চুড়িহাট্টা মোড়ের যানজট কাল হয়ে এসেছিল ওদের জন্য

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক:
  • ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৯

দুই সন্তান রামিম ও শাহিরকে নিয়ে রিকশায় করে চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড় পার হচ্ছিলেন রাশিদুল ইসলাম মিঠু ও সোনিয়া আক্তার দম্পতি। চুড়িহাট্টার পাশেই রামিমের স্কুল বন্ধুর বোনের কান ফোড়ানোর দাওয়াত খেতে যাচ্ছিলেন তারা। রিকশাটি চুড়িহাট্টার মোড়ে যানজটে যখন আটকে ছিল, তখনই সিলিন্ডারে ভয়াবহ বিস্ফোরণটি হয়। মুহূর্তেই কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা, সঙ্গে আগুনের লেলিহান শিখা। আগুনের ঝাটকা এসে লাগে সবার গায়ে। রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে রামিম কোনও মতে দৌড়ে কিছুটা দূরে সরে আসে। কিন্তু শাহিরসহ মিঠু-সোনিয়া দম্পতি সেই জট থেকে আর বের হয়ে আসতে পারেননি। সেখানেই করুণ মৃত্যু হয় তাদের। রামিমকে ভর্তি করা হয়েছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। শরীরের ছয় ভাগ ঝলসে গেছে তার।

মিঠু-সোনিয়া দম্পতির মতো আরও  অনেকেরই করুণ মৃত্যু হয়েছে বুধবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাতে, চুড়িহাট্টার মোড়ে সেই যানজটে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও জানিয়েছেন সড়ক থেকে তারা অন্তত ১৪-১৫ জনের লাশ উদ্ধার করেছেন। পোড়া যানবাহনের আশেপাশে ও নিচে পড়েছিল এসব লাশ। ভোর থেকে  লাশগুলো উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চকবাজারের চুড়িহাট্টার শাহী মসজিদের মোড়টিতে এমনিতেই ভিড় লেগে থাকে। রাস্তার দুই পাশে মার্কেট-দোকানপাট ও রেস্তোরাঁ। রাস্তাটি সরু হওয়ায় কোনও রকমে ওভারটেক করতে পারে দুটি প্রাইভেটকার। বুধবার রাতে    শহীদ মিনারে ‘ভিভিআইপি মুভমেন্ট’ থাকায় পুরানো কেন্দ্রীয় কারাগারের পেছনের সড়কে যানচলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। সেকারণে চুড়িহাট্টার সড়কে যানজট কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। আর সেটাই যেন কাল হলো যানজটে আটকে থাকা লোকজনের। সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর মুহূর্তের আগুনে সড়কের জটে আটকে থাকা লোকজন পুড়ে মারা যায় অত্যন্ত অসহায় ও করুণভাবে।

কামরাঙ্গীচরের ইসহাক বেপারী ছিলেন ভ্যানচালক। ভ্যানে মালামাল নিয়ে হয়তো কোথাও যাচ্ছিলেন তিনি। চুড়িহাট্টার মোড়ে যানজটে আটকে থাকা অবস্থায় পুড়ে যায় মালামালসহ সেই ভ্যানটি। ঘাতক আগুনের ছোবল থেকে রেহাই মেলেনি ইসহাকের। রাস্তায়ই পুড়ে মারা যান তিনিও। ইসহাক বেপারীর বোন হাসিনা বেগম জানান, কামরাঙ্গীচরের মতবর বাজারে স্ত্রী চম্পা বেগম ও দুই সন্তান আলিফ (৫) ও আরাফাত (৩)-কে নিয়ে থাকতেন ইসহাক। গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে ইসহাকের স্ত্রী চম্পা বেগম জানান, সকালে যে গামছা নিয়ে ইসহাক বের হয়েছিলেন, সেই গামছা দেখেই তাকে শনাক্ত করেছেন তারা। চম্পা বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। স্বামী ভ্যানচালক। তার আয় দিয়েই আমাদের সংসার চলতো। আমরা এখন কী করবো? আমারা দুই সন্তানের কী হবে?’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

সরেজমিন চুড়িহাট্টার ভয়াবহ আগুনের সেই জায়গাটি ঘুরে দেখা গেছে, সাইকেল-মোটরবাইকের পাশাপাশি একাধিক ঠেলাগাড়ি, রিকশা, ভ্যান পুড়ে কঙ্কাল হয়ে পড়েছিল। কোনও কোনও স্থানে ভ্যান-ঠেলাগাড়িতে বহন করা বিভিন্ন পণ্যের কিছু কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাস্তায় পড়েছিল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এসব পরিষ্কার করেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মীরা।

বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে কথা হয় রিনা বেগম নামে এক নারীর সঙ্গে। আরও  কয়েকজন নারীসহ তিনি সড়কের পাশে বসেছিলেন ভাবলেশহীন হয়ে। জানালেন, মজিবর হাওলাদার নামে তার এক স্বজন পুড়ে মারা গেছেন আগুনে। মজিবর ঠেলাগাড়ি চালাতেন, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে টালিগাড়ি। বেশিরভাগ সময় প্লাস্টিকের ‘দানা’ আনানেওয়া করতেন তিনি।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে রিনা বেগম জানান, ঠেলাগাড়িতে মজিবরসহ চার জন ছিলেন। চুড়িহাট্টার মোড়ে যানজটে আটকে ছিল ঠেলাগাড়িটি। গাড়ির মালামাল ছিল তার ভাইয়ের ছেলে যে গোডাউনের ম্যানেজার, সেখানকার। এজন্য আগুন লাগার পর অন্যরা দৌড়ে প্রাণ বাঁচালেও মালামাল সরাতে গিয়ে আগুনের মধ্যে পড়ে মারা যান পাঁচ সন্তানের জনক মজিবর। রিনা বলেন, ‘আমরা পা আর গায়ের গেঞ্জি দেখে মজিবরকে শনাক্ত করেছি। লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর রহমতগঞ্জে দাফন করবো।’

চকবাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী দোকান বন্ধ করে বাসায় ফিরছিলেন তিন বছরের ছেলে আরাফাতকে নিয়ে। সঙ্গে ছিল ছোট ভাই অপু রায়হানও। চুড়িহাট্টার সড়ক ধরে যানজট ঠেলে পাশের রহমতগঞ্জের ছাতামসজিদ এলাকার বাসায় ফিরছিলেন তারা। কিন্তু হঠাৎ সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ভয়াবহ সেই আগুনে তিনজনই পুড়ে মারা যান।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গের পাশে বসে বিলাপ করছিলেন আলী ও অপুর বোন জরিনা বেগম। মাঝে মাঝে চিৎকার করে কাঁদছিলেন তিনি। তাকে স্বান্তনা দেওয়া আলীর বন্ধু জুবায়ের জানালেন, ‘চাচা অপুর সঙ্গে বড় ছেলে আরাফাত বাবার দোকানে গিয়েছিল। একসঙ্গে বাসায় ফিরছিল তারা। কিন্তু আগুন একসঙ্গে কেড়ে নিলো তাদের।’ বলে নিজেও কান্নায় ভেঙে পড়েন। জুবায়ের জানান, আলীর স্ত্রী ইতি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামী ও সন্তানের মৃত্যুর খবরে সেও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আর অপুর চার মাসের একটি সন্তান রয়েছে। পরিবার দুটি পুরোপুরি পথে বসে গেলো, সহায়সম্বলহীন হয়ে পড়লো।’

বুধবার রাত ১০টা ২১ মিনিটে চা খেতে বের হয়েছিলেন জয়নাল আবেদীন বাবুল। আগুনের পর থেকে তার মোবাইল বন্ধ। খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না তার। ঢাকা মেডিক্যালের মর্গেও তার লাশ শেনাক্ত করতে পারেননি স্বজনরা। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর চুড়িহাট্টার সড়কে তার ছবি নিয়ে আহাজারি করছিলেন বাবুলের মেয়ে নাসরিন আক্তার। নাসরিন জানান, কোনও এক বন্ধুর ফোন পেয়ে রাত ১০টা ২১ মিনিটে ২৬ নম্বর আজগর লেনের বাসা থেকে বের হন তার বাবা। হাজী বালু ঘাটে যাবার কথা ছিল তার। চুড়িহাট্টার সড়ক দিয়েই যেতে হয়। নাসরিন জানান, আগুনে তার বাবা পুড়ে মারা গেছেন কিনা নিশ্চিত হতে পারছেন না। লাশ দেখে শনাক্তও করতে পারেননি। রেডক্রসের সদস্যদের কাছে বাবার নিখোঁজ থাকার বিষয়টি জানিয়েছেন তিনি।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সদর দফতরের পরিদর্শক শরীফুল ইসলাম জানান, তারা রাস্তা থেকে অন্তত ১৪-১৫ জনের লাশ উদ্ধার করেছেন। এছাড়া, হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে নিচতলার মার্কেটের করিডোর থেকে একসঙ্গে থাকা ২৪টি লাশ উদ্ধার করেছেন। হায়দার ফার্মেসি থেকেও ৫-৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। অন্যান্য দোকান থেকেও একাধিক লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

টি/আ

Leave a Comment