সন্তানের কথার গুরুত্ব দিচ্ছেন না, বোঝার চেষ্টা করছেন না?

  • কামরুন নাহার স্মৃতি
  • মার্চ ১৪, ২০১৯

সন্তানের কথার গুরুত্ব দিচ্ছেন না, বোঝার চেষ্টা করছেন না? সবটা ভুলভাল বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন! তাহলে লেখাটি আপনার জন্যই। 

তৃপ্তি বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পা দিয়ে সে কি উল্লাস! নতুন বইয়ে মুখ গুজে ভুলে যায় খাওয়া কিংবা খেলার কথা। নতুন বইয়ে ডুবে থাকে তৃপ্তি প্রায় সবটা সময়। তৃপ্তি পড়াশোনায় বরাবরই ভালো, প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছে সে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে অনেকটা মায়ের ইচ্ছাতেই বাসায় নতুন স্যার আসে। তৃপ্তি মা বাবাকে বারবার বলেছিল, মা একটু দেখে দিলেই সে পারবে তারজন্য বাসায় স্যার আনার কি দরকার! আমি নিজেই পারতাম বলেও লাভ হয়নি। তৃপ্তি পড়াশোনা, খেলাধুলা সবদিকেই বেশ ভালো। কিন্তু বাসায় স্যার এসে পড়াবে শুনলেই তৃপ্তি কেমন যেন চুপসে যায়! পড়ায় ফাঁকিবাজি ভেবে মা বাবা কেউ পাত্তা দেয়নি তৃপ্তির কথায়। 

প্রথম শ্রেণিতে বাড়িতে স্যার পড়াতে এলেও তৃপ্তির কান্নাকাটি আর ভয়ে কয়েকমাসেই স্যারকে ছাড়াতে বাধ্য হয় তৃপ্তির বাবা মা। কিন্তু এবার আর তার কথা শুনবে না খুব স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে তৃপ্তির মা। নতুন স্যার বাসায় পড়াতে আসার পর থেকেই তৃপ্তির চোখে মুখে ভয় আরো থেকে আরো বাড়তে লাগল কিন্তু পাত্তা দিলনা কেউই। বেশ কয়েকবার তৃপ্তি মা'কে বোঝানোর চেষ্টা করেছে স্যার ভালো নয়, স্যার তাকে কাছে ডেকে চুমু দেয় কিংবা কোলে তুলে নেয় তাতে তার অস্বস্তি হয়, ভালো লাগে না। তৃপ্তির মা কথাগুলো কানে না তুলেই হাসতে হাসতে মেয়েকে বোঝায়, স্যার তোমাকে মেয়ের মতো ভালোবাসে তাই আদর করে আর এসব বিষয় নিয়ে আর কখনো যেন ভাবতে কিংবা কাউকে না বলতে শুনি বলে মেয়েকে শাসায় তৃপ্তির মা। তারপর থেকে তৃপ্তি কেমন যেন চুপচাপ হয়ে যায়, সবসময় কেমন যেন একটা ভয়ে ভয়ে থাকে। স্কুলের  পরীক্ষায় প্রতিবার প্রথম হওয়া তৃপ্তির কেমন যেন পড়াশোনার প্রতি অন্যমনস্কতা খুব সহজেই নজরে পড়তে শুরু করেছিল। ক্লাসের সবচেয়ে চঞ্চল মেয়েটা দিনদিন চুপচাপ, শান্ত হয়ে গিয়েছিক। ক্লাস পরীক্ষায়  সবচেয়ে খারাপ নাম্বার পাওয়ার পরও কারো কাছে তৃপ্তির কথা পাত্তা পায়নি বরং হজম করতে হয়েছে মায়ের বকুনি। 

তৃপ্তি এখন সবকিছু বুঝতে শিখেছে, সেদিনের অস্বস্তিটাও বুঝতে শিখেছে। কিন্তু মনে এখনো দাগ কেটে আছে ছোট্টবেলার সেই অস্বস্তি, নিজের মধ্যে দুমড়ে মুচড়ে মরেছে অথচ কাউকে বোঝাতে পারেনি। তৃপ্তি এখন প্রতিবাদ করতে শিখেছে সমস্ত অস্বস্তি আর খারাপ লাগার বিরুদ্ধে। তৃপ্তি খুব স্পষ্টভাবেই জানিয়েছে, সেদিন যদি তার মা তার কথাগুলো ছোট মেয়েটার ভুলভাল ভেবে উড়িয়ে না দিয়ে একটু নজর দিত কিংবা মেয়ের কথা ভেবে যদি সেদিন মেয়ের পাশে দাঁড়াতো তাহলে আজ সেও মা - বাবার গর্বের কারন হতে পারতো। কিন্তু সেদিনের পর থেকে তৃপ্তি বাবা মায়ের কাছে অবাধ্য আর খারাপ সন্তানের একজন। বাবা মাকে বোঝাতে অপারগ তৃপ্তি সেদিন জেদি আর অবাধ্য হতে বাধ্য করেছিল। তৃপ্তি সেদিনের পর থেকে আর স্যারের কাছে পড়তে যায়নি, ঘরের দরজা বন্ধ করে কিংবা চিল্লাচিল্লি - কান্নাকাটি, জেদে বাধ্য করেছিল স্যারকে পড়ানো বাদ দিতে। তৃপ্তির মা যদি মেয়েকে বোঝার চেষ্টা করতো তাহলে হয়তো পালটে যেতে সমস্তটা। 

আমরা সবসময় কেন ছোট ভেবে বাচ্চাদের কথায় গুরুত্ব দিইনা? বড়রা মিথ্যা বললেও বাচ্চারা মিথ্যা বলেনা তবুও কেন অন্য কেউ বাচ্চার চেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা পায়। এভাবেই হয়তো হাজারো তৃপ্তি প্রতিদিন মুখোমুখি হচ্ছে এমন অস্বস্তির, আলোকিত ভবিষ্যৎ প্রতিনিয়ত এভাবেই ঢেকে যাচ্ছে গাঢ় কালো অন্ধকারে। সন্তানের কথার গুরুত্ব দিতে শিখুন, নজর দিন ছোট্ট মেয়েটার দিকে। ছোট্ট মেয়েটা যখন স্পষ্টভাবেই বলে লোকটা ভালো না তখন একবার ভাবুন লোকটা অবশ্যই এমন কিছু করেছে যা ছোট্ট বাচ্চাটার মনে দাগ কেটেছে। সন্তানকে সেই জায়গাটা দিন যেখানে সে নিজের সমস্ত খারাপ লাগা, অস্বস্তি আপনাকে জানাতে পারে। আপনার সন্তানকে আদর করার জন্য আপনি, আপনার পরিবারই যথেষ্ট ; তারজন্য অন্য কারো প্রয়োজন নেই। সন্তানের কথায় গুরুত্ব দিন এবং সন্তানকে বুঝতে শিখুন। আমরা সবাই মিলে সন্তানদের সুস্থ, স্বাভাবিক পরিবেশ দিতে, আলোকিত ভবিষ্যতের সন্ধান দিতে।।

 

Leave a Comment