যদিও আমার যুগটা ততটা খারাপ ছিলো না: ডা. মিথিলা ফেরদৌস

  • ডা. মিথিলা ফেরদৌস
  • ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৮

ছোটবেলায় বাসার পাশের রাস্তা দিয়ে আসছিলাম, ঠিক আমার সামনেই একটা ছেলে সিগারেটের ধোয়া মুখের উপর ছাড়লো। কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। পিছন থেকে হঠাৎ আব্বার গলা পাই, ঘুরে দেখি আব্বা ছেলেটির কলার ধরে আমাকে বলছে, 'তুমি বাসা চলে যাও'। আব্বা পিছেই ছিলেন। আমি বাসা ফিরতে ফিরতেই মোটামুটি পাড়ার ছেলে জমে গেছে। ইচ্ছামতো মারা হয়েছে ছেলেটি। আব্বাকেও কিছুই করতে হয় নাই। এই ছেলেটি মনে হয় না জীবনে আর কখনও এমন করবে, মানে মানুষের বাচ্চা হলে এমন করার কথা না আরকি।

এখন আপনারা এখানে কি বলবেন? আব্বাকে ওখানে কি করা উচিৎ ছিলো? নীরবে থানায় যাওয়া? তারপর থানা থেকে ৫০/১০০ টাকা ইনকামের পথ করে দিয়ে পরদিন ছেলেটি আরেক মেয়ের সাথে এমন করতো? আচ্ছা ধরলাম আমাদের দেশের পুলিশ সৎ। এরপর আইন আদালত, আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট আর যেনো কি কি? বুঝতেছেন এক ইভটিজিংয়ে, কার শাস্তি কাকে পেতে হতো?এরপর পেপারে পত্রিকায় বিশ্রি ভাষায় আমাকে নিয়ে আজে বাজে কথা লেখা হতো (যদিও আমার যুগটা ততটা খারাপ ছিলোনা)। এখন হলে কনফার্ম এইখানেও বাণিজ্য চলতো। বুঝতেছেন কেনো আমরা মেয়েরা চুপ করে পাশ কাটিয়ে গা বাচিয়ে চলে যাই আসলে যেতে বাধ্য হই। ফলে কুলাঙ্গারগুলো লাই পেতে পেতে সুযোগ পেলেই আরও বড় অকাজ করে।

কিছু দিন আগেই হাসপাতালের করিডোরে একজন আমাকে বলল, ওই রানী, ওই কুইন... আমি হন হন করে হেটে করিডোর পাড় হয়ে যাই, আর মনে মনে ভাবি রানীই তো বলছে খারাপ তো না। আসলে এইসব জায়গায় প্রতিবাদ করা মানেই যে কতবড় বিপদ তার উদাহরণ রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাটি। পুলিশ সবসময় খারাপ না, তারও উদাহরণ আছে, একমেয়ে একদিন গল্প করলো, সে সখ করে শাড়ি পরেছিলো, কোন এক ওকেশানে। রাস্তায় ফুটপাথ ধরে হাটছিলো, এক মধ্যবয়সী লোক পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলে, "বাহ কোমড় টা খুব সুন্দর" এবং তার সাথে আরও খারাপ কথা। মেয়েটা চিৎকার করে উঠে। পাশেই পুলিশ ছিল, পুলিশ পাশে এসে দেখে লোকটি পালাচ্ছে, পুলিশ কিছু জিজ্ঞেস না করেই লোকটিকে ধরে ফেলে। এবং ধরেই বলে, "ম্যাডাম একে ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে লাভ নাই, তার চেয়ে আপনি ওকে জুতা দিয়ে মারেন, আমরা ধরে আছি। "মেয়েটি জুতা খুলে ইচ্ছামতো লোকটির দুই ঘা লাগিয়ে দেয়, এবং ঘটনাটি জনসম্মুখেই ঘটে। মেয়েটি আমাকে বলেছিলো, "ম্যাডাম কি যে শান্তি সেদিন পাইছিলাম বলে বুঝাতে পারবোনা।"কিন্তু সেই পুলিশ কিন্তু সব পুলিশের উদাহরণ নয়।

আচ্ছা, যারা এত আইন আইন করে চেঁচাচ্ছেন, তাদের জন্যে একটা প্রশ্ন, আজ যদি আপনার সামনে আপনার প্রিয় বোনটিকে বা প্রিয় মেয়েটিকে বা আপনার বউকে কেউ বাজে একটা কথা সাপোজ" ফাক গার্ল, ফাকিং ইউ (কথা টা লিখতেও খারাপ লাগে আমার, এইটাও নাকি মানুষের মুদ্রা দোষ), বা কেউ গায়ে হাত দেয়। আপনার সামনেই বলছি কিন্তু। কি করবেন আপনি? থানা, পুলিশ, সাক্ষি সাবুদ, মামলা মোকদ্দমা, হাইকোর্ট, তার উপর আছে সাংবাদিক। জ্বী না। আপনার রক্তে আগুন জ্বলে উঠবে, আপনি যে হোন আপনি চুপ থাকতে পারবেন না। কখনই না। এইটাই স্বাভাবিক, এইটাই ঘটা উচিৎ, এইটাই রিফ্লেক্স। যত বড় বড় কথাই আপনি বলুন না কেন? মেডিকেলে গিয়ে দেখেন, তাদের সিকিউরিটি বলতে কিছু আছে কি? কাজেই রামেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ছিলো ঠিক এমন একটি ঘটনা। করিডোরে আমার ছোটবোনেরাই হাটে আমার প্রিয় বন্ধুটি হাটে তাকে কেউ আমার সামনে এমন কথা বললে, আমার রক্তে আগুন লাগে লাগবে স্বাভাবিক।

প্রতি মেডিকেলে প্রতিদিন কোন না কোন ডাক্তার মেয়ে এইসব জন্তু জানোয়ারের কথা শুনেও না শুনার ভান করে যায়। কিন্তু রামেক দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে। নিজের প্রিয় বোনটির বা প্রিয় বন্ধুটির অপমানকে মেনে নিতে পারেনাই। প্রতিটি মেডিকেলে এমন প্রতিবাদ প্রতিদিন যদি হতো তাহলে কেউ আর এমন করার সাহস কখনওই পেতোনা। শুনুন, সবার উদ্দেশ্যেই বলি, আজ যে মেয়েটিকে রাস্তায় এমন অরক্ষিত দেখে আপনি সাহায্য করবেন, একদিন আল্লাহতালাই আপনার প্রতিদান দিবেই, আপনার প্রিয় মানুষ টিকে কেউ না কেউ রক্ষা করতে এগিয়ে আসবেই। আর যারা এইসব কে জায়েজ বলছেন তার প্রতিদানও আল্লাহতালাই করবে। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

Leave a Comment