একজন স্বদেশি ডাক্তারের কথা শুনুন!

  • রীপা চক্রবর্তী
  • মার্চ ১২, ২০১৮

বাংলাদেশি ডাক্তারদের অনেক বদনাম। তারা ভালো কাউন্সেলিং করেনা,রোগীদের সময় দেন না,ভুল চিকিৎসা করেন,প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভিজিট নেন,আরো অনেককিছু! আচ্ছা,একটু রূপকথার দেশ থেকে ঘুরে আসা যাক। কেমন হতো যদি আমাদের চিকিৎসা প্রাপ্তি সবসময় ডিজিটাল পদ্বতিতে হতো,আপনি যেকোন সময় একটি নির্দিষ্ট নাম্বারে কল করে কয়েক মিনিটের মাঝেই এম্বুলেন্সের সেবা ও হাসপাতালে পৌঁছবার পূর্বের সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারতেন, হাসপাতালে আপনার জন্যে সবসময় একজন ডাক্তার থাকতেন,সাথে তার টিম.। আপনার চিকিৎসার সমস্ত খরচ সরকার বহন করতো। আর আপনার সাথে কেউ না থাকলে হাসপাতালে কর্তৃপক্ষ-ই আপনাকে সঠিকভাবে বাড়ি পৌঁছে দেবে।

শুধু তাই নয়,আপনার দেখাশোনা করার জন্যে সহায়ক বা সহায়িকার ব্যবস্থাও করে দেবে। আরো আছে!ডাক্তারের চেম্বারে আপনাকে লম্বা সিরিয়াল দিয়ে অপেক্ষা করতে হবেনা,ডাক্তার আপনাকে খুব যত্ন করে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে দেখবেন। আপনার প্রেসক্রিপশন ফ্রি হবে অথবা বাৎসরিক একটি নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে আপনি আপনার প্রয়োজনীয় ঔষধ নিতে পারবেন যতবার ইচ্ছা। শিশু ও বয়স্কদের চিকিৎসা ফ্রি,গর্ভবতী মায়েদের সকল চিকিৎসা ফ্রি,যাদের ভালো খাবার কেনার সামর্থ্য নেই,সেই মা ও শিশুদের জন্যে সরকার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার অনুমোদন দিচ্ছে। কিভাবে নতুন বাবা-মা তাদের অনাগত সন্তানের জন্যে প্রস্তুত হবেন তার জন্যে বিশেষ প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা এবং প্রসবপরবর্তি জটিলতার নিরশনে একজন প্রশিক্ষিত ধাত্রী সর্বদাই মা ও শিশুর জন্যে নিয়োজিত! এইকথা গুলো শুনতে কতই না ভালো লাগছে!যদি সত্যই এমনটি হতো তবে কতোই না ভালো হতো!

কিন্তু আমি রূপকথার গল্প বলছিনা। আমি আমাদের পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে কেমন চিকিৎসা ব্যবস্থা বিদ্যমান তা জানাতে চাইছি আপনাদের। এই পদ্বতিগুলো আমাদের দেশেও শুরু করা সম্ভব যদি সরকার ও চিকিৎসা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর সহযোগিতা আমরা পাই। আমি নিজেও একজন চিকিৎসক। তাই সর্বাগ্রে আমিও চাই আমার কাছে আসা রোগীদের জন্য স্বল্পমূল্যে সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করতে পারিনা একজন উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক হয়ে অন্য নাগরিকগনের জন্য। প্রতি বছর প্রচুর রোগী আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চিকিৎসা নিতে যান কিন্তু তাদের সকলেই সঠিক চিকিৎসা পান না। যদিও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে খুব ভালো করে পেশেন্ট কাউন্সেলিং করা হয় যার দরুন তারা বুঝতে পারেন না অনেকাংশেই যে তাদের সঠিক চিকিৎসা হয়নি।

পরবর্তিতে তারা আপাতত সুস্থ হয়ে ফিরলেও আবার সেই সিম্পটম গুলোই ফিরে আসে এবং দেরী হয়ে যাওয়ার দরুন তাদের সুস্থতা নিশ্চিত করাটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায় আমাদের জন্য। এই সুযোগটাই নেয় কতিপয় চিকিৎসক ও তাদের সহকর্মীরা যাদের সঠিক রেজিস্ট্রেশন না থাকার পরও তারা আইনের দূর্বলতার সুযোগে চাটুকারীতা দিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে ভূল চিকিৎসা করেও ঠিক-ই রোগীর আস্থা অর্জন করে নিচ্ছেন। আমি পড়াশোনার সুবাদে কিছুদিন ইউকে থেকেছি ও কাজ করেছি। আর সেইজন্যে কিছুটা হলেও জানতে পেরেছি মূল সমস্যা গুলো কোথায়। লেখনীর শুরুতে যা যা বলেছি তার প্রায় সবকিছুই আমি স্বচক্ষে অবলোকন করেছি সেখানে। শুধু একটি সমস্যা ,আর তা হলো উইকেন্ডে আপনি মরে গেলেও ডাক্তার পাবেন না বা পেলেও অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করতে হবে যেমনটা আমরা দেশে পেসেন্টদের কাছে অভিযোগ শুনি।

তবে সেই সময়ে নার্সেরা অথবা ফার্স্ট এইড প্রভাইডারদের আপনি পাবেন যারা আপনাকে তাদের সম্ভাব্য সকল চিকিৎসা দেবেন। আমরা প্রায়-ই অভিযোগ করি ডাক্তারদের বেশি ভিজিট নিয়ে। কিন্তু আদতে উন্নত দেশগুলোতে পেসেন্টদেরকে তাদের হেলথ ইন্সুরেন্স অথবা ইনকাম লেভেলের উপর নির্ভর করে ট্রিটমেন্টের চার্জ ধরা হয়। ১৬বছরের পর থেকে সবাইকে চিকিৎসার ব্যায়ভার বহন করতে হয়। ইন্সুরেন্স থাকলে তা বেতন থেকে কেটে নেয়া হয়। সরকারি হাসপাতাল অথবা ক্লিনিকে খরচ কম,আর প্রাইভেটে অবশ্যই ট্রিটমেন্ট চার্জ বেশি। তাই, বাধ্যতামূলক ভাবে সকল নাগরিক জিপি বা জেনারেল প্র‍্যাক্টিস এ নিবন্ধিত থাকেন যা ব্যাতিত প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে আপনার চিকিৎসা এমনকি শুধু কনসালটেশনও সম্ভব নয়। তাহলে একটু ভেবে বলুন, আমাদের দেশে আপনি চাইলেই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে পারছেন যেখানে খুশি,সেখানে যদি এই জিপি সিস্টেম টা থাকতো আমাদের দেশে,তবে কি আপনি এত সহজে চিকিৎসা নিতে পারতেন? আরো যোগ করি,আমাদের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মত উন্নত দেশগুলোতেও ভালো চিকিৎসা শহরাঞ্চলেই সীমাবদ্ব,গ্রামাঞ্চলে নার্স ও অন্য হেলথকেয়ার প্রভাইডার রা কাজ করেন,তবে অবশ্যই তারা অনেক প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ, যে দিকে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি।

আরো একটি বড় সমস্যা তাদের আছে আর তা হলো তাদের হাসপাতালগুলোতে সিট অনেক কম থাকে। তাই কখনই তারা তাদের ধারনক্ষমতার বাইরে পেসেন্ট ভর্তি করেন না। প্রয়োজনে শহরের বাহিরে পাঠিয়ে দেন এবং আপনাকে কখনোই বেশিদিন বা সুস্থ হওয়া পর্যন্ত তারা হাসপাতালে রাখবেনা। যদি দেখেন যে আপনি সুস্থ হয়ে উঠছেন বা হবার আশা আছে,তবে তারা আপনাকে রীতিমত বাধ্য করবে বাড়ি ফিরে যেতে! যাতে পরে আপনার সিট-এ আরেকটি পেসেন্ট তারা নিতে পারেন ও তাদের বাড়তি সিট বা বাড়তি চাপ কোনটিই না নিতে হয়। আমাদের যদি কাজ করার সঠিক পরিবেশ প্রদান করা হয়,কর্মক্ষেত্রে সম্মান দেয়া হয়,সঠিক বেতন-ভর্তুকি ও বসবাসের নিরাপত্তা প্রদান করা হয়, সর্বোপরি হলুদ সাংবাদিকতা বন্ধ করে বরং আমাদের চিকিৎসাক্ষেত্রে সাফল্যের দিকগুলো সঠিকভাবে উপস্থাপন করে এবং রোগীদের আমাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে অনুপ্রাণিত করে যদি সরকার ও মন্ত্রণালয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়,আমরাও তবে আন্তর্জাতিক সেবা প্রদানে অবশ্যই সক্ষম হবো। সবশেষে,আমি আমাদের ভালো-মন্দের বিচারের ভার আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিলাম। শুধু এটুকুই আশা, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যাকে আপনি নিজের দেশে নিজের ঘরের কাছেই স্বল্পমূল্যে পাচ্ছেন, তাকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু অন্তত দিন,যে সুবিধা একটি উন্নত দেশেও সম্ভব নয় আমার আপনার জন্য। লেখক: চিকিৎসক বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজ কনসালটেন্ট, ডেন্ট-আই ইমপ্লান্ট সেন্টার আজিমপুর,ঢাকা, বাংলাদেশ

 

 

 

Leave a Comment