মাতৃত্ব পর্ব-৩

  • সুদীপ্তা ভট্টাচার্য্য রুমকি
  • মার্চ ১৭, ২০১৮

নির্যাতন যেখানে মুখ্য উদ্দেশ্য হয় সেখানে সন্তান আসলে উছিলা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এ কারনেই জন্মের দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় মায়ের দোষত্রুটি অন্বেষণ। পান থেকে চুন খসার আগেই প্রতিনিয়ত মা কে দাড়াতে হয় আসামীর কাঠগড়ায়। অথচ কোন মেয়েই মা হয়ে জন্মায় না, নিজে সন্তানের জন্ম দিয়ে মা হয়। একটি শিশুর যেদিন জন্ম হয় সেদিন শুধু তার মা ই তাকে জন্ম দেয় না, সেও তার মায়ের ভিতর মাতৃত্বের জন্ম দেয়।অপ্রিয় হলেও সত্য সদ্যোজাত একটা শিশুর জন্য তার মা ই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ । তাকে স্বাভাবিক রাখার জন্য তার মায়ের উপস্থিতি, সান্নিধ্য,স্পর্শই যথেষ্ট।ছোট্ট একটা মানুষ, কিছুই যখন বোঝার ক্ষমতা তার থাকে না, তখনও সে তার মা কে চেনে,মা কে বোঝে,মা কে ভালবাসে।

পৃথিবীর সবচেয়ে মোহনিয়,অকৃত্রিম ও ঐশ্বরিক দৃশ্য বোধ হয় এটি।কিভাবে মানুষ অমানুষের মত সেই মা কে ই সন্তানের ভালমন্দ সবকিছুর জন্য দায়ী করে আমি বুঝিনা।একজন মা কে ক্রমাগত মানসিক চাপযুক্ত রাখা,প্রতিনিয়ত জনসম্মুকখে বা অলক্ষ্যে অপদস্থ করার মত পরিবারের মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাদের কাছে সন্তানের সুস্থ -সবলভাবে বেড়ে উঠার জন্য সহায়তা প্রত্যাশা করাটা আসলে কতটা যৌক্তিক? মেয়েটির নামটা না হয় থাক। রাজধানীর প্রানকেন্দ্রে তার শ্বশুর বাড়ি।প্রত্যন্ত অঞ্চলের হলেও তবুও মেনে নেয়া যেত কিন্তু আধুনিক সুযোগসুবিধা দোরগোড়ায় রেখে সেই বাড়িতে চোখ থাকতেও অন্ধ সেজে হাতরানোটা কোন দোষ মনে না করা হলেও দোষ মনে করা হত বাড়ির বউটির জেনেশুনে কিছু বলা কে।তাই কোন বিষয়ে বিন্দুসম সঠিক জ্ঞান থাকুক আর না থাকুক নিজের ইচ্ছামত পরিবারের সন্তানটিকে গিনিপিগ বানিয়ে তার উপর বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হত অবলীলায়।সেখানে একজন মায়ের কিছু বলার কোন অধিকার ছিলনা।

কারন মা টি তো সন্তানের ভাল চায় না,আর সবাই যেভাবে চায়। নিম্নবিত্ত নয় অর্থ-বিত্তসম্পন্ন তথাকথিত সভ্য পরিবারই ছিল সেটি, অথচ সন্তান কোলে নিয়ে বাসায় ঢোকার আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল আর কেউ যেন বাচ্চা জন্ম দেয় নাই, ইনিই দিছেন। আর কারো তো সিজার হয় নাই, উনারই হইসে।এতই যখন ননীর পুতুল বাপমায়ের ঘরে থাইক্কা গেলানা ক্যান? আমার ঘরে ন্যাকামি চলবো না কইয়া দিলাম। মাথা ঘোরায়,ঘুম হয় নাই আল্লাদের আর জায়গা নাই। বুঝিনা বোধ হয় এক্টিং।সব বইয়া খাওনের ফন্দি। শাশুড়ি অবশ্য প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছিলেন বাচ্চা নিয়ে তুমি ২১ দিন গেস্ট রুমে থাকবে।একটা চকিতে বিছানা করে দিব,পুরনো যা ফেলে দেয়ার মত জিনিস দিয়ে। কারন তুমি অশৌচ ঘরে যাই ব্যবহার করবে সবই ফেলে দিতে হবে। দুইটা পুরনো ম্যাক্সির বেশি তোমার আর কাপড় লাগবে না।আর নতুন মায়েদের আন্ডারগার্মেন্টস লাগে না।

চুল আঁচড়াবে না।।তুমি ঘর থেকে বেরুতে পারবে না।খাবার দাবারও ঘরেই পাঠিয়ে দেয়া হবে।যা দিব তাই খাবে,রুচি দেখাবে না। যা বলেছি এর চেয়ে বেশি বুঝতে যাইও না।পন্ডিত পরিবারের পন্ডিত মেয়ের পন্ডিতির জায়গা আমার ঘর না। সু্যোগ পেলেই যেহেতু তিনি এভাবে কথা বলেন তাই মেয়েটি তাতে অবাক না হয়ে, অবাক হল রান্না ঘরের পাশের ঐ রুমটায় ভ্যাপসা একটা ভাব,গরমও বেশি লাগে। খুব ছোট রুম টা। পাশে যে বাথরুম সেটাতে লো কমোড, ও ব্যবহার করবে কিভাবে?সি সেকশনের পর তিন দিনের ভিতর নিচে বসা তো ওর পক্ষে সম্ভব হবে না।এছাড়া বাচ্চার জন্যও তো ঠিক হবে না রুমটা। তাই অনেক অপমানিত হতে হবে জেনেও শাশুড়ি কে অনুনয় বিনয় করে সে নিজের বেডরুমে থাকার অনুমতি নিয়েছিল,যদিও সে নিজের বিছানা ছাড়া ঘরের কোন জিনিস ছোঁবেও না বলে কথা দিয়েছিল। শিশুদের জন্মের সময় মধু খাওয়ানোর একটা রেওয়াজ আছে আমাদের দেশে।শিশু মিষ্টভাষী হবে এই কারনে তা করা হয়। যে পরিবারের কেউই মিষ্টভাষী নয় সেও মধু খাওয়াতে যায়,শিশুকে মিষ্টভাষী বানাতে।

অথচ একটা শিশু তখনই মিষ্টভাষী হবে যদি পরিবারের মানুষ মিষ্টভাষী হয়। অন্যথায় পুরো বোতল মধু খাইয়ে তাকে অসুস্থ অবশ্যই বানানো যাবে তবে মিষ্টভাষী নয়। এখনকার সময় ডাক্তাররাও নিষেধ করেন এই কাজ করতে। কারন মধু কে ডাইজেস্ট করার মত এনজাইম জন্মের দিন শিশুর দেহে থাকে না । তাই মেয়েটি তার হাজব্যান্ড কে অনুরোধ করেছিল মধু না খাওয়াতে। আর বাচ্চার জন্মের পর নাভি পড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নাভির জায়গাটা শুকনো রাখতে স্নান করাতে নিষেধ করা হয়। যাতে জল লেগে ইনফেকশন না হয়। আবার সময়ের আগে যদি শিশুর জন্ম হয় সেখানেও শিশুর স্নান করানোর ক্ষেত্রে একটু সচেতনতা অবলম্বন করতে হয়।উভয় ক্ষেত্রে গা টা ভালভাবে মুছে দিতে হয়। তাই বউটি এইসব ব্যাপারগুলো সুন্দরভাবে সামলানোর জন্য তাদের সহযোগিতা কামনা করেছিল। কেন নিজের ঘরে থাকতে চাইল,কোন সাহসে মধু খাওয়ানো আর স্নান করানো নিয়ে হাজব্যান্ড ও শাশুড়ি কে অনুরোধ করল তার ফল ওকে খুব ভয়াবহভাবে ভোগ করতে হয়েছিল। বাচ্চাকে খাওয়াতে গেলেও সে ব্যথা পেত,প্রথম সন্তান তাই খাওয়ানোর সঠিক নিয়মটা জানতো না বলে। তা দেখে যখন ওর বাবা মা ডাক্তারের সাথে মেয়ের জামাই কে একটু কথা বলতে বলেছিলেন।

সেক্ষেত্রে কোন সহযোগিতা না করে সাথে সাথে শাশুড়ি বললেন কি অপমান কি অপমান!! পাটেশ্বরী কে এত সেবা দেয়ার পরও হয় নি।তোকে কিন্তু অপমান করল বাবা। নিউনেটাল জন্ডিস খুব কমন একটা বিষয়। হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ এর সময় বলেই দিয়েছিল সকালে বাচ্চার গায়ে রোদ লাগাতে। বাসায় কেউ সেই কাজটা করতো না। এমনকি বাচ্চার বাবাও না। মায়ের তো ঘর থেকে বেরোনোই নিষেধ। মা টি কেই সারারাত জেগে থাকত হত বাচ্চা কোলে অসহ্য ব্যাথা নিয়ে, কারন বাচ্চা সারারাত কাঁদলেও আর কেউ তাকে ধরতো না। এছাড়া ১১ তলার ফ্ল্যটটিতে সকালে জানালা দিয়ে রোদটাও আসতো না।বাচ্চার মুখের দিকে তাকানোর সময় কারো না থাকলেও তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে মা টিকে কে প্রতি মুহূর্তে হেনস্থা করার জন্য সময়ের অভাব কারো ছিলনা। মা টি বার বার বলায় বাচ্চার চোখ হলুদ লাগছে তাই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় বাচ্চাটিকে।

ব্লাড টেস্টে বিলিরুবিন এর পরিমান বেড়ে গেছে দেখে বাচ্চটিকে হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন ডাক্তার। তা শুনে সাথে সাথে শ্বশুর-শাশুড়ি রণমূর্তি ধারন করে বউ এর ঘরে এসে পারলে খুন করে ফেলেন মেয়েটিকে। অমুকের বাচ্চা,তমুকের বাচ্চা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করব তোকে ঘর থেকে বলে যা তা ভাষায় গালিগালাজ করেই যাচ্ছিলেন। হাজব্যান্ড পাশে দাড়িয়ে উপভোগ করছিল দৃশ্যটা। মেয়েটি নিজের হাজব্যান্ডের কাছে দৌড়ে গিয়ে বলল, তুমি অন্তত এটা বলো না যে আমি দায়ী আমার ছেলের এই অবস্থার জন্য। সে সাথে সাথেই বলে উঠল তোমারই তো দোষ। চুপ করে থাক। শাশুড়ি আরও মারমুখী হয়ে তার স্বামী এবং পুত্র কে বলছিলেন "নিজের বেডরুম রে অশৌচ ঘর বানাইয়া জন্ডিস করসে বাচ্চার।স্নান করাইতে মানা করসে জন্মের পর, প্রতিদিন স্নান করাইলে তো জন্ডিস স্নানের সাথে ধুইয়া যাইতো। খাবারেও হলুদ খাইসে তাইলে বাচ্চার জন্ডিস হইবো না তো কি হইবো।"মেয়েটি বুঝতে পারছিল দাঁতে দাঁত চেপে তিনি সেদিন যখন তাকে তার বেডরুমে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন,জলে চুবিয়ে যে জন্মের পর স্নান করাতে পারেন নি,তা সুদে আসলে উশুল করতে নিজে অশৌচ ঘরে খাবার পাঠিয়ে বলেদিলেন মেয়েটি হলুদ খেয়েছে। অথচ উনি না দিলে ও খেল কিভাবে? স্তম্ভিত ফিরে পেল শাশুড়ি যখন বললেন এতকিছুর পরও তোমরা দেখতাছ,ওরে বাইর করবা না?বলতে না বলতেই শ্বশুর পা উঠিয়ে আগ বাড়লেন!!! মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। মাত্র আট দিন আগে অপারেশন হয়েছে। কিভাবে যে হাসপাতালে গিয়েছে বাচ্চা নিয়ে সে নিজেও জানে না। সেখানে গিয়েও নিস্তার ছিলনা,ক্রমাগত শুনতে হচ্ছিল যা তা কথা। সেখানে গিয়েও শাশুড়ি চিৎকার করছিলেন "আমরা তো টাকার গাছ লাগাইয়ছি।নিজে অসুস্থ,বাচ্চা জন্ম দিছে আরেকটা অসুস্থ।এইগুলার পিছনে এখন আরো লাখ টাকা লাগবো।আমি কোন দিনও শুনি নাই,কারো বাচ্চার জন্ডিস হইসে।"

 

 

 

 

Leave a Comment