ট্যাবু ভাঙবো, প্রাইভেসী নয়!

  • রোমানা আক্তার 
  • মার্চ ১৫, ২০১৮

পিরিয়ড নিয়ে প্রচলিত ট্যাবু ভাঙতে অনেককেই দেখেছি রক্তমাখা প্যাডের ছবি আপ্লোড দিতে। একজন সচেতন নারী হয়ে আমি এখনো পর্যন্ত ফেসবুকে "রক্ত মাখা প্যাড" এর ছবি আপ্লোড দিয়ে ট্যাবু ভাঙ্গার সাহস করিনি বা করছিনা। সত্যি বলতে আমি নিজেকে শুধু নারী হিসেবে ভাবতে পছন্দ করিনা, মানুষও মনে করি। ইনফ্যাক্ট আমি নিজেকে "মেয়ে মানুষ" মনে করি। আর তাই হুজুকে পা বাড়ানোর চাইতে আমি বেশি গুরুত্ব দেই সেই কাজটিতে যেটাতে "সাপ মরবে কিন্তু লাঠি ভাঙবে না"। অর্থাৎ, নারী হিসেবে সম্মান পাবো এবং মানুষ হিসেবে এগিয়ে যাবো। এখন কথা হচ্ছে যেই পিরিয়ড নিয়ে এতো মাতামাতি সেটা নিয়ে আমি কি ভাবি? আমার কাছে পিরিয়ড নিছক একটা Physiological condition তথা নারী দেহের স্বাভাবিক অবস্থা। এটাকে আমি কখনোই Pathological condition তথা অসুস্থ অবস্থা মনে করিনি। যদিও আমাদের সমাজে এই স্বাভাবিক অবস্থা নিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করা হয় সেক্ষেত্রে আমি অবশ্যই চাই পিরিয়ড নিয়ে প্রচলিত এই ট্যাবু ভাঙ্গুক। কিন্তু সেই ট্যাবু ভাঙতে গিয়ে আমি আমার প্রাইভেসি ভাঙতে পারবোনা। 

আমি অবশ্যই সবাইকে জানাতে পারবোনা আমার কখন, কবে পিরিয়ড হয় এবং সেটার জন্য আমি প্যাড, কাপড় নাকি তুলা ব্যবহার করি? আর আমার ব্লাডটাইবা সেসবে কিভাবে লেগে থাকে। এটা রীতিমত অস্বস্তিকর বিষয় এবং রুচিবোধও বটে। আপনি সি বিচে বিকিনি কিন্তু পার্টিতে গাউন পরেন যেই চিন্তা করে আমিও ঠিক সেই চিন্তা থেকেই পিরিয়ড সামলাই কিন্তু প্যাডের ছবি আপ্লোড দেইনা। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে আমি কিভাবে এই ওপেন সিক্রেট পিরিয়ডের টপ সিক্রেট ট্যাবু ভাঙতে চাই? আমি আমার জীবনের এই ট্যাবু ভাঙ্গতে শুরু করেছি আমার পরিবার তথা চার দেয়ালের মধ্য থেকে। পিরিয়ডের দিন গুলোতে নামাজ মিস হলে বা রোযা না রাখতে পারলে আমাকে চোরের মত মুখ করে ঘুরতে হয়না। আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই দিন যাপন করতে পারি। আমি খুব সহজেই আমার এই অস্বস্তিকর দিনগুলোতে সবার সামনে শুয়ে বসে রেস্ট নিতে পারি। 

দোকানে প্যাড কিনার সময় আমাকে খেয়াল করতে হয়না দোকানে কেউ আছে কিনা? কাউন্টারে মহিলা নাকি পুরুষ? দোকানে যেই থাকুক, কাউন্টারে যেই বসুক আমি কনফিডেন্সের সাথে প্যাড কিনি যেমনটা অন্যসব জিনিস কিনি। আমার কাজিনের প্রথম যখন পিরিয়ড হয় তাকে আমি সববিষয় বুঝিয়ে দিয়েছি। ও এখন স্বাভাবিক থাকে। আমি এবং আশেপাশের পুরুষ ও নারীরা এ নিয়ে কোন লজ্জা পায়না, তামাশা করেনা। সত্যি বলতে, আমার চারপাশে পিরিয়ড বিষয়টা ডাল ভাতের মত সহজ বিষয়। তবে এটা কিন্তু একদিনে হয়নি। আমি ওকে বুঝিয়েছি, ও তাকে বুঝিয়েছে, সে অন্যজনকে বুঝিয়েছে। এভাবে একের পর এক বুঝাতে বুঝাতে আমরা মেয়েরা আজকে নিজের ও অন্যান্য পরিবারের সাথে পিরিয়ড বিষয়টা স্বাভাবিক করেছি। যতদিন মহিলা জাতি আছে ততদিন পিরিয়ডও থাকবে। তাই এ নিয়ে যেমন চোর পুলিশ খেলার মানে নেই তেমনি  প্রাইভেসী নষ্ট করারো মানে নেই। সবাই জানবে পিরিয়ড হয়, কিন্তু রক্তমাখা প্যাড দেখতে কেমন হয় তা জানা জরুরি নয়। ফেসবুকে রক্তমাখা প্যাডের ছবি আপ্লোড দিতে দেখে মনে হয়েছে, মশা মারতে কামান দাগানোর অবস্থা হয়েছে। এত ক্ষুদ্র বিষয়ে যে যাই করুক আমি অন্তত নিজের ব্রমহাস্ত্র খরচ করতে রাজি নই। আমাকে আরও অনেকদূর যেতে হবে "মেয়ে মানুষ" হিসেবে।

ফেসবুকে পরিচিত এক ট্যাবু ভাঙ্গা বিপ্লবীকে দেখেছিলাম, প্যাডের ছবি দিতে। সেই বিপ্লবী সবসময় তার খালাকে দিয়ে কয়েক মাসের প্যাড কিনিয়ে রাখে। যে নিজের ঘর সামলাতে পারেনা, নিজেকে সামলাতে পারেনা সে সমাজ সামলাবে কিভাবে? একটুখানি কনফিডেন্স আর অনেকখানি যুক্তি দিয়ে যেই ট্যাবু আমি আরও কয়েক বছর আগে ভেঙেছি (যেই সময়ে প্যাড পরিচিত ছিলনা, দামটাও ছিল বেশি, কাপড়ই একমাত্র ভরসা) সেই সমস্যার সমাধান করার জন্য এই যুগে (যেই যুগে "এখানে প্যাড পাওয়া যায়" লিখা সাইনবোর্ড ঝুলে, মুদির দোকানে, ফুটপাতে সহনীয় দামে প্যাড মিলে) আমি কোন রক্তপাত ঘটাতে চাইনি। সেই গুপ্তকালে প্রাইভেসী রক্ষা করে আমি যখন আমার আশেপাশের মানুষের মানসিকতা বদলাতে পেরেছি, এই উন্মুক্তকালে আপনারাও পারবেন।

 

Leave a Comment