‘আমার মাম্মাকে মাউ কাম্মা দিয়েছে, মাম্মার অনেক ব্যথা’

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক
  • মার্চ ২০, ২০১৮

আমার মাম্মাকে মাউ কাম্মা দিয়েছে, মাম্মা প্লেন থেকে পড়ে গিয়েছে, মাম্মার অনেক ব্যাথা! আড়াই বছরও হয়নি হিয়া মেয়েটার বয়স, এখনই সে জানে তার মায়ের অনেক ব্যাথা! তবে এই ব্যাথা ভোগ করার জন্য পৃথিবীতে আর নেই তার মা শারমিন আক্তার নাবিলা। ঘরের নাম নিশাত। গত ১২ মার্চ নেপালে দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হওয়া প্লেনের একজন কেবিন ক্রু ছিলেন তিনি। দুর্ঘটনার পর থেকেই মায়ের সঙ্গে হিয়াও আছে সংবাদের শিরোনামে। প্রথমে শোনা গেল হিয়া অপহৃত হয়েছে, এরপর জানা গেল হিয়া তার নানীর কাছে এরপর বের হলো আসল ঘটনা, হিয়া বা তার মা নাবিলার জীবনে ১২ মার্চ আসেনি। দুর্ভাগ্য তারা বয়ে বেড়াচ্ছিল অনেক দিন ধরেই।

পূর্ব নাখালপাড়ার ব্যাটারির গলিতে হিয়া আছে তার দাদীর কাছে। সৌভাগ্য দাদী-নানীর টানা-হ্যাঁচড়ায় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে গিয়ে পৌঁছায়নি এই ছোট্ট মেয়েটি। এখানে আছে তার সার্বক্ষণিক সহচারী রুনার সাথেই। রুনা হিয়াকে দেখাশোনার কাজ করত যখন তার মা নাবিলা প্লেনে যেত যাত্রীদের আরাম আয়েশের দেখা শোনা করতে। এই রুনার উপরেই ছিল অপহরণের অভিযোগ। হিয়ার বাবা ইমাম হাসান ফিরে এসেছেন। তার দাবি সে দুবাই ছিল, সেখানে চাকরি করত। পরিবার বলে সে তিনদিনের জন্য ইন্ডিয়া গিয়েছিল। কারও সঙ্গে কারও কথা মিলে না। বাবার সামনে হিয়া ‘কাঠ’। বাবার কাছে যাবে বা রুনার আঁচলের কিনারা ধরেই দাঁড়িয়ে।

কথা হয় হাসানের সঙ্গে। প্রেমের বিয়ে ছিল তাদের। নাবিলার সঙ্গে পরিচয় বাণিজ্য মেলায়। একটা স্টলে কাজ করত সেখানে হাসান। নাবিলা গিয়েছিল তার এক নানার সঙ্গে। হাসান, তার বন্ধু বান্ধব, বাড়ির লোকজন, প্রতিবেশী, সবার এক কথা, নাবিলা খুব দু:খী মেয়ে ছিল! নাবিলা বড় ভালো মেয়ে ছিল! ছোটবেলা থেকে যুদ্ধ করে বড় হওয়া মেয়ে নাবিলা। বাবা মরে গিয়েছে বহু আগে। মাও আবার বাঁধেন ঘর। সে ঘরে ঠাই হয়নি নাবিলার। সেই থেকে দাদুর কাছে মানুষ। অভিজাত পরিবারের মেয়ে তাও সাধারণ পরিবার থেকে আসা হাসানকেই তার মনে ধরে। হয়তো একটা পরিবারই শুধু চেয়েছিল সে!

এই যুদ্ধে টিকে থাকতেই ছয় মাসের হিয়াকে রেখে আকাশে উড়াল দেওয়া যাত্রীদের সেবা দেওয়ার প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে সে। কথা হয় নাবিলার নানী মিনুর সঙ্গে। নাবিলার মায়ের খালা তিনি। খুব আফসোস করে বলেন, মেয়েটা খুব মেধাবী ছিল, কিন্তু বোকা ছিল। বিবিএ প্রথম বর্ষে পড়ত, দুম করে বিয়ে করে ফেলল। তবে শ্বশুরবাড়িতে হয়তো ভালোই ছিল। কখনও ওকে বলতে শুনিনি এখানে কেউ অযত্ন করে। নাবিলার যত্ন অযত্ন বোঝা না গেলেও হিয়া যে এই পরিবেশে বেশ মানানসই তা বেশ বোঝা যায়। তার ফুপু ফাতেমা পুংখানুপুংখভাবে জানেন কীসের পরে কী লাগবে হিয়ার। সেই সব গুছিয়ে রওনা হন আর্মি স্টেডিয়াম নাবিলার মরদেহ আনতে।

সন্ধ্যা নামলে ফিরে আসে ইমাম হাসান ও তার পরিবার, সঙ্গে বাক্সবন্দি নাবিলার শব। বাক্স খোলার উপায় নেই। বাড়ির লোকেদের মধ্যে দীর্ঘ ক্লান্তি আর দীর্ঘশ্বাস। এখানেও দেখা মিলে না নাবিলার মা মীনা জামানের। হিয়া জানে না ঐ বাক্সটাই তার মা অথবা মায়ের ঝলসে যাওয়া দেহবাশেষ। সে তখনও প্লেন গুণছে, কোন প্লেনে আছে তার মা? কখন আসবে? নেপাল থেকে নাবিলাকে নিয়ে এসেছে নাবিলার ভাসুর বেলাল আহমেদ বাবলু। হিয়া যেন প্রাণ ফিরে পেলো চাচাকে পেয়ে। চাচাকে সে ডাকে বাবা বলে। বাবাকে এখন আর গোসলেও যেতে দিবে না। বাবার কোলেই থাকবে। বাবা যেই না বলল, হাসো! ওমনি মুখ ভরে হাসি চলে এলো মেয়ের। এই জ্বালা ধরা কঠিণ জীবনে বাবাই যে তার একমাত্র বেঁচে থাকার সম্বল তা বুঝে গিয়েছে ছোট্ট মেয়েটিও। লতানো গাছের মতো তাই আঁকড়ে ধরে আছে ‘বাবা’কে। হিয়া, অবিকল মাতৃমুখের মেয়েটির ভাগ্যটিও হলো মায়ের মতো। এখন মায়ের মতো দাদীর কাছেই বড় হতে হবে তাকে। মা হয়তো তার জন্য হবে একটা ছবি অথবা বুকের ভিতর এক বিশাল শূন্যস্থান। কখনও কি সে জানবে, তার জীবন যেন মায়ের মতো না হয় সে চেষ্টায় তার মা জীবন দিয়ে গিয়েছে?

 সূত্র : সারাবাংলা   

Leave a Comment