বয়ঃসন্ধিকাল ও কিশোরী মনের দ্বন্দ্ব

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক:
  • ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৯

‘আমি ছিলাম ছাতে, তারায় ভরা চৈত্র মাসের রাতে। হঠাৎ মেয়ের কান্না শুনে উঠে দেখতে গেলেম ছুটে। সিঁড়ির মধ্যে যেতে যেতে প্রদীপটা তার নিবে গেছে বাতাসেতে। শুধাই তারে, “কী হয়েছে, বামী।” সে কেঁদে কয় নিচে থেকে, “হারিয়ে গেছি আমি।”

মা-বাবার সঙ্গে কিশোরী মেয়ের সম্পর্কটা যেন কবিতার এ লাইনগুলোর মতোই হয়। মেয়ে স্বাধীনতা চায়, কিন্তু কঠিন পথচলায় পিছলে পড়লেই তার হাতটা ধরতে হয়। এ সম্পর্কের রসায়নটা যেন বেশ জটিল আর বৈচিত্র্যময়। পড়ালেখা, বন্ধু নির্বাচন, দৈনন্দিন জীবনযাপন, হাত খরচ, জীবনের লক্ষ্য নির্বাচন—নানা বিষয়ে কিশোরী মেয়ের সঙ্গে মতবিরোধ তৈরি হয় বাবা–মায়ের। শারীরিক পরিবর্তনে কিশোরী মনে তৈরি হয় টানাপোড়েন। কোনো কোনো সময় মা-বাবা হন বন্ধুর মতো, আবার কোনো কোনো সময় বিশাল এক দূরত্ব তৈরি হয় এই সম্পর্কের মধ্যে।

কৈশোর প্রান্তে: ৮-১১ বছর পর্যন্ত মেয়েশিশুরা সাধারণত সমবয়সী ছেলেদের তুলনায় চঞ্চল আর নির্ভীক হয়। তবে ১২ বছরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে চপলতার মাত্রা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এ সময় মেয়েটির মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তন হয়। বিভিন্ন বিষয়ে খুব সহজেই অভিমান তৈরি হয়। অভিভাবকেরা প্রায়ই বলেন, ‘তুমি বড় হয়ে গেছ, এ কাজ কেন করছ?’ আবার এ–ও বলেন, ‘তুমি এখনো ছোট, এটা তোমার কাজ না’—এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব কিশোরীর মনে সে বড় না ছোট, এমন ‘আত্মপরিচয়ের সংকট’ তৈরি করে।

হঠাৎ পরিবর্তন: সদ্য তেরোতে পা দিয়েছে চারু (ছদ্মনাম)। প্রতিদিনই স্কুল থেকে মন খারাপ করে বাসায় ফেরে। এক সহপাঠী তাকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অপমান করে। অসম্ভব রাগ হলেও কিছু বলতে পারে না চারু। একসময় মাকে খুলে বলে। প্রথম প্রথম মা তাকে বোঝায়, ‘একসঙ্গে পড়তে গেলে এমনটা হয়, দরকার হলে মেয়েটির সঙ্গ এড়িয়ে চলো।’ পরে কিছুটা তিরস্কার করে বলেন, ‘তুমিই কারও সঙ্গে মিশতে পারো না, বন্ধু বানাতে পারো না।’ একরাশ অভিমান জড়ো হয় চারুর মনে।

চারুর মতো কিশোরীরা অনেক বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, বয়ঃসন্ধিকালে মস্তিষ্কে চলে ছোট থেকে বড় হওয়ার ভাঙা-গড়া। মনোদৈহিক পরিবর্তন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকায় এ সময় ছোট ছোট বিষয়ে তারা সহজে রেগে যায়। মান–অপমান বোধ তীব্র হয়। এ সময় কিশোরীর ‘মাসিক বা পিরিয়ড’ শুরু হয়। এটি জীবনের অপরিহার্য বিষয় হলেও এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সহজ হয় না কিশোরীর জন্য।

বুঝতে ও বোঝাতে হবে: কথা হলো কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাহমিনা আহমেদের ১৩ বছর বয়সী একজন মেয়ে আছে। তিনি জানান, মেয়ের পরিবর্তনটা খুব সহজেই বুঝতে পারেন তিনি। কেমন যেন একটু গুটিয়ে যাওয়া স্বভাব। ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকতে পছন্দ করে। খেলাধুলা কমিয়ে দিয়েছে। কোনো ঘটনায় খুব দ্রুতই প্রতিক্রিয়া দেখায়। পড়ালেখা নিয়ে খুব বেশি চাপ নেয়। মায়ের থেকে বাবার সঙ্গে বরং বেশি গল্প করে সে। এমনকি মেয়ের অনেক বিষয় তিনি স্কুলে মেয়ের বান্ধবীদের কাছ থেকে জানেন।

তাহমিনা আহমেদ বলেন, ‘ওকে বোঝার চেষ্টা করি। রাগ করলে কিছুক্ষণ আমিও চুপ করে থাকি। ওকে ভুলটা বোঝার সময় দিই। পিরিয়ড নিয়ে এক বছর আগে থেকেই বুঝিয়েছি। ওর ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে দিতাম। ও খুব সহজভাবেই নেয়। ওর বাবা স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে ওর ঘরে রেখে আসে, ব্যাপারটা ও খুব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে।’

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মাসুদ রহমান বলেন, মেয়ে সুহার পাঁচ বছর বয়সে তাঁর স্ত্রী মারা যান। এখন মেয়ের বয়স ১৪। একাই লালনপালন করেছেন মেয়েকে। মেয়ের সব ইচ্ছা–অনিচ্ছার দিকে নজর রাখেন তিনি। এমনকি সহজভাবেই মেয়ের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দেন তিনি। তারপরও যেন একধরনের বিষণ্নতা দেখতে পান মেয়ের মধ্যে। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময় বুঝি মেয়ের মন খারাপ, বয়সটাই এমন। আমি একাই বাবা-মা দুজনের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করি।’

নিজের কৈশোরের কথা জানালেন অভিভাবক রাহিমা বেগম। বললেন, ‘আমার যখন প্রথম পিরিয়ড হয়, তখন আমি এ ব্যাপারে তেমন জানতাম না। এমনকি মা–ও বলে দেননি যে একটা সময় আমার এমন হবে। তাই হঠাৎ নিজের এমন পরিস্থিতিতে আমি ভড়কে যাই। পরে মা বুঝিয়ে দেন।’

মায়ের ভূমিকাই বেশি: বয়ঃসন্ধিকালে মায়ের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ঢাকার বারডেম জেনারেল হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক ডা. শামসাদ জাহান। তিনি বলেন, কিশোরী মেয়ের সঙ্গে মায়ের সম্পর্কটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বান্ধবীদের কাছ থেকে মেয়েরা হয়তো শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে পারে, তবে সে–ও তো তখন বাচ্চা। মাসিকের সময় ব্যথা হতে পারে। মাসিকের আগে আগে মেজাজ খিটখিটে হয়। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি তাকে যত্ন করে শেখাতে হবে। লজ্জা বা সংকোচ অনেক সমস্যার সৃষ্টি করে। এ সময় মেয়েকে প্রয়োজনীয় পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার দেওয়া উচিত, যা তার মানসিক বিকাশে সহায়তা করবে।

একই মত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসক লুবনা ইয়াসমিনের। তিনি বললেন, কিশোরী যদি না জানে তার কী পরিবর্তন হবে, তাহলে বিষয়টা তার জন্য বেশ ভীতিকর হয়। মায়েদের এ বিষয়ে মেয়েদের আগে থেকেই জানাতে হবে। কীভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করবে, তা দেখিয়ে দিতে হবে। কতক্ষণ এটা ব্যবহার করা যাবে, এ বিষয়ে জানাতে হবে। প্রথম পিরিয়ডের পর অনেক মা মেয়েকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসেন, যা বেশ ইতিবাচক পদক্ষেপ।

কিশোরীর এই শারীরিক পরিবর্তন থেকেই মানসিক সমস্যার শুরু, এটি বুঝতে হবে। এ সময় হরমোনের পরিবর্তন মেয়েটিকে অনেক আবেগপ্রবণ করে দেয়। সব ধরনের অনুভূতির প্রকাশই তীব্র হয়। মেয়ের ওপর রাগ করেন অনেক বাবা-মা। মেয়ের মধ্যেও জমে অভিমান।

অল্পতেই জমে অভিমান: কথা হয় কয়েকজন কিশোরীর সঙ্গে। ১৪ বছরের ঐশী বলে, ‘মা–বাবা আমাকে একেবারেই বুঝতে চান না। ছোট বোনের সঙ্গে ঝগড়া হলে সব সময় আমাকেই দোষী করা হয়। বারবার এক কথা বলেন, “ও তো ছোট, তুমি এমন করলে কেন?” অথচ দেখা যায়, আমি দোষটা করিনি। পরীক্ষায় খারাপ ফল করলে আমার কষ্ট হয়, অথচ বকা খেতে হয়।’ অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মাইশা বলে, ‘বাবা এখনো আমার ওপর আস্থা পান না। খুব নজরদারি করেন। এমন হয়েছে, বাবার ফোন নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলেছি, বাবা আবার ওই নম্বরে ফোন করে দেখেন কার সঙ্গে কথা বলেছি। এতে খুবই অপমানিত বোধ করি। আম্মুকে বললে আম্মু কখনো আমার পক্ষে কথা বলেন না। খালি বলেন বাবা তার ভালোর জন্য এটা করেছেন।’

বড় বোনের সঙ্গে তুলনা শুনতে শুনতে বিরক্ত সিফাত। বড় বোনের সবই ভালো ওর কিছু ভালো না। অনেক ভালো ছবি আঁকে ও, অথচ সব সময় কেবল ওর বোনের কাজেরই প্রশংসা করা হয়। এটা অসম্ভব কষ্ট দেয় তাকে। তার মায়ের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে তার বোনকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না।

পিরিয়ডের বিষয়ে আগে থেকে জানত না ১৫ বছরের পিয়া। সে বলে, ‘এটা নিয়ে আমার খুবই খারাপ লেগেছিল যে কেউ আমাকে কিছু জানায়নি। এমনকি আমার বড় বোনও না। অদ্ভুত একটা খারাপ লাগা কাজ করে তখন।’

খুব ছোট ছোট বিষয় কিশোরী মনে গভীর ক্ষত তৈরি করে। ছেলেবন্ধুর বিষয়ে অনেক সময় বাবা–মা তাদের বিশ্বাস করেন না। মনে করেন, ভুল মানুষকে বন্ধু বানাচ্ছে। এই অনাস্থা তাদের মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি করে। আবার পিরিয়ড নিয়ে লুকোছাপায় তারা ভেতরে-ভেতরে নিজেদের গুটিয়ে ফেলে।

আস্থার সম্পর্ক: গত বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে মানসিক রোগের প্রকোপ ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। আর ১৮ বছরের নিচে শিশু-কিশোরদের মধ্যে এর প্রকোপ ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ শিশু-কিশোররাই তুলনামূলকভাবে মানসিক সমস্যায় বেশি আক্রান্ত।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানজির আহম্মদ বললেন, কিশোর বয়স মানেই হলো বাচ্চাও না, বড়ও না। ছোট থেকে বড়তে পরিণত হওয়ার সময়। এ সময় বাবা–মা ভয় পান কিশোরীরা ভুল করবে। এই আশঙ্কায় কড়াকড়ি আরোপ করেন তাঁরা, যা হিতে বিপরীত হয়। একটা বিদ্রোহী মনোভাব গড়ে ওঠে। অনেক সময় দেখা যায়, ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে খেলছে এমন ছেলেবন্ধুর সঙ্গে আর মিশতে দেওয়া হয় না। দেখা যায়, বাবা–মা মুঠোফোন কিনে দিচ্ছেন, আবার সেটা বেশি সময় ব্যবহার করলে মা–বাবাই বকছেন। বাবা-মা আর কিশোরীর মূল্যবোধের মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়, যা কিশোরীর মনের ওপর চাপ তৈরি করে। সে স্বাধীন মানুষ হতে চায়, বাবা–মাকে তার স্বাধীন জীবনের পথে অন্তরায় মনে করে। এ থেকে ঝামেলার সৃষ্টি হয়।

কিশোর বয়সী মেয়েদের ওপর বাবা–মাকে আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। এর বিকল্প নেই। কোনো ঘটনা ঘটলে, কোনো ভুল করলে তাকে সতর্কতার সঙ্গে বোঝাতে হবে। বকাঝকা বা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে তাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া যাবে না। ছেলে হোক বা মেয়ে, বন্ধু বাছাইয়ে একটা সঠিক নির্দেশনা দিতে হবে।

মাসিক হওয়ার পর হঠাৎই মেয়েকে খেলাধুলা, বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দেন বাবা–মা। বিষয়টি কিশোরী মনে হতাশা তৈরি করে, যা ক্ষতিকর। সবশেষে বলতে হবে, সন্তান পালনের ধাঁচ পাল্টাতে হবে। সন্তানকে বুঝতে হবে। সন্তান যেন তার সমস্যায় বন্ধুর মতো পায় মা–বাবাকে।

টি/আ

Leave a Comment