সন্তান না হওয়ার জটিলতা, আছে চিকিৎসা

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক:
  • মে ২০, ২০১৯

বন্ধ্যত্ব সমস্যায় ভুগছেন এমন দম্পতিদের প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রে স্বামীর আর অর্ধেক ক্ষেত্রে স্ত্রীর সমস্যা থাকে। সমস্যাভেদে চিকিৎসা পদ্ধতিও ভিন্ন। বন্ধ্যত্ব চিকিৎসার একটা পদ্ধতির নাম আইইউআই। এ নিয়ে লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও নারীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল

কোনো দম্পতি যদি এক বছর চেষ্টা করার পরও সন্তান লাভে ব্যর্থ হন, তাহলে তাঁদের বন্ধ্যত্ব সমস্যা আছে বলে ধারণা করা হয়। তথ্য মতে, দেশে প্রায় ১২ শতাংশ দম্পতি বন্ধ্যত্ব সমস্যায় ভুগছে। আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে সন্তানহীন দম্পতিদের এই সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। আশার কথা, বাংলাদেশেও বন্ধ্যত্ব চিকিৎসার আধুনিক পদ্ধতি বিদ্যমান, এর মধ্যে কম খরচে সহজলভ্য একটি চিকিৎসা পদ্ধতি ‘আইইউআই’।

আইইউআই কী? বন্ধ্যত্ব সমস্যায় ল্যাবরেটরিতে স্বামীর বাছাইকৃত ও গুণগত মানসম্পন্ন শুক্রাণু স্ত্রীর গর্ভাশয়ে সরাসরি প্রবেশ করানোর এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতির নাম আইইউআই। এতে শুক্রাণুর পরিভ্রমণ পথ সংক্ষিপ্ত হয়ে ডিম্বাণুর কাছাকাছি প্রতিস্থাপিত হয়। স্বাভাবিক দৈহিক মেলামেশায় যেসব দম্পতি সন্তান লাভে ব্যর্থ হচ্ছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিতে স্ত্রীর গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এটি খুব জটিল পদ্ধতি নয় এবং এতে নারীদের সে রকম কষ্ট হয় না। এই পদ্ধতি প্রয়োগের পরপরই বাসায় চলে যাওয়া যায়।

যাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য: আইইউআই তাদেরই করা হয়, যাদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গর্ভধারণ সম্ভব হয় না। কিছু সুনির্দিষ্ট কারণে আইইউআই করা হয়। যেমন—

- পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যাদের বন্ধ্যত্বের কোনো কারণ পাওয়া যায়নি।

- যেসব নারীর মাসিক অনয়িমিত, ডিম্বাশয় থেকে প্রতি মাসে ডিম্বাণুু আসে না এবং যাদের জরায়ুমুখ সংকুচিত।

- বন্ধ্যত্বের সমস্যা রয়েছে যেসব স্বামীর। যাদের বীর্যরসে শুক্রাণুর সংখ্যা কম, আবার শুক্রাণুর সংখ্যা ঠিক থাকলেও গঠনগত ত্রুটি রয়েছে।

- শুক্রাণুর নড়াচড়া বা গতি কম হওয়ায় যোনিপথ ও জরায়ুর মধ্যে পরিভ্রমণে অক্ষমতা রয়েছে যাদের।

- শুক্রাণু যৌননালিতে না এসে যদি উল্টো পথে মূত্রথলিতে চলে যায়, মূত্রণালি যদি স্বাভাবিক জায়গায় না থাকে।

- স্ত্রী সহবাসে যারা অক্ষম অথবা দূরে থাকার কারণে স্ত্রীর সঙ্গে অনিয়মিত সহবাস যাদের।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা: আইইউআই করার আগে অনেক সময় ডিম্বনালি বা ফেলোপিয়ান টিউবের কার্যক্ষমতা ঠিক আছে কি না তা দেখে নেওয়া হয়। আল্ট্রাসনোগ্রাফি, এক্স-রে বা ল্যাপারোস্কপি পরীক্ষার মাধ্যমে ডিম্বনালি খোলা না বন্ধ তা পরীক্ষা করা হয়। অন্যদিকে রক্তে এএমএইচ নামের এক ধরনের হরমোন পরীক্ষা করা হয়, যা দেখে চিকিৎসক একজন নারীর ডিম্বাশয়ে কী পরিমাণ ডিম্বাণু সংরক্ষিত আছে, সে বিষয়ে ধারণা পান এবং সে অনুযায়ী ওষুধের ধরন ও মাত্রা ঠিক করেন।

বীর্যে কেমন শুক্রাণু থাকা উচিত? সাধারণভাবে ধরে নেওয়া যায় যে প্রতি মিলি বীর্যে যদি পাঁচ মিলিয়ন বা ৫০ লাখ জীবিত, গতিশীল শুক্রাণু থাকে, তাহলে এই পদ্ধতির মাধ্যমে স্ত্রীর গর্ভধারণের সম্ভাবনা থাকে।

প্রক্রিয়া: আইইউআইর সময় নির্ধারণ করা হয় রোগীর ওপর কী ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছে সে অনুযায়ী। নারীদের প্রতি মাসে যেকোনো একটি ডিম্বাশয়ে একটি ডিম্বাণু ফোটে। সেটি সাধারণত মাসিক চক্রের ১৩-১৪তম দিনে হয়ে থাকে। আইইউআই করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো ডিম্বাণু ফোটার সময়টা। মাসিকের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন থেকে সাধারণত ওষুধ প্রয়োগ, আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও রক্তের বিশেষ হরমোন পরীক্ষার মাধ্যমে আইইউআই করার পূর্বপ্রস্তুতি শুরু হয়। আইইউআই করার আগে তিন-চার দিনের জন্য সহবাস বন্ধ রাখতে বলা হয়। এর কমবেশি হলে শুক্রাণুর গুণগত মান নষ্ট হয়।

নিয়ম-কানুন মেনে নির্ধারিত দিনে বীর্য সংগ্রহের জন্য স্বামীকে আইইউআই ক্লিনিকে আসতে বলা হয়। প্রতিটি আইইউআই ক্লিনিকে বীর্য সংগ্রহের জন্য আলাদা নিরিবিলি রুম থাকে। জীবাণুমুক্ত ল্যাবরেটরিতে সংগ্রহ করা বীর্য থেকে বিশেষ ধরনের মেশিনের মাধ্যমে জীবিত, স্বাস্থ্যবান শুক্রাণু পৃথক করে নেওয়া হয়। এরপর এই স্বাস্থ্যবান শুক্রাণু খুব সরু ক্যাথেটার বা নলের মাধ্যমে স্ত্রীর গর্ভাশয়ে প্রবেশ করানো হয়। আইইউআই পদ্ধতি প্রয়োগ করার পরই বাসায় চলে যাওয়া যায়, কোনো বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না। স্বাভাবিক কাজকর্ম বা স্বামী সহবাসেও কোনো বিধি-নিষেধ থাকে না। শুধু বাথটাব বা পুকুরে ডুবে গোসল করতে বারণ করা হয়।

সফলতার হার: বন্ধ্যত্ব চিকিৎসার মধ্যে আইইউআই হলো সবচেয়ে সহজ ও প্রাথমিক ধাপ। কিছু বিষয় যেমন—স্ত্রীর বয়স, কত দিন যাবৎ সন্তানের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে, স্বামীর বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা ও গুণগত মান, কী কারণে করা হচ্ছে ইত্যাদির ওপর এর সফলতার হার নির্ভর করে। তা ছাড়া চিকিৎসকের দক্ষতা, ল্যাব টেকনিশিয়ানের অভিজ্ঞতা, ল্যাবরেটরির মান নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির ওপরও এই পদ্ধতির সফলতা নির্ভরশীল। যেকোনো নারীর জন্য প্রতিবার আইইউআই করার ক্ষেত্রে গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা ১০-১৫ ভাগ। তবে প্রতিবারই সফলতার হার বাড়ে। সাধারণত তিন-চারবার আইইউআই করার পর সফলতার হার বেড়ে ৪০-৫০ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে। এ জন্য চার-পাঁচবার চেষ্টা করা উচিত। এর পরও সফলতা না এলে আইভিএফ বা টেস্টটিউব বেবি পদ্ধতিতে সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

জটিলতা: আইইউআই পদ্ধতিতে বলতে গেলে তেমন কোনো ঝুঁকি বা জটিলতা নেই। তবে কোনো কোনো সময় গর্ভে একের অধিক সন্তান আসতে পারে। কারো কারো তলপেটে সামান্য ব্যথা হতে পারে। তবে অভিজ্ঞ ও দক্ষ চিকিৎসক দ্বারা আইইউআই করানো না হলে পুরো প্রক্রিয়াটি ভেস্তে যেতে পারে।

টি/আ

 

Leave a Comment