থামছে না ওদের চোখের পানি!

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক 
  • জুন ১২, ২০১৮


* স্বামী আমাকে মেনে নিচ্ছে না

* আপনাদের পায়ে ধরি, মেয়েদের ফিরিয়ে আনুন 

* সেই নির্যাতনের কথা বলা যাবে না

* এই দেশে যাওয়া বন্ধ করান

সংসারের অভাব ঘুচিয়ে আনবেন সচ্ছলতা। পরিবারের সদস্যদের মুখে ফোটাবেন হাসি। এমন স্বপ্ন নিয়েই প্রিয়জনদের ছেড়ে সৌদি পাড়ি জমান অসংখ্য নারী। গৃহশ্রমিক হিসেবে সৌদির মাটিতে পা দিতেই তাদের সেই স্বপ্ন উবে যায়। সৌদির শেখদের নির্মম নির্যাতনে সচ্ছলতার স্বপ্নের বদলে দু’চোখ বেয়ে পড়তে থাকে নোনাজল।

নির্যাতনের মাত্রা অসহনীয় হলে একসময় পালাতে বাধ্য হন এই নারী শ্রমিকরা। নানা নির্যাতন আর বঞ্চনা সহ্য করে সৌদি থেকে অনেকেই দেশে ফিরেছেন। তারপরও থামছে না তাদের চোখের পানি। পরিবারের যে সদস্যদের কথা চিন্তা করে সৌদি গিয়েছিলেন এখন তারাদের কাছেই বঞ্চনা, অবজ্ঞা আর মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা।

বিদেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসা ২০ জন নারীকে এক লাখ টাকা করে নগদ অর্থ সহায়তা এবং ৫০ জনকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চাকরি দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক এবং লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকর্চারস অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি)। সোমবার এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ২০ নারীর হাতে আর্থিক সহায়তার চেক তুলে দেয়া হয়। চাকরির আশ্বাস পাওয়া নারীরাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, সৌদিতে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরত আসা নারীদের পরিবারের সদস্যরা তাদের স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না। কোনো কোনো নারীকে ঘরে নিতে চাচ্ছেন না স্বামী। এমনকি অনেকের বাবাও তার মেয়েকেই ঘরে নিতে চাচ্ছেন না। অথচ এই নারীরা যখন বিদেশ থেকে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছিলেন, তখন সবাই সাধুবাদ জানাচ্ছিল।

আয়োজকদের পক্ষ থেকে যখন এসব কথা বলা হচ্ছিল তখন উপস্থিত নির্যাতিত নারীদের কেউ কেউ নীরবে চোখের পানি ফেলছিলেন। আবার কেউ কেউ কান্নার আওয়াজ চেপে রাখতে পারছিলেন না। তাদের দু’চোখ বেয়ে নোনাপানি মলিন মুখ গড়িয়ে পড়ার দৃশ্যে হৃদয়বিদারক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেখানে।

কয়েকজন নারীকে সংবাদকর্মীদের কাছে সৌদিতে নির্যাতনের বর্ণনা দেয়ার অনুরোধ করেন আয়োজকরা। এ সময় সবিরন (ছদ্দ নাম) নামের এক নারী বলেন, মালিকের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে আমি বলি, আমাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দে, আমাকে মারবি কেন। আমার বেতন দে, আমি দেশে ফিরে যাবো। উত্তরে মালিক বলে- তোর বেতন দেয়া হবে না, বাংলাদেশেও যেতে দেবো না।

‘এরপর আমার হাতের অনেকখানি পুড়িয়ে দেয়। কানের নিচে থাপ্পড় মারে। এতে আমি বেহুশ হয়ে পড়ি। চারদিন পড়ে ছিলাম। আমার কোনো খোঁজ-খবর নেইনি। খেতেও দেয়নি,’- বলেন সবিরন।

তিনি বলেন, এরপর একদিন গোপনে বাংলাদেশে ফোন করি। ফোন করার পর দালাল বলে, তোমার বাসা পরিবর্তন করে দেই। আমি বলি, আমাকে অনেক অত্যাচার করছে, আমাকে বাংলাদেশে নাও। কিন্তু আমাকে বাংলাদেশে না নিয়ে মক্তবে বিক্রি করে দেয় দালাল। এরপর আভায় বিক্রি করে দেয়। সেখানে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হই। একদিন মালিকপক্ষ আমাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে যায়, তখন আমি পুলিশ ধরে সফর জেলে আসি।

এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে সবিরন বলেন, ‘বহুত মেয়েকে যে নির্যাতন করেছে ভাই, সেই নির্যাতনের কথা বলা যাবে না। আপনাদের দোহাই লাগে, আপনাদের দু’খান পায়ে ধরি, আপনারা মেয়েগুলোকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। বহুত মেয়ের ঠ্যাং (পা) ভেঙে দিয়েছে, মেয়েগুলো হাঁটতে পারছে না। অনেকের পুড়িয়ে দিয়েছে। আপনাদের পায়ে ধরি, মেয়েদের বাংলাদেশে আনার চেষ্টা করেন। অতিরিক্ত নির্যাতন করছে।’

আরেক নির্যাতিন নারী সাবিনা (ছদ্মনাম) বলেন, বিদেশে অনেক লাঞ্চনা-বঞ্চনার শিকার হয়েছি। এক মাস ধরে আমার দুটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেয়নি। এক মাস আমাকে খেতে দেয়নি। জন্ডিস হয় আমার। এখনো ঠিকমতো খেতে পারি না। এখন আমার স্বামী আরেকটা বিয়ে করেছে। আমাদের কোনো খরচ দেয় না।

নির্যাতন করে হাত-পা ভেঙে দেয়া রেহানা (ছদ্মনাম) নামের এক নারী বলেন, আমি সৌদি থেকে আসছি সাত মাস হলো। সেখানে প্রথম মাস থেকেই আমাকে খাওয়া-দাওয়ার মাধ্যমে নির্যাতন শুরু করে। দ্বিতীয় মাস থেকে শুরু হয় আমার মুখের ওপর নির্যাতন। যখন তিন মাস হয়, তখন আমার হাত-পায়ে আঘাত শুরু করে। এরপরও আমি কাজ ছাড়তে চাইনি। সাত মাস হলে আমাকে সফরে নিয়ে যায়। সেখানেও আমাকে অনেক নির্যাতন করে। আমার হাতে ও পায়ে এমনভাবে বাড়ি মারে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। জ্ঞান ফিরে আমি রাস্তায় আসলে পুলিশ আমাকে হাসপাতালে নেয়। এরপর ব্র্যাকের সহায়তায় দেশে ফিরে আসি।

জেসমিন আক্তার (ছদ্মনাম)। সৌদি থেকে দেশে ফিরে আসার পর তার স্বামী তাকে আর নিতে রাজি হননি। এই নারী শ্রমিক কাঁদতে কাঁদতে বলেন, অনেক নির্যাতন। এই দেশে যাওয়া বন্ধ করান আপনারা। আমাকে রিয়াদে, দামমাম, আলকাসিয়ায় বিক্রি করে। অনেক বেচাকেনা হয়েছে। আমার স্বামী আমাকে মেনে নিচ্ছে না, ভাসুরও না দেবরও না। আমি অনেক কষ্টে আছি।

সূত্র : জাগোনিউজ২৪

Leave a Comment