হাঁটু ব্যথায় করণীয়

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক
  • সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৮

হাঁটু ব্যথা প্রায় সব বয়সের মানুষের একটি সাধারণ উপসর্গ। হাঁটু ব্যথার নানাবিধ কারণ বিদ্যমান রয়েছে। হাঁটুর মাংসপেশী, লিগামেন্ট, মেনিসকাস, বারসা, তরুণাস্থি বা অস্থির বিভিন্ন প্রকার সমস্যার কারণে হাঁটু ব্যথা হয়ে থাকে। আবার বয়স ভেদে হাঁটু ব্যথার বিভিন্ন কারণ বিদ্যমান। তবে আঘাত জনিত কারণ, মেকানিক্যাল সমস্যা, বিভিন্ন প্রকার প্রদাহ জনিত কারণ ও অন্যান্য নানাবিধ কারণে হাঁটু ব্যথা হয়ে থাকে। 

কারণ সমূহঃ

আঘাত জনিত

১. হাঁটুতে আঘাতের কারণে এর লিগামেন্ট বা মাংসপেশী আংশিক ছিঁড়ে যাওয়া (নী স্প্রেইন/স্ট্রেইন)

২. লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়া- হাঁটুর বাহিরের দিকে দুই পাশে মিডিয়াল কোলেটারেল লিগামেন্ট (এমসিএল) এবং লেটারেল কোলেটালে লিগামেন্ট (এলসিএল) এবং হাঁটুর ভিতরে এন্টেরিয়র ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট (এসিএল) এবং পস্টেরিয়র ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট (পিসিএল) বিদ্যমান। হাঁটুতে আঘাত জনিত কোন কারণ অথবা খেলাধুলার সময় হাঁটু মচকানোর ফলে এসব লিগামেন্ট আংশিক বা পুরোপুরি ছিঁড়ে যেতে পারে। ফলে হাঁটুতে ব্যথা এবং হাঁটু ফুলে যায়।  

৩. মেনিসকাস ইনজুরি - হাঁটুর ভিতর দুই দিকে রাবারের মত স্থিতিস্থাপক দুইটি বস্তু থাকে। এদের নাম মেনিসকাস। ইহা তরুণাস্থি দিয়ে তৈরি এবং চলাফেরার সময় হাঁটুতে কুশন হিসাবে কাজ করে। আঘাত জনিত বা ক্ষয় জনিত কারণে এই মেনিসকাস ইনজুরি হয়ে থাকে। ফলে হাঁটুতে ব্যথা হয় এবং হাঁটু ফুলে যায়। 

৪. বারসাইটিস - হাঁটুর চারপাশে অনেক বারসা থাকে। বারসা হলো এক ধরনের থলে যার ভিতর তরল জাতীয় পদার্থ থাকে। এই বারসা হাঁটুর চারিদিকের টেন্ডনের চলাফেরা মসৃণ রাখে। বার বার ঘর্ষণের ফলে প্রদাহ জনিত কারণে এই বারসা ফুলে যায় এবং হাঁটুতে ব্যথা হয়। 

৫. পেটেলার টেন্ডনাইটিস - হাঁটুর বাটির নিচের প্রান্ত থেকে পেটেলার টেন্ডন সিন বোনকে সংযুক্ত করে। এই টেন্ডনের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে প্রদাহ জনিত কারণে পেটেলার টেন্ডনাইটিস হয়ে থাকে। ফলে হাঁটুতে ব্যথা হয়। ইহাকে জাম্পার নী বলা হয়। 

মেকানিকেল সমস্যা 

১ লোজ বডি - আঘাত বা ক্ষয়জনিত কারণে হাঁটুর হাড় বা তরুণাস্থির কোন কোন অংশ ভেঙ্গে যায় এবং এই ভাঙ্গা অংশ জোড়ার ভিতর থেকে যায়। এই ভাঙ্গা অংশকে লোজ বডি বলে। এই লোজ বডি হাঁটু ব্যথার কারণ এবং হাঁটু নড়াচড়াতে বাঁধা দিয়ে থাকে। 

২. ইলিওটিবিয়াল ব্যান্ড সিনড্রোম - এই লিগামেন্ট কোমরের হাড়ের বাহিরের অংশ থেকে সিন বোন এর বাহিরের অংশের সংযুক্ত থাকে। অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে এই লিগামেন্ট সংকুচিত বা টাইট হয়ে যায়। যার ফলে চলাফেরার সময় ইহা উরুর হাড়ের বাইরের অংশের দিকে ঘষা খায় এবং ব্যথা হয়। ইহা সাধারণতঃ এথলেটদের হয়ে থাকে। 

৩. হাঁটুর বাটি সরে যাওয়া - জন্মগতভাবে বা আঘাত জনিত কারণে হাঁটুর বাটি সরে গেলে হাঁটু ব্যথা হয়ে থাকে। 

৪. রেফারড পেইন - একই স্নায়ুর তাড়নার কারণে উরুসন্ধি (হিপ) বা গোড়ালির ব্যথার কারণে  হাঁটু ব্যথা হয়ে থাকে। 

প্রদাহ জনিত কারণ

১. অস্টিওআর্থ্রাইটিস - ইহা হাঁটুর অস্থি বা তরুণাস্থির ক্ষয় ও বৃদ্ধি জনিত একটি রোগ। সাধারণতঃ বৃদ্ধ বয়সে এই রোগ হয়ে থাকে। এর ফলে হাঁটুতে ব্যথা হয় এবং চলাফেলার সময় এই ব্যথা বেড়ে যায়। 

২. রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিস - ইহাও প্রদাহ জনিত একটি রোগ। ইহাতে হাঁটু ফুলে যায় এবং ব্যথা হয়। 

৩. গাউট - ইহাও হাঁটুতে প্রদাহের ফলে হয়ে থাকে। এই রোগে হাঁটুতে ইউরিক এসিড জাতীয় ক্রিস্টাল তৈরি হয় এবং ব্যথা হয়। 

৪. সিউডো গাউট - ইহাতে হাঁটুতে ক্যালসিয়াম জাতীয় ক্রিস্টাল তৈরি হয়। 


অস্টিওপোরোসিস
ইহা হাঁটুর ক্ষয়জনিত একটি রোগ। ইহাতে হাড়ের ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে যায় এবং হাড় ছিদ্রযুক্ত হয়। ইহাও সাধারণতঃ বৃদ্ধ বয়সে হয়ে থাকে। 

ইনফেকশন/সেপটিক 
বিভিন্ন প্রকার ইনফেকশন যেমন:  সেপটিক, যক্ষ্মা এবং যৌনবাহিত কিছু রোগ (সিফিলিস, গনোরিয়া) এর কারণে হাঁটু ফুলে যায় এবং ব্যথা হয়।

অন্যান্য কারণঃ 
কনড্রোমেলেসিয়া পেটেলি : হাঁটুর বাটির পিছনের পৃষ্ঠের তরুণাস্থির ক্ষয়জনিত কারনে হাটুতে ব্যথা হয়। ইহা সাধারণত কিশোর বয়সে হয়ে থাকে।

ওসগুড স্লাটার ডিজিস : হাঁটুর সামান্য নিচে সিন বোনের সামনের অংশে হাঁড়ের একটি উঁচু অংশ থাকে যেখানে টেন্ডন যুক্ত থাকে। এই টেন্ডনের ট্রাকশন ইনজুরির জন্য হাঁড়ের উঁচু অংশ আরও বেশি উঁচু হয় এবং হাঁটুতে ব্যথা হয়। 

উপসর্গ:  

১. হাঁটুতে ব্যথা হওয়া। 

২. চলাফেরার সময় হাঁটুর ব্যথা বেড়ে যাওয়া। 

৩. হাঁটু ফুলে যাওয়া 

৪. হাঁটুতে পানি আসা। 

৫. হাঁটু ব্যথার জন্য হিপ এবং গোড়ালিতে ব্যথা হওয়া।

পরীক্ষা নিরীক্ষা :

১. রক্তের কিছু রুটিন পরীক্ষা। 

২. প্রসাব পরীক্ষা

৩. ব্লাড সুগার,ইউরিক এসিড, আর.এ. ফ্যাক্টর।

৪. ভিডিআরএল

৫. এম.টি.

হাঁটুর

১. এক্স-রে

২. সিটি স্ক্যান

৩. এম. আর. আই.

৪. আর্থোস্কপি 

চিকিৎসা 

প্রতিরোধ মূলকঃ 

১. বয়স হলে এক আধটু হাঁটু ব্যথা সবারই হয়ে থাকে। তবে এমন ব্যথায় যারা ভুগছেন তাদের বিশেষ কিছু ব্যায়াম করলে উপকার হয়ে থাকে। 

২. হাঁটুর নিচে একটি ভাঁজ করা তোয়ালে বা কুশন রেখে পায়ের পাতা টান টান করে শুয়ে থাকুন ১০ সেকেন্ডের জন্য। এরপর একই অবস্থান থেকে পায়ের পাতা স্বাভাবিক রেখে বিশ্রাম নিন। এই পদ্ধতিতে ৫-১০ বার ব্যায়াম করুন। দিনে ২-৩ বার এই ব্যায়াম করা যেতে পারে। একে কোয়াডরিসেপস এক্সারসাইজ বলে।  

৩. শরীরে ওজন কমানো। 

৪. ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন করা। 

সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা

আঘাতজনিত কারণে হাঁটু ব্যথা এবং ফুলে গেলে

১. পরিমিত বিশ্রাম নেওয়া। 

২. হাঁটুতে বরফের প্যাঁক দিয়ে স্যাঁক দেওয়া। 

৩. হাঁটুতে ইলাস্টিক কমপ্রেসন বা ক্রেপ ব্যান্ডেজ বা নী ক্যাপ ব্যবহার করা।

৪. শোয়ার সময় পায়ের নিচে বালিশ দিয়ে হাঁটু উঁচু করে রাখা। 

৫. এতে হাঁটুর ব্যথা ও ফুলা কমে যায়। 

হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেলে 

১. মিডিয়াল কোলেটারেল লিগামেন্ট (এমসিএল) এবং লেটারেল কোলেটালে লিগামেন্ট (এলসিএল) ছিঁড়ে গেলে পায়ে প্লাষ্টার করে ৩-৪ সপ্তাহ রাখা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপারেশন লাগতে পারে। 

২. এন্টেরিয়র ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট (এসিএল) এবং পস্টেরিয়র ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট (পিসিএল) ছিঁড়ে গেলে আর্থোস্কপির সাহায্যে ছেঁড়া লিগামেন্ট রিকনষ্ট্রাকশন (উরুর মাংস ও টেন্ডন নিয়ে নতুন করে তৈরি) করা। 

৩. মেনিসকাস ছিঁড়ে গেলে আর্থোস্কপির সাহায্যে মেনিসকাস মেরামত (রিপেয়ার) করা বা মেনিসকাস ট্রিমিং করা।
বারসাইটিস এর ক্ষেত্রে 

৪. বারসাতে যাতে আঘাত না লাগে সেদিকে লক্ষ্য রাখা।

৫. সিরিঞ্জ দিয়ে বারসার তরল বের করা।

৬. বারসার ভিতরে ইনজেকশন স্টেরয়েড দেয়া যেতে পারে। 
পেটেলার টেনডিনাইটিস হলে 

৭. পরিমিত বিশ্রাম নেওয়ার পাশাপাশি ঘঝঅওউ জাতীয় ঔষধ সেবন করা। 
মেকানিক্যাল সমস্যার ক্ষেত্রে 

৮. লোজ বডি - হাঁটু নড়াচড়া বাধা প্রাপ্ত (লকিং) না হলে সাধারণতঃ কিছু করা লাগে না। তবে হাঁটু আটকিয়ে গেলে (লকিং) অপারেশন করে লোজ বডি বের করা। 

৯. হাঁটুর বাটি সরে গেলে - বাটি পূর্বের সঠিক জায়গায় বসানোর পর পায়ে প্লাষ্টার করে ৩-৪ সপ্তাহ রাখা। কোন কোন ক্ষেত্রে অপারেশন লাগতে পারে। 
ইনফেকশন এর ক্ষেত্রে 

১০. পরিমিত বিশ্রামের পাশাপাশি সেনসেটিভ এন্টিবায়োটিক সেবন করা। 

প্রদাহ জনিত কারণ

অস্টিওআর্থ্রাইটিস 

১. বিশ্রাম ও ঘঝঅওউ এর পাশাপাশি ক্যালসিয়াম, গ্লুকোজঅ্যামাইন  ও কনড্রয়টিন সালফেট জাতীয় ঔষধ সেবন করা। অনেক সময় হাঁটুতে ইনজেকশন হাইয়ালোরোনিক এসিড দেয়া যেতে পারে। ইহা হাঁটুর ফুলা ও ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। 

২. অনেক সময় আর্থোস্কপির সাহায্যে হাঁটু সেভিং করা (অস্টিওফাইট রিমোভ করা) 

৩. প্রদাহ জনিত অন্যান্য কারণ  (যেমন: গাউট, সিউডোগাউট, রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিস) এর মূল কারণ নির্ণয় করে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করা উচিত।  

অস্টিওপোরোসিস 

১. পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধ খাবার যেমন: হাঁড়সহ ছোট মাছ, দুধ, ডিম খাওয়া।

২. সঠিক মাত্রায় ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’ জাতীয় ঔষধ যেমন: খধনপধষ উ  সেবন করা যেতে পারে। 

৩. বয়স্ক পুরুষ বা নারী এবং মেনোপোজ পরবর্তী মহিলাদের ক্ষেত্রে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’ এর পাশাপাশি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হাঁড় ক্ষয় প্রতিরোধকারী ঔষধ যেমন: বিসফসফোনেট, এলেনড্রোনিক এসিড, ইবানড্রোনিক এসিড, জোলেনড্রোনিক এসিড জাতীয় ঔষধ গ্রহণ করা যেতে পারে।    

আর/এস 

Leave a Comment