শিশুর মুখে মায়ের ভাষা

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক:
  • ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৯

‘গোল গোল ধ্বনিগুলো এঁকেবেঁকে তেরছা তীর্যক আকার নিচ্ছে। উচ্চারণ প্রক্রিয়ার মধ্যে মাত্রার পর মাত্রা সংযোজিত হচ্ছে। শিশুর অর্থবোধক অস্পষ্ট বাক প্রয়াসের মতো কি একটা শব্দ হয়ে বেরিয়ে আসার জন্য প্রবল সংগ্রাম করছে...। গোটা বাংলাদেশের শিরা-উপশিরায় এক প্রসব বেদনা ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষের বুকফাটা চিৎকারে ধ্বণিত হচ্ছে নবজন্মের আকুতি।...আচানক বোবা বৌ জানলা সমান লাফিয়ে ‘বাঙলা’ অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করল।’ —ওঙ্কার: আহমেদ ছফা।

এভাবেই অস্ফুট ধ্বনি থেকে অর্থবোধক শব্দ হয়ে শিশুর মুখে ভাষা ফোটে। শিশুর বাক্‌যন্ত্র যদি স্বাভাবিক থাকে, সে যদি জন্মগতভাবে শ্রবণপ্রতিবন্ধী না হয় বা শিশুর মধ্যে যদি কোনো স্নায়ুবিকাশগত সমস্যা না থাকে, তবে একজন স্বাভাবিক শিশুর ভাষার বিকাশ ছয় মাস বয়স থেকেই শুরু হয়। হয়তো ব্যাকরণের নিয়ম মেনে বাক্য বলতে পারে না কিন্তু দুই বছর বয়সের মধ্যেই বেশির ভাগ শিশু দুটো শব্দ মিলিয়ে নিজের মনের ভাব, আবেগ বা চাহিদা প্রকাশ করতে পারে।

ভাষা শিখতে বিলম্ব হলে: নানাভাবে ও নানা কারণে শিশুর ভাষা শিখতে দেরি হতে পারে। এ কারণগুলো হলো, শিশু যদি জন্মগতভাবে বাক্‌ বা শ্রবণপ্রতিবন্ধী হয়, শিশুর যদি স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যা (অটিজম, এডিএইচডি, যোগাযোগ–বৈকল্য বা কমিউনিকেশন ডিজ–অর্ডার ইত্যাদি) থাকে, শিশু যদি একা একা বেড়ে ওঠে। এসবে তার ভাষা শিখতে জটিলতা হতে পারে। প্রথমে সে অস্ফুট, অর্থহীন শব্দ উচ্চারণ করে, এরপর সেখানে মাত্রা সংযোজিত হয়। অর্থবোধক হয়ে সে আশপাশের মানুষ আর প্রকৃতির সঙ্গে নিজের যোগাযোগ স্থাপন করে।

জটিলতা হচ্ছে কি না, তা বোঝার জন্য মা-বাবারা যেসব বিষয়ে লক্ষ রাখবেন—

• শিশু ছয় মাস বয়সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসতে পারে কি না

• সুরেলা গান কবিতা, উচ্চ স্বরের শব্দের দিকে শিশুর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া থাকতে হবে

• এক বছর বয়সে আধো আধো বোল উচ্চারণ করতে পারতে হবে

• আঠারো মাস বয়সের মধ্যে অন্তত একটি অর্থবোধক শব্দ (মা, বাবা, বল ইত্যাদি) বলতে পারে কি না

• দুই বছর বয়সের মধ্যে দুই বা ততোধিক শব্দ মিলিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে (যেমন: মা ভাত, বাবা বল ইত্যাদি)

• তিন বছর বয়সের মধ্যে পরিপূর্ণ বাক্য গঠন করে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে

• তিন বছর বয়সী শিশু মা-বাবা বা অপরের নির্দেশনা বুঝতে পারে কি না

• শব্দের উচ্চারণ স্পষ্ট হচ্ছে কি না, শব্দ জড়িয়ে যাচ্ছে কি না, বা বাক্যের মধ্য থেকে শব্দ বাদ পড়ে যাচ্ছে কি না।

এই বিষয়গুলোর ব্যত্যয় হলে ধরে নিতে হবে যে কোনো না–কোনো কারণে শিশুর ভাষা শিখতে বিলম্ব হচ্ছে। মা–বাবাকে শুরুতেই তৎপর হতে হবে। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে, প্রয়োজনে স্পিচ ও ল্যাংগুয়েজ থেরাপি দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

বাসায় মা-বাবারা যা করতে পারেন, তা হলো—শিশুকে বেশি মানুষের মধ্যে রাখুন ও তার সঙ্গে বেশি বেশি কথা বলুন। তাকে একা থাকতে দেবেন না। ছোট ছোট শব্দ আগে শেখান। মা-বাবা, আশপাশের পরিচিত বস্তু, শরীরের ভিন্ন অঙ্গ, রং, আকার-আকৃতি এবং বিভিন্ন পশু–পাখির নাম শেখান ও সেগুলো দেখান। কোনো শব্দ বিকৃত করে শেখাবেন না, প্রকৃত উচ্চারণটি তাকে শেখান। প্রয়োজনে একই শব্দ বারবার বলুন। ছবির বই, ছবির কার্ড, গুনতে শেখার খেলনা, ইত্যাদি দিয়ে খেলতে শেখান। ছড়াগান, কবিতা, গান শোনাতে পারেন। শিশু প্রশ্ন করায় বিরক্ত হওয়া চলবে না, যুক্তিগ্রাহ্য জবাব দেওয়ার চেষ্টা করুন।

যেন সক্রিয় থাকে চারপাশ: ‘আয় যেখানে ক্ষ্যাপার গানে/ নাইকো মানে নাইকো সুর/ আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায়/ মন ভেসে যায় কোন্ সুদূর৷’ —সুকুমার রায়

 শিশুর কিন্তু ভাষা আর যোগাযোগ শেখার ক্ষেত্রে চারপাশের পরিবেশের ভূমিকা অনেক। ওঙ্কার-এ আহমেদ ছফা চিত্রিত করেছেন যে চারদিকের মিছিল, মনের আবেগ সবকিছুর প্রভাবেই কিন্তু বাকহীন নারীর কণ্ঠস্বর চিরে উচ্চারিত হয় তার প্রথম শব্দমালা! তেমন করে শিশুর সঙ্গে ভাবের আদান–প্রদান যত করা যাবে, তার মনে যোগাযোগ স্পৃহা যত জাগিয়ে তোলা যাবে ততই তার ভাষা আর যোগাযোগের দক্ষতা বাড়বে।

শিশুর সঙ্গে যা করা উচিত:

• শিশুর মনের ভাব বুঝে তার আবেগে সাড়া দিতে হবে। যেমন শিশু হাসিকান্নার সঙ্গে মা-বাবা দেহভঙ্গি, মুখের ভাব, মিলিয়ে সাড়া দেবেন।

• শিশু পরিপূর্ণভাবে ভাষা শেখার আগেই তাকে সুরেলা গান, ছবির বই, রঙিন খেলনা, ঘূর্ণমান খেলনা ইত্যাদি দিন। এগুলো তার সংবেদনশীলতাকে পরিশীলিত করবে। ভাষা আর যোগাযোগের দক্ষতা বাড়াবে।

• একটা ভুল ধারণা রয়েছে যে ‘ননসেন্স রাইম’ জাতীয় কিছু শিশুকে শেখানো ঠিক নয়। কিন্তু আবোলতাবোল ছড়া বা ননসেন্স রাইম শিশুর মধ্যে সৃষ্টিশীলতা তৈরি করে।

আগে চাই মাতৃভাষার গাঁথুনি:

• টেলিভিশনে একাধিক ভাষার সংমিশ্রণে শিশু অভ্যস্ত হয়ে গেলে ভাষা শিখতে জটিলতা হতে পারে। শুরুতে একটি ভাষার টিভি দেখানো ভালো।

• শিশুকে নিজ ভাষার বর্ণমালা আগে শেখান। অন্য যেকোনো দ্বিতীয় ভাষা শিখতে বাধা নেই। সব শিশুর সক্ষমতা সমান নয়, তাই কেউ একটু তাড়াতাড়ি শিখবে কেউ একটু দেরিতে শিখবে।

• শিশুকে প্রাক্‌ স্কুলে পাঠাতে পারেন। সেখানে ভাষা আর যোগাযোগের পাশাপাশি সামাজিক দক্ষতা বাড়বে।

• শিশুর আশপাশের পরিবেশকে উদ্দীপনামূলক রাখুন, যাতে শিশু চারপাশ থেকে উদ্দীপ্ত বোধ করে।

• শিশুর সঙ্গে সঠিক উচ্চারণে কথা বলুন। যত সম্ভব বিকৃত বা শিশুতোষ (যেমন পানিকে মাম, চামচকে মাতিস ইত্যাদি) বলা থেকে বিরত থাকুন।

• শিশুকে সবার আগে মাতৃভাষায় শিক্ষা দিন, এতে করে তার পরবর্তী সময়ে অন্য ভাষা শেখাও সহজ হবে।


ভাবের প্রকাশটাই আসল: ‘মানুষের ভাষাটুকু অর্থ দিয়ে বদ্ধ চারি ধারে/ ঘুরে মানুষের চতুর্দিকে’।

—কাহিনী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যোগাযোগের অন্যতম বাহন ভাষা। ভাষা উচ্চারিত হতে পারে আবার অনুচ্চারিতও হতে পারে। মূল কথা হচ্ছে সেটি অর্থবহ ও মানুষের বোধ্য হতে হবে। যেটিকে বলে থাকি ইশারা ভাষা।

বিশেষ মানুষদের জন্য ভাষা বোঝা বা ভাষার প্রকাশপদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে, যেমন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইলপদ্ধতি। যারা শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধী তাদের জন্য ইশারা ভাষার মাধ্যমে কার্যকর যোগাযোগের ক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব। যদি বিশেষজ্ঞরা উপদেশ দিয়ে থাকেন যে শিশুর জন্য ইশারা ভাষার প্রয়োজন, তবে অযথা সময়ক্ষেপণ না করে তাকে ইশারা ভাষার প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

প্রত্যেক মানুষ চায় তার আবেগকে প্রকাশ করতে, এটি তার মৌল প্রবৃত্তি। জন্ম নিয়েই শিশু কেঁদে তার অস্তিত্বকে জানান দেয়। পাশাপাশি সে চায় অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে, অন্যের আবেগকে ধারণ করতে। এই আবেগ ধারণ করতে হলে প্রয়োজন ভাষা আর কার্যকর যোগাযোগ। এ জন্য মানুষের অন্তর্নিহিত প্রবৃত্তি থাকে সব সময় নিজেকে ভাষায় প্রকাশ করা, সেটি উচ্চারিত ভাষাই হোক আর ইশারা ভাষায়ই হোক। আর যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে যে মানুষ যত বেশি দক্ষ, তিনি সামাজিকভাবে তত বেশি সাম্যাবস্থায় থাকেন। তাঁর মধ্যে মানসিক চাপ কম থাকে, যেকোনো পরিস্থিতি সামলে নিতে পারেন। তাই মানসিক চাপমুক্ত থেকে, নিজেকে উৎপাদনশীল রাখতে কার্যকর যোগাযোগে দক্ষ হতে হলে ভাষার ব্যবহারে পারদর্শী হতেই হবে।

যখন ভিন দেশে বেড়ে ওঠা: “নানান দেশের নানান ভাষা।/ বিনে স্বদেশীয় ভাষা,/ পুরে কি আশা?/ কত নদী সরোবর কিবা ফল চাতকীর/ ধারাজল বিনা কভু/ ঘুচে কি তৃষা?” —রামনিধি গুপ্ত

 নিজের মায়ের ভাষা শিখতেই হবে। ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম মাত্র। পদ্ধতিগতভাবে শিখতে পারলে তবেই তা কার্যকর হবে। অনেক সময় বিদেশে জন্মগ্রহণকারী শিশুরা সে দেশের ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, পরিবারে মাতৃভাষায় কথা বলতে গিয়ে হোঁচট খায়। বিষয়টি স্বাভাবিক। আশপাশের পরিবেশের প্রণোদনাই কিন্তু ভাষার জন্ম। বিদেশে বেড়ে ওঠা শিশুরা তার পরিবার থেকে যদি প্রণোদনা পায়, পরিবারে যদি দেশীয় ভাষা আর সংস্কৃতির চর্চাটুকু ন্যূনতম হয়, তবে সে পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, তার যোগাযোগ দক্ষতা বাড়বে মাতৃভাষা শিক্ষার মাধ্যমে। ইংরেজি মাধ্যমের কোনো কোনো স্কুলে শিক্ষার্থীদের বাংলার চর্চা নিষিদ্ধ থাকে। কিন্তু আগল দিয়ে ভাষাকে আবদ্ধ করা যায় না। কোনো ভাষার প্রতি বিদ্বেষ তৈরি করে আরেকটি ভাষা রপ্ত করার প্রচেষ্টা নিতান্তই অবৈজ্ঞানিক।

সন্তান দেশে থাকুক বা বিদেশে, বাংলা মাধ্যমেই পড়ুক আর ইংরেজি—তাকে মানবীয় গুণসংবলিত মানুষ হিসেবে দেখতে চাইলে তার জন্য ভাষাকে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। সামাজিক দক্ষ হিসেবে বেড়ে উঠতে হলে খোলা মন নিয়ে ভাষা তাকে শিখতেই হবে, কোনো ভাষাকে শিশুর জন্য নিষিদ্ধ করা চলবে না। ‘অক্ষম অবাধ্য কণ্ঠনালী’ দিয়ে ‘সমস্ত শক্তি জড়ো করে’ বাক্‌যন্ত্রের ওপর হুকুম জারি করে সে একদিন উচ্চারণ করবেই ‘বাঙলা’।

টি/আ

Leave a Comment