সেলফিবাজীর নামে এই অসভ্যতার কি খুব দরকার ছিল?

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক 
  • মে ২৫, ২০১৮

ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হয়ে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো পরিদর্শনে এসেছিলেন বলিউড তারকা প্রিয়াংকা চোপড়া। পর্দায় সাবলীল অসামান্য অভিনয়ে যেমন দর্শকদের মন জয় করেছেন তিনি, ঠিক তেমনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাথেও সহজ হয়ে মিশতে চেয়েছিলেন তিনি, অনুভব করতে চেয়েছিলেন তাদের দুর্দশাটুকু। সেজন্য তার আশেপাশের সকল নিরাপত্তাবলয় সরিয়ে দিয়েছিলেন যেন সবার সাথে ফ্রি-লি মিশতে পারেন , কথা বলতে পারেন। আর জাতিগতভাবে খুবই ‘বিচিত্র’ আমরা সেই সুযোগে এমন অদ্ভুত সব কান্ড করে বসেছি যে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির থেকে প্রিয়াংকা ফিরেছেন একরাশ বিবমিষা জাগানো অনুভুতি নিয়ে!

তো কি ঘটেছে সেখানে? গত সোমবার বিকাল ৪টার দিকে টেকনাফের বাহারছড়া শামলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যান বলিউডের জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী। মুহুর্তেই তাকে ঘিরে ভিড় জমে যায় রোহিঙ্গাদের ভেতর। প্রিয়াংকাও তাদের সাথে কথা বলার জন্য, খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য নিরাপত্তাবলয় সরিয়ে দেন। যখন তিনি রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলছিলেন, আশেপাশে এসে ভিড় জমান সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে গণমাধ্যমকর্মীরাও। বেশিরভাগ মানুষই রূপালী পর্দার বহু দূরের এই স্বপ্নের তারকাকে সামনাসামনি দেখে স্বভাবই উচ্ছ্বসিত হয়ে তার সাথে একটা সেলফি নেবার চেস্টা করেন। তখন পর্যন্ত কোন সমস্যা হয়নি। সিংহভাগ মানুষ নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে স্মার্টফোনে সেলফি তুললেও কয়েকজন অতি উৎসাহী শুরু করেন বাড়াবাড়ি।


 

সাবলীল অভিনয়ে যেমন সবার কাছে আপন হয়েছেন ঠিক তেমনি নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের সাথেও আন্তরিক হয়ে মেশার চেষ্টা করেছেন গুণী অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। তাই সোমবার সমুদ্র সৈকতের কূলঘেষে টেকনাফের বাহারছরা মনখালী এলাকার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তাবলয় একপ্রকার তুলে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এ সরলতা তার জন্য উল্টো হয়ে দাঁড়ায়। রোহিঙ্গা নারী-শিশু ও প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মী ও সাধারণ মানুষও কাছাকাছি এসে রূপালী পর্দার স্বপ্নের মানুষটাকে দেখার সুযোগ পান। এ স্মরণীয় মুহূর্তকে ধারণ করে রাখতে সঙ্গে থাকা স্মার্টফোনে প্রিয় নায়িকাকে অনেকে সেলফিবন্দি করতে শুরু করেন। বিপত্তিটা বাধে তখনই!

কোন বাধা ছাড়াই প্রিয়াংকার কাছে যেতে পারায় অনেকেই বেপরোয়া হয়ে প্রিয়াংকার গা ঘেঁষে সেলফি তুলতে শুরু করেন। জানা গেছে, অনেকেই স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা বা বন্ধুদের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ ধরেছিলেন যে প্রিয়াঙ্কার গা-ঘেঁষেই সেলফিবন্দি হবেন। সেই চ্যালেঞ্জ মেটাতেই ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে খুবই দৃষ্টিকটুভাবে প্রিয়াংকার গা ঘেঁষে সেলফি তুলতে চেষ্টা করেন এরা। সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যখন প্রিয়াংকা রোহিঙ্গা নারী-শিশু এবং ইউনিসেফের কর্মীদের সাথে কথা বলছিলেন তখন। এই বিবেচনাহীন অভদ্র মানুষগুলো ঠিক সেই মুহুর্তে চারপাশ থেকে প্রিয়াংকার শরীর ঘেঁষে সেলফি তুলতে শুরু করেন!


 

স্রেফ একবার কল্পনা করার চেস্টা করুন তো, প্রিয়াংকার মত একজন আন্তর্জাতিক সেলেব্রেটি একেবারেই সাধারণ মানুষের মত রোহিঙ্গা শিবিরে ঘুরছেন। ঘর-বাড়ি হারা রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলছেন, তাদের দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে জানার চেস্টা করছেন। আর এর মধ্যেই এক দঙ্গল পঙ্গপালের মত কিছু মানুষ সভ্যতা ভব্যতা ধার না ধেরে শিষ্টাচারের নিকুচি করে তাকে ঘিরে উন্মত্তের মত সেলফি তোলার প্রতিযোগিতায় বুঁদ হয়ে আছে। খেয়াল করারও প্রয়োজনবোধ করছে না যে, এতে সেই মানুষটা বিব্রত হচ্ছেন, নাকি বিরক্ত হচ্ছেন নাকি প্রবলভাবে বিবমিষা বোধ করছেন!

সবচেয়ে হতাশাজনক ব্যাপারটা হচ্ছে এই বোধ-বিবেচনাহীন মানুষগুলোর একটা বড় অংশ ছিলেন মিডিয়াকর্মীরা, যারা তাদের পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে খুব ভালোভাবেই জানেন যে, এ ধরনের শিষ্টাচারহীন ঘটনা একজন সেকেব্রেটিকে কতটা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিতে পারে। তবুও তারা থামেননি, সেলফির নেশায় পাগল হয়ে প্রিয়াংকার সাথে অসদাচরণ করেছেন এবং এসব সেলফি আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গর্বের সাথে আপলোডও করেছেন তারা।

প্রিয়াংকা অবশ্য ধৈর্য্য হারাননি, পরিস্থিতি আরো বিদঘুটে না করতে সে সময়ে প্রতিবাদ না করলেও এসব বাড়াবাড়িতে ক্ষেপেছেন তিনি। হোটেলে ফিরে এ নিয়ে তিনি রীতিমতো ক্ষোভ ঝেড়েছেন। আর এরপর এধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে বিরক্ত প্রিয়াংকা পরিবর্তন আনেন তার ক্যাম্প ভিজিটের নির্ধারিত শিডিউলেও। সিদ্ধান্ত দেন মঙ্গলবার ক্যাম্প পরিদর্শনকালে ইউনিসেফ কর্মকর্তা ও নিজস্ব নিরাপত্তাবাহিনী ছাড়া কেউ কাছে থাকবে না। কোনো মিডিয়াকর্মী, স্থানীয় জনগণ এমনকি বাংলাদেশি নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরাও না। কতটা বিরক্ত হলে এধরণের সিদ্ধান্ত দিতে পারেন তিনি!

শিডিউল মতে, মঙ্গলবার সকালে টেকনাফের সাবরাং হারিয়াখালি, নয়াপাড়া, উনচিপ্রাং ও লেদা ক্যাম্পে যাওয়ার কথা ছিল প্রিয়াঙ্কার। কিন্তু তিনি সকাল সাড়ে ৯টায় সাবরাংহ হারিয়াখালি ক্যাম্পে গেলেও ইউনিসেফের নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও নিরাপত্তাকর্মী ছাড়া কাউকে তার এক কিলোমিটারের ভেতর আসতে দেয়া হয়নি। নিজের মতো করেই ক্যাম্পে রোহিঙ্গা শিশু ও নারীর সাথে কথা বলেন তিনি। এরপর নাফনদীর তীরে গিয়ে মিয়ানমারের সীমানা ও অন্যান্য এলাকা অবলোকন করে ছবি তুলে নেন।

তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে টেকনাফ থানার ওসি রনজিত বড়ুয়া বলেন, সোমবার বাহারছরায় সবার সাথে প্রাণবন্ত আচরণ করায় সেলফির নামে তামাশা করেছেন অনেকে। ফলে মঙ্গলবার কঠোরভাবে সবার কাছ থেকে দূরে থেকেছেন বিশ্ব সেলিব্রেটি প্রিয়াঙ্কা। তার চাওয়া মতো নিরাপত্তা কঠোরভাবে পালন করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ নয় গণমাধ্যমকর্মী এবং স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীকেও কাছে যাওয়ার অনুমতি দেননি তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউনিসেফর এক কর্মকর্তা বলেন, এটি দুঃখজনক। কোনো সেলিব্রেটি যখন পাবলিক প্লেসে আসে তখন সচেতন পেশাজীবীদের উচিত তার সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু সেলিব্রেটিরা যখন সাধারণ মানুষের সাথে সাবলীলভাবে মিশে আন্তরিক হতে চাই তখনও উচিত নিরাপত্তা বলয়ের মতোই তার কাছ থেকে নূন্যতম দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। এতে ভক্তকূল সম্পর্কে তার ধারণাটা পরিচ্ছন্ন হবে। সোমবার ইনানীর মনখালীতে কিছু মিডিয়াকর্মী বিশ্রিভাবে সেলফিবাজি করেছে। যা নিয়ে ভীষণ মনক্ষুণ্ন হয়েছেন শুভেচ্ছাদূত। তাই মঙ্গলবারের পরিদর্শনে কাউকে কাছে আসতে না দিতে কঠোরভাবে বলে দেন।

জাতিগতভাবে আমরা অতি উৎসাহী এক জাতি। সামান্য ড্রেনের পাইপ বসানো থেকে শুরু করে একটা গর্ত খোড়া হলেও তার চারপাশে অসংখ্য মানুষ জমে যায়। একটা গর্তের সামনে দাঁড়িয়ে তারা আসলে কি দেখে? অদ্ভুত না?

তো এহেন অতি উৎসাহী সাধারণ মানুষজন যে একজন আন্তর্জাতিক সেলেব্রেটির গুরুত্ব ও তার বিনা অনুমতিতে তার গা ঘেঁষে সেলফি তোলাটা অভদ্রতার ব্যাপারটা বুঝবে না, সেটা তো সহজবোধ্য। কিন্তু যেটা একেবারেই বোধগম্য হচ্ছে না যে পেশাগত কারণে এই ব্যাপারটা সম্পর্কে জেনেবুঝেও কিভাবে আমাদের মিডীয়া কর্মীরা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তাকর্মীরা এ ধরনের আচরণ করলেন? তারা কি একবারও টের পাননি যে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত এই আচরণটা তাদের এবং তাদের দেশের ভাবমুর্তির বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে? একটা সেলফি তুলতে গিয়ে সহজেই তারা প্রিয়াংকা চোপড়াকে আমাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও শিষ্টাচারবহির্ভূত অভদ্র আচরণ সম্পর্কে ধারণা দিলেন!

এই যে এখন প্রিয়াংকার আমাদের সম্পর্কে ও আমাদের দেশ সম্পর্কে একটা নেগেটিভ ধারণা হয়ে গেল, এই ক্ষতিটা কি দিয়ে পূরণ হবে? অথচ চাইলেই পরে কোন এক সময় প্রিয়াংকার পারমিশন নিয়েই তারা সেলফি তুলতে পারতেন! কি, পারতেন না? এই সহজ শিষ্টাচারগুলো আমরা আর কবে শিখবো? আদৌ কি শিখবো?

সূত্র : এগিয়ে চলো 

Leave a Comment