ধর্ষণও আজকাল আড্ডার মজার টপিক্স হয়ে গেলো নাকি?

  • ফারজানা আক্তার 
  • এপ্রিল ২, ২০১৮

বর্তমানে অনলাইনে ভাইরাল যে ভিডিওটি আছে সেটি হলো আরটিভি চ্যানেলের “এবং পূর্নিমা” অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে আসা মিশা সওদাগরের সাথে পূর্ণিমার আড্ডার ভিডিওটি। অনুষ্ঠানে পূর্ণিমা মিশা সওদাগরকে বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন করেছেন , মিশা সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।

যে কারণে ভিডিওটি ভাইরাল সেটি হলো - পূর্ণিমা মিশাকে প্রশ্ন করেছেন, "আচ্ছা, সিনেমায় আপনি কতবার ধর্ষণ করেছেন?" মিশা উত্তর দিয়েছেন,"যতবার আমাকে ডাইরেক্টর বলেছে, ততবারই করেছি!" মিশার উত্তরের পর পূর্ণিমার আবার প্রশ্ন, "আপনার কতশত ছবি হয়েছে, মানে প্রত্যেকটা ছবিতেই কি ধর্ষণের সিন ছিল? আচ্ছা, কার সাথে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন এই ধর্ষণ সিন করতে?" মিশার উত্তর, "মৌসুমী আর পূর্নিমা!"

উপরে তাদের কথাবার্তার যে অংশটুকু তুলে ধরলাম সেসব কথাবার্তা কিন্তু তারা হাসতে হাসতেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ধর্ষণের মতো ঘৃণিত একটা বিষয়কে নিয়ে এতো হাসি তামাশা কিভাবে করা যায় আমার মাথায় আসে না। পূর্ণিমা এবং মিশা সওদাগর আমাদের দেশের প্রিয় দুইটি মুখ এবং দুইজনেই ব্যাপক জনপ্রিয়। তাদের মতো মানুষের কাছ থেকে ধর্ষণের মতো বিষয় নিয়ে হাসি তামাশা কখনোই আমাদের কাম্য নয়। মিশার মুখ থেকে পূর্ণিমা নিজের নাম শুনে অট্টহাসিতে আবার জিজ্ঞেস করলেন, "আমরা দুইজনেই কেন ?" মিশা মিশার মতো করে উত্তর দিয়ে গেলেন।

স্পাইডারম্যান মুভিতে একটি কথা আছে , "উইথ গ্রেইট পাওয়ার কামস গ্রেইট রেসপন্সিবিলিটি!” প্রবল ক্ষমতার সাথে অনেক বড় দায়িত্বও আসে। আপনি যখন সমাজের একটি জনপ্রিয় মুখ, আপনার হাতে যখন অনেক ক্ষমতা তখন কিন্তু আপনার দায়িত্বের সীমারেখাও অনেক বেশি। আপনাকে তখন অন্য ১০-১৫ সাধারণ মানুষের মতো করে চিন্তা করলে চলবে না। আপনাকে কথাও বলতে হবে অনেক ভেবে চিন্তা করে, কারণ আপনার প্রতিটা কথা তখন আপনার ভক্ত এবং সাধারণ মানুষের উপর অনেক বেশি ইফেক্ট ফেলবে। যে বিষয়টি নিয়ে তারা এমন মজা করে কথা বলছিলেন, যে বিষয়টি তাদের আড্ডার একটি মজার টপিক্স ছিলো, সেই বিষয়টিই কিন্তু আজকে আমাদের সমাজের ভয়ংকর মহামারী রূপ নিয়েছে।

প্রতিটা ক্ষেত্রের সেলেব্রেটিরা যদি চান তাহলে একটি সমাজ পাল্টে দিতে পারেন। চাইলে তারা সমাজের যেকোনো আন্দোলের নেতৃত্ব দিতে পারেন। কিন্তু তাদের ভক্তকুল হারানোর ভয়ে হোক কিংবা কিসের কারণে তারাই ভালো জানেন তারা এই কাজটি করেন না। তারা হয়তো জানেন না কোন আন্দোলনে তারা যদি ১০% ভক্তকুল হারায়, সেই আন্দোলনেই তারা আরো ৬০-৭০% নতুন ভুক্তকুল পেয়ে যান। আন্দোলন অবশ্যই সমাজ এবং জাতির জন্য মঙ্গল এমন আন্দোলনই হতে হবে। শুধু নিজেদের সাধ্য সিদ্ধির আন্দোলন হলে সেটাতে ভক্তকুল বাড়বে না কমবে সেটা সেই পরিস্থিতির উপরই নির্ভর করবে। নারীর প্রতি সহিংসতা আর নির্যাতন প্রতিরোধে মিডিয়া ব্যাক্তিত্বরা কতটা বিশাল ভূমিকা রাখতে পারেন সেটার একটা উদহারণ দিচ্ছি -

কৃষ্ণাঙ্গ নারী তারানা বুর্কে ২০০৬ সালে যৌন নির্যাতনবিরোধী ‘মি টু’ আন্দোলন শুরু করেছিলেন ৷ এরপর হলিউডের প্রযোজক হার্ভে উইনস্টেইনের যৌন কেলেঙ্কারির খবর ফাঁসের সূত্র ধরে মার্কিন অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো ‘মি টু’ হ্যাশট্যগের এই প্রচারণা শুরু করেন আবারো৷ যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির ঘটনা প্রকাশ করতে নারীদের উৎসাহিত করতে এ প্রচারণা দ্রুত জনপ্রিয় হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ৷ একসময় যৌন নিপীড়নবিরোধী এই প্রচারণায় নারীদের পাশাপাশি যোগ দেয় পুরুষেরাও ৷ সামাজিক মাধ্যমে ভাগাভাগি করেন তাঁদের যৌন হয়রানির কথাও ৷ তারানা বুর্কে বলেন, ‘‘আমি কখনোই ভাবিনি যে, সারা পৃথিবীকে বদলে দেবার মতো কিছু করছি৷ আমি শুরু আমার নিজের সমাজকে পাল্টাতে চাইছিলাম৷ এটা কেবল একটা মুহুর্ত নয়, এটা একটা আন্দোলন৷ এখন সত্যিকার অর্থেই কাজ শুরু হয়েছে৷’’ (এই অংশটুকু সংগৃহিত)

সমাজের সেলিব্রিটিদের যে কোনো কথায় মানুষের কাছে খুব দ্রুত পৌঁছে যায়। তাদের ভক্তকুলও তাদের কথা খুব সহজে গ্রহণ করে নেয়। তাই সাধারণ মানুষ সমাজের জন্য, সমাজের মানুষের জন্য কাজ করতে চাইলে তাকে যতটুকু কষ্ট করতে হয়, একজন সেলেব্রিটি তার অর্ধেকেরও অর্ধেক কষ্ট করতে হয় না। শুধু যৌন নির্যাতন কেন ? ভারতের মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রতিবাদ করেছেন ভারতের জনপ্রিয় অভিনেতা ইমরান হাশমি।

তীব্র ঘৃণায় ভারতের মাধ্যমিক বোর্ড “সেন্ট্রাল বোর্ড অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন” এর নতুন নামকরণ করেছেন করাপ্ট বোর্ড ফর স্টুডেন্টস। এক প্রশ্ন পত্র ফাঁসই তো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গলায় অলরেডি ফাঁসি ঝুলিয়ে দিয়েছে। আমাদের কোনো মিডিয়া ব্যাক্তিত্বকে দেখলাম না প্রশ্ন পত্র ফাঁস নিয়ে একটা কথা বলতে। কোন মিডিয়া ব্যাক্তিত্বকে দেখলাম না ধর্ষণ নিয়ে একটি কথা বলতে। অভিনেতা মোশাররফ করিম যাই একটু বলেছিলেন কিন্তু কিছু মানুষ আবার তাকে নাস্তিক ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছেন। তখনো আবার কোনো মিডিয়া ব্যাক্তিত্বকে দেখলাম না মোশাররফ করিমের পাশে এসে দাঁড়াতে।

যাই হোক আমাদের দেশের মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব বলি, সেলেব্রিটি বলি কেউ সমাজের নষ্ট দিকগুলো নিয়ে ভাববে, কথা বলবে সেই আশা আমরা এখন আর করি না । কিন্তু এতটুকু তো আশা করতেই পারি আমরা , সমাজের নষ্ট দিকগুলো নিয়ে তারা হাসি তামাশা করবে না। ধর্ষণের মতো ঘৃণিত বিষয় নিয়ে হাসতে হাসতে তারা কোনো সুড়সুড়ি দিবে না। এই টুকু তো আমরা তাদের কাছে আশা করতেই পারি নাকি!

Leave a Comment