মাতৃত্ব যখন কাঠগড়ায়,নয় কি তা সমাজ ও সংস্কারের অন্যায়?

  • রীপা চক্রবর্তী
  • ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৮

নারী-মমতা,আশ্রয় ও শক্তির এক অপূর্ব সৃষ্টিকল্প.নবসত্তার উদ্ভব-আধার, জীবনীশক্তির পালনকর্তা মহান সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ। কত রূপে,বর্ণচ্ছটায় উদ্ভাসিত ও আবর্তিত নারীজীবন! কখনো সে সন্তান হয়ে তার চপলতা ও বালখিল্যে বাৎসল্য রসময় সুখস্মৃতির আভাস পৌছে দিয়ে যায় পিতামাতা ও পরিবারকে।  কখনো স্ত্রী হয়ে একটি সংসার পরম যত্নে ও মমতায়,জাদুর কাঠির স্বর্ণময় ছোয়ায় সাজিয়ে তোলে,আবার কখনো মা রূপে স্নেহ-মায়া-ভালোবাসার এক অটুট বন্ধন ও আস্থার সর্বোচ্চ প্রতীক হিসেবে ছায়াময় বটবৃক্ষের ন্যায় লালন করে চলে যুগযুগান্তরের চিরাচরিত ইতিহাস-ঐতিহ্য,বংশ-পরম্পরায় প্রদান করে চলেন উত্তরাধিকার স্মারকলিপি। 

কিন্তু বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে পুরুষতান্ত্রিকতার জন্যে সবচেয়ে আশ্চর্যের ও সেইসাথে বড়ই কদর্যময় বিষয় হলো 'নারী ও তার মাতৃত্ব' 
 । হয়তো সকলে বলবেন 'কখনোই না,আসলে এইসব বলার ও লেখার মাধ্যমে পুরুষতন্ত্র যে সামাজিক অনুশাসন নিয়ম-নিষ্ঠার সাথে পালন করছে সেই গতানুগতিক ধারা ও  চিন্তাচেতনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তথাকথিত নারীবাদীরা ধ্বংসের নেশায় প্রবৃত্ত হয়েছে। 

‘'কোনকালে এক হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি 
সাহস দিয়েছে,প্রেরণা দিয়েছে বিজয় লক্ষী  নারী'’

সাম্যবাদী কবির এই বচনটির কোনো মাহাত্মই নেই  এই যুগে যেখানে নারী রূপে জন্ম নেয়া,কন্যা সন্তান জন্ম দেয়া ও মাতৃত্ব সমভাবে অপরাধীর কাঠগড়ায়। কেন বকছি এই পাগলের প্রলাপ? হ্যা, আমি পাগলিনী হয়ে যাচ্ছি আমার উপর রক্ষার নামে করা অত্যাচার,ভালোবাসার নামে করা পাশবিকতা ও সংস্কারের নামে দেয়া মৃত্যুযন্ত্রণার তীব্রতায়। 

আমি কোনোভাবেই সুস্থ থাকতে পারছিনা কন্যা সন্তান জন্মদানের প্রতিক্রিয়ায় শশুড়বাড়ির মধ্যযুগীও নির্যাতনের বলী সেই মায়ের বীভৎস চেহারা নিজে অবলোকন করে। রক্ষা করতে পারলাম না ,বাঁচাতে পারলাম না সেই শিশুটিকে যার বাবার পরিচয় গোপন রাখতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছিল ৬ তলার উচ্চতা থেকে.কেন বেঁচে আছি তবে?আমি নিজেও কি এর বাইরে?

কি করে ভুলি ছন্দা (ছদ্মনাম )যখন প্রথম আবিষ্কার করলো নিজের মাঝে নতুন আরেকটি প্রাণের সঞ্চারণ,কি সর্গিক ও অমলিন এক আবেগে মোহময়  হয়ে উঠলো ছোট্ট সাজানো-গুছানো সংসারটাই। কিন্তু ৩ মাসের মাথায় চিরে বৃন্তচ্যুত করে ফেলে দেয়া হলো ওপর সম্ভাবনাময় ফুলের কুঁড়িটিকে.কারণ ওযে মেয়ে ছিল গো।  পুত্র হলে তবু চাকরি শিক্ষা সংসার সব চালিয়ে জীবনধারণ সার্থক হতো.এখানে কে দোষী বলতে পারেন?
ছন্দা ও শাহেদ দুজনেই.(ছদ্মনাম ) । কারণ ওরা যে আধুনিক,একজন তার অস্তিত্ব ও সন্মান রক্ষার দোহাই দিয়েছে তো অন্যজন সেই অন্যায়-অবিচার মাথা পেতে নিয়েছে সংসার টিকিয়ে রাখার লোভে। 

'রিজিয়া ( ছদ্মনাম )আবার এসব কোনোকিছুরই শিকার হয়নি.পঞ্চম শ্রেণী পাশ করে, বি এ পাশ স্বামীর সংসারে ২ কন্যা ও ২ পুত্র। পুত্রদের সুশিক্ষা ও  সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদানে রিজিয়ার ভূমিকা অগ্রগণ্য হলেও কন্যা দুটি তার চোখের বিষ.চেহারা যেমন তেমন হলেও বলে কিনা বিদ্যাশিক্ষা করবে?সমান অধিকার চাই? শহুরে জীবন ও বিদেশী অপসংস্কৃতি যত নষ্টের মুলে,এই বচনে সরব রিজিয়া। 

লেখিকা

ফলাফল খুবই কম বয়সে বড় মেয়ে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে নিজেই বিদায় নিলো,ছোট মেয়ে প্রেমিকের সাথে বাড়ি ছেড়ে পালালেও স্বামীর উচ্চপদস্থ সংযোগের সূত্রে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করে। আগের সব ভুত ঝেটিয়ে আবার পছন্দমতো ঘরে বিয়ে দিয়েছেন। পুত্রবধুগুলো একেকটি যেন শেওড়া গাছের পেত্নী,কুটনামিতে ওস্তাদ। তবু কেউ পারেনি আজো তার সাথে বড়োটি কিছুদিন পর পরই  তার পুত্র কে বাপের বাড়ি থেকে চাহিবা মাত্র টাকা দিয়ে যায়। ছোট টিকে তালাক করিয়ে নাতি টিকে আদালতের সহায়তায় নিজের অধিকারে নিয়েছেন.কোনো পুত্রবধূই তার শিক্ষিত নয়,সংসারের একছত্র অধিকারিণী তিনিই। 

পত্রিকায় শিরোনাম : কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার অপরাধে প্রসূতি কে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন,কেটে দেয়া হয়েছে মাথার চুল,হাসপাতালে তিন দিনের অসহায় শিশু ও নির্যাতিতা বধূ ' --------------- এই সেই বড় পুত্রবধূ যার পুরুষ স্বামী তথাকথিত শিক্ষিত ও শশুরবাড়ি রিজিয়া এর মতো  নষ্ট মানসিকতার অধিকারে। রিজিয়া এর উচ্চপদস্থ স্বামী কি এর বাইরে? তিনিই যে ইন্ধনদাতা তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে?
আরেকটি ঘটনার অবতারণা করছি একটি হিন্দি চলচ্চিত্রের অবলম্বনে। 'থাঙ্কস মা' শিরোনামের সত্য ঘটনা অবলম্বনে চিত্রায়িত এ বায়োস্কোপ টিতে  বর্তমান নষ্ট ও নোংরা হয়ে যাওয়া সমাজবাবস্থা ও মাতৃত্বের চরম অসহায় পরিনাম পরাকাষ্ঠার সাথে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে পুরুষতন্ত্র কিভাবে নারীর দুর্বলতার সুযোগে নারীর সাথে নারীকেই সংঘাতে লিপ্ত করছে, কেড়ে নিচ্ছে মাতৃত্বের চরম অধিকার ও অসহায় সমাজ ব্যবস্থা যা শুধু নারীত্বেরই বিপক্ষে। 

যেখানে কন্যা নিরাপদ নয় পিতার ক্রোড়ে,বহন করে চলছে তারই ঔরষজাত কলঙ্ক শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে, একজন মা ফেলে দিয়ে বা এতিমখানায় দিয়ে দায়মুক্ত হয়  তার সদ্যোজাত পুত্রকে তার পিতার পরিচয় দিতে পারবেনা বলে। ক্ষণিক আনন্দের ফসলকে পারছেনা তারা কেউই মেনে নিতে,যেখানে সন্তান শিক্ষা ও উন্নতির প্রধান অন্তরায়,যেখানে স্ত্রী সর্বদাই নির্যাতিত-নিপীড়িত,সব জেনেও সে পারেনা তারই মতো আরেকটি মেয়ের সর্বনাশ ঠেকাতে যে কিনা গৃহকর্মী,সমাজের ভয়ে ও সংসারের স্বার্থে ছিনিয়ে নেয়া হয় গৃহকর্মী ও গৃহকর্তার অনৈতিক সম্পর্কের চিহ্ন টিকে,ফেলে দেয়া হয় ড্রেনের পাইপে নয়তো ছুঁড়ে ফেলা হয় বহুতল ভবন থেকে....জানিনা কিভাবে বাস্তবতা এত ঘৃণ্য হতে পারে?

এখানেই শেষ নয়। আমি নিজেও একজন কন্যা,স্ত্রী,সন্তানের মা..দেখেছি কিভাবে সংস্কারের নামে পরিবারের অত্যাচারে মানসিক যন্ত্রনা কুরে কুরে খায় একজন সন্তানসম্ভবা মা কে। প্রবাসে যেখানে প্রতিমুহূর্তে নারীর অধিকার রক্ষায় নতুন নতুন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে,তাকে নিজের,সন্তানের ও পরিবারের যত্নে সহায়তা করা হচ্ছে,তার শারীরিক,মানসিক সর্বোপরি আত্মিক উন্নতি সাধনের সকল প্রচেষ্টা করা হচ্ছে,ঠিক তারই উল্টোপিঠে আমাদের ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে নেই নারীশিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ,নেই নারীর সম্ভ্রম রক্ষার নিশ্চয়তা,নেই মাতৃত্বের সম্মান ও মর্যাদা,ধর্ম ও সমাজ যেখানে সকল অধর্ম ও অসামাজিকতার নিয়ামক। নারী কি তবে প্রবাসে নিরাপদ?মাতৃত্ব কি তবে সেথাই যথাযথ? 
না,আশ্চর্য হলেও যুক্তরাষ্ট্রে করা এক সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতি সেকেন্ড এ সেখানে প্রতিদিন গড়ে ৯জন করে নারী ধর্ষিত হন,১২০ টি করে গর্ভপাত ঘটানো হয়,হাজারে ৭০০ জন নারী সহকর্মী দ্বারা কিংবা পরিবার দ্বারা শ্লীলতাহানির শিকার হন। ভারতে করা সমীক্ষা বলে ধর্মের ও নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ,জাত-কুল-সংস্কারের নামে নির্বিচারে শিশুকন্যার ভ্রূণহত্যা চলছে,চলছে নারীপাচার,বহুবিবাহ,চলন্ত বাস এ ধর্ষণের মতো ঘটনা প্রতিনিয়ত। কম বেশি পৃথিবীর প্রতিটি দেশে ও সমাজে চলছে মাতৃত্বের বিরুদ্ধে এক প্রহসন। 

একজন মা হিসেবে আমি শংকিত,বিবেকের তাড়নায় উদ্বেলিত। পারবো কি প্রতিষ্ঠা করে যেতে মাতৃত্বের মর্যাদা আগামীর জন্যে ?মাতৃত্বই নারীর পরম  ও সর্বোচ্চ মর্যাদা। এই সম্মান রক্ষার ভার ও তাই নারীরই। জেগে উঠো ভগিনীগণ,মত প্রকাশ করো,কাজ করো নিজের বিপক্ষে নয় বরং নিজের ও ভবিষ্যতের প্রেরণা হয়ে। 


 

Leave a Comment