আমরা কয়েকজন সুফিয়া কামাল ও বেগম রোকেয়ার জন্য অপেক্ষা করছি!

  • রেজবুল ইসলাম
  • ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৮

বইমেলা মানেই অপেক্ষার একটি মাস। শত শত স্টল। প্রকাশকদের ব্যস্ততা। লেখকদের নতুন বই এর মোড়ক উন্মোচন! ওমেন্সকর্নার এর সাথে কথা হলো নবীন লেখক ওয়াহেদ সবুজের সাথে। কুষ্টিয়া শহরে বেড়ে ওঠা ওয়াহেদ সবুজের স্কুল এবং কলেজজীবন কেটেছে কুষ্টিয়াতেই। পরবর্তীতে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরু করেন। কিন্তু তার মন টেকেনি সেখানে। পরবর্তীতে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই লেখাপড়া শেষ করেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রেজবুল ইসলাম। 

ওমেন্সকর্ণার: কেমন আছেন বলুন ?

ওয়াহেদ সবুজ: ভালো আছি। 

ওমেন্সকর্ণার: প্রথমে জানতে চাইবো, লেখক হতে হবে— এ চিন্তাটা কখন মাথায় এলো?

ওয়াহেদ সবুজ: আমার আসলে ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার বেশ ঝোঁক ছিল৷ তখনকার পড়াশোনা কেবল ধর্মীয় নানান বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল৷ সম্ভবত আমি যখন নবম বা দশম  শ্রেণিতে, তখন হুমায়ূন আহমেদ এর 'এবং হিমু' উপন্যাসটি আমার হাতে আসে৷ ওটাই আমার পড়া প্রথম উপন্যাস৷ ওই বইটিই আমার বই পড়ার জগতে প্রবেশদ্বার বলতে পারেন৷ উপন্যাস বা গল্প লেখার ইচ্ছেটা মূলত তখন থেকেই৷ তবে এর আগে যখন আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি, তখন থেকেই কবিতা লিখতাম৷

ওমেন্স কর্ণার: ছাপার অক্ষরে প্রথম নিজের লেখা কোনটি ছিল? তখনকার অনুভূতিটা বলবেন৷  

ওয়াহেদ সবুজ: যদ্দূর মনে পড়ে, কুষ্টিয়ার স্থানীয় একটি দৈনিক ছিল 'আজকের আলো' নামে; সেখানেই প্রথম আমার কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল৷ আমি তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি৷ সে বয়সের অনুভূতিগুলো তো এমনিতেই বড় বেশি সুন্দর ও গভীর হয়ে থাকে৷ আমার মনে পড়ে, পত্রিকার কপিটা নিয়ে এসে আমি প্রথম আমার প্রাইভেট টিউটর মামুন স্যারকে দেখিয়েছিলাম৷

ওমেন্স কর্ণার: ২০১৮ সালের বইমেলায় প্রকাশিত আপনার লেখা বইটি নিয়ে কিছু বলুন। 

ওয়াহেদ সবুজ: 'পরজীবী তত্ত্ব' নামে আমার লেখা একটি বই এবারের বইমেলায় এসেছে।  বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক নানান গুণগত পটপরিবর্তন ঘটেছে৷ বিশেষত ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান, 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' অজুহাতে মানুষের বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, প্রগতিশীল মানুষদের ওপর হামলা, ব্লগার কিলিং এর মতো ঘটনাগুলোর সাক্ষী হয়েছি আমরা৷ 'পরজীবী তত্ত্ব' মূলত এ সকল সমাজ-বাস্তবতার নিরীখে রচিত একটি উপন্যাস; যার সকল চরিত্রই লেখকের সৃষ্টি, কিন্তু কোনো চরিত্রই শতভাগ কাল্পনিক নয়৷

ওমেন্স কর্ণার: এত এত বিষয় থাকতে লেখার জন্য এ স্পর্শকাতর বিষয়টিই কেন বেছে নিলেন?

ওয়াহেদ সবুজ: দেখুন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে আমাদের সাহিত্য, বিশেষত উপন্যাস একটি একক গণ্ডির মধ্যে ঘোরপাক খাচ্ছে৷ সেই একই মধ্যবিত্তের জীবন, প্রেম-বিরহের আখ্যান৷ কিন্তু, লেখক হিসেবে আমাদের কিছু সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থাকা উচিত বলে আমি মনে করি৷ আমাদের পূর্বসূরি দিকপাল লেখকেরা সে দায়িত্বগুলো পালন করেছেন৷ কিন্তু আমরা সম্ভবত কোনোভাবে ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যাচ্ছি— সচেতনভাবে অথবা অনিচ্ছায়— যেভাবেই হোক না কেন৷ বলতে পারেন, লেখক হিসেবে দায়বদ্ধতার ব্যাপারগুলোকে আমি এড়িয়ে যেতে চাইনি৷

ওমেন্স কর্ণার: গত কয়েক বছরে আমাদের অভিজ্ঞতা তো বেশ তিক্ত। বইমেলায় বই নিষিদ্ধ হওয়া, স্টল বন্ধ করে দেয়া, লেখকদের ওপর হামলা— এ সকল ঘটনার প্রেক্ষিতে 'পরজীবী তত্ত্ব'কে আপনি নিজের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন কি-না?

ওয়াহেদ সবুজ: ঝুঁকিগুলোকে এড়িয়ে চলা তো কোনো কাজের কথা না৷ আমি জানি যে, আমার এ উপন্যাসটির বিষয়বস্তু বেশ স্পর্শকাতর এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণও বটে৷ কিন্তু কাউকে না কাউকে তো ঝুঁকিটা নিতেই হয়; নজরুল ঝুঁকি নিয়েছেন, শরৎচন্দ্র ঝুঁকি নিয়েছেন, হুমায়ূন আজাদ এবং অভিজিৎ রায়েরাও তো নিয়েছেন৷

ওমেন্স কর্ণার: আপনি তো পেশায় একজন শিক্ষক। কোন বিষয়টাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন— শিক্ষকতা না-কি লেখালেখি?

ওয়াহেদ সবুজ: দেখুন, আমি মনেপ্রাণে একজন শিক্ষক৷ লেখালেখিটাকে সে কারণেই ধারণ করছি— এটাও বলতে পারেন৷ কারণ, লেখকেরাও তো এর অর্থে শিক্ষকই৷ বরং বলা যায়, লেখকেরা আরো বৃহৎ অর্থে শিক্ষক৷

ওমেন্স কর্ণার: একেক লেখকের একেক ধরনের পাঠক তৈরি হয়৷ সকল পাঠকের টেস্ট তো এক রকম নয়৷ তো, আপনার এ উপন্যাসটি কোন শ্রেণির পাঠক অধিক গ্রহণ করবে বলে মনে করছেন?

ওয়াহেদ সবুজ: 'পরজীবী তত্ত্ব' মূলত একটি সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার৷ সুতরাং এটি থেকে নিঃসন্দেহে থ্রিলার পাঠকেরাই বেশি সুবিধা পাবেন৷ বইটি সব মিলিয়ে তিনটি পর্বে বিভক্ত; এর প্রথম পর্বে থ্রিলার, দ্বিতীয় পর্ব সাইকোলজিক্যাল বিষয়বস্তু নিয়ে, তৃতীয় পর্বে মনস্তাত্ত্বিক রহস্যের সমাধান৷ অর্থাৎ, যারা মনস্তত্ত্ব ভালোবাসেন, তারাও এটা স্বাচ্ছন্দে গ্রহণ করতে পারবেন৷ সবচেয়ে বড় কথা, উপন্যাসটি প্রধানত তাদের জন্য যারা প্রগতিশীলতার পক্ষে, যারা সকল প্রকার ধর্মান্ধতার বিপক্ষে৷

ওমেন্স কর্ণার: লেখকদের সমাজের প্রতি একটা দায়বদ্ধতার জায়গা থাকে, যেটি আপনি একটু আগেই বললেন। এ দায়িত্বের বিবেচনায় লেখক হিসেবে আপনি সমাজকে কতটুকু দিতে পারবেন বলে মনে করেন?

ওয়াহেদ সবুজ: আমি আগেও বলেছি যে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই লেখালেখিটা করছি, করে যেতে চাই৷ যখন দেখবো লেখালেখির মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রকে কিছু দিতে পারছি না, সেদিন থেকেই লেখা বন্ধ করে দেবো৷

ওমেন্স কর্ণার: লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

ওয়াহেদ সবুজ: যে বিষয়গুলোকে অন্যেরা এড়িয়ে যেতে চান, সে বিষয়গুলো নিয়ে লেখালেখি করে যেতে চাই৷

ওমেন্স কর্ণার: আপনার পরিবার সম্বন্ধে আমাদের কিছু বলুন।

ওয়াহেদ সবুজ: আমরা তিন ভাই, দুই বোন৷ আমি বাদে বাকি সকল ভাইবোন নিজ নিজ সংসার নিয়ে তাদের আলাদা জগতে৷ বাবা-মাকে সাথে নিয়েই এ মুহূর্তে আমার পরিবার৷

ওমেন্স কর্ণার: আপনি জেনে থাকবেন, লেখালেখিসহ সমাজের সকল অঙ্গনে মেয়েরা বিশেষ ভূমিকা পালন করছে? এটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?  

ওয়াহেদ সবুজ: আমি মনে করি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল পর্যায়েই পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরকেও সমানভাবে কাজ করতে হবে৷ আজ থেকে দুই দশক আগে আমাদের দেশে নারীরা যে অবস্থানে ছিল, সে তুলনায় তারা অনেক এগিয়েছে৷ কিন্তু আমার দৃষ্টিতে এটি মোটেও যথেষ্ট নয়৷ বিশেষত সাহিত্যক্ষেত্রে যদি বিবেচনা করি, তাহলে দেখা যাবে আগের তুলনায় নারী লেখকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে; কিন্তু আমরা তো আরো কয়েকজন সুফিয়া কামাল ও বেগম রোকেয়ার জন্য অপেক্ষা করছি৷

ওমেন্স কর্ণার: আপনার পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন৷

ওয়াহেদ সবুজ: পাঠকদের উদ্দেশ্যে এটুকুই বলার— আপনারা প্রচুর পরিমাণে বই কিনুন, পড়ুন৷ বিশেষ করে নতুন লেখকদের বই বেশি বেশি কিনুন৷ আমাদের দিকপাল লেখকদের বেশিরভাগেরই অকালবিদায়ের কারণে সাহিত্যক্ষেত্রে যে বিশাল এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, সেটি তো এই নতুন লেখকদের মধ্যে থেকেই পূরণ হতে হবে৷ তাই যত বেশি নতুনদের বই কিনবেন, আমাদের সাহিত্যের তত বেশি উপকার হবে৷

ওমেন্স কর্ণার: আপনার উপন্যাস এবং আপনার জন্য ওমেন্সকর্ণার এর পক্ষ থেকে রইলো অনেক অনেক শুভকামনা। ধন্যবাদ আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য।

ওয়াহেদ সবুজ: ওমেন্সকর্ণারকেও অনেক ধন্যবাদ।
 

Leave a Comment