কয়েকটা পুঁই শাকের নরম পাতা দাও না তাহলে তো বড়ার স্বাদ কয়েকশ গুন বেড়ে যাবে। আর যদি... ' রফিক সাহেবের মুখে রাবেয়া হাত দিয়ে কথা বন্ধ করে দিলো।

'আর সাথে যদি ঝুম বৃষ্টি হয় তাহলে পুরো বড়া আর বৃষ্টিতে মাখো মাখো, তাই না?' রফিক সাহেবের মুখ বন্ধ করে রাবেয়া নিজে পরের লাইন সম্পূর্ণ করলো।

বৃষ্টির কথা বলে রাবেয়া নিজেই চুপ হয়ে গেলো। সেইদিনও বৃষ্টি ছিলো যে বৃষ্টির পানিতে রাবেয়া তার বিভীষিকাময় জীবনের অধ্যায় ধুয়ে এসেছে।

চলবে...

গল্পঃ হরেক_রকম_বড়া

 

Leave a Comment