আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমিই নিব, তবুও ধর্ষণের ভয়ে ঘরকুনো হবো না

  • রোমানা আক্তার
  • এপ্রিল ৪, ২০১৮

কিছুদিন আগেও সন্ধ্যা হলে মা ফোন দিয়ে বলত, "বাসে উঠিস, রিক্সায় একা চলার দরকার নেই"। তবুও স্কুটি চালাতে দিতে চাইতেন না। আর এখন ঘর থেকে বের হতে গেলেই মা বলেন, "এসব বাদ দে, স্কুটিটা কিনে নে। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা। বাসে উঠে ধর্ষণের পর মরার চাইতে স্কুটি রিস্ক ভালো"। 

মায়ের কথা শুনে চিন্তাবনে হারিয়ে গেলাম।আজকাল নারীদের ঘর থেকে বের হওয়াটা ক্রমশ ভীতিকর হয়ে উঠছে। রিক্সা, সিএনজি, লেগুনা এমনকি বাস পর্যন্ত নিরাপদ নয় তাদের জন্য। দিনের আলো কিংবা রাতের আঁধার সব এখানে এক। অথচ আমার এই দেশের সরকার প্রধান, সরকারি বিরোধী দল, বেসরকারি বিরোধী দল, স্পীকার, ৫০ জন সাংসদ, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, পাইলট, শিক্ষিকা, দিনমজুর, চায়ের দোকানি থেকে প্রত্যেকটা উঁচু থেকে নিচু পেশায় নারীর বিচরণ। এর পরেও আমাদের দেশে ধর্ষণের বিচার হয় না। ধর্ষকের জায়গায় ধর্ষিতা হয়ে উঠে অপরাধী। ইভটিজারের জায়গায় ভিকটিম হয় ক্রিমিনাল। ধর্ষকেরা প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায় আর ধর্ষিতরা সেই ছাড়া পাওয়া লম্পটের হাতেই ক্রোধের আক্রোশে খুন হয়।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলাম বেশ কিছুক্ষণ। হ্যাঁ, এইতো আমি। ফুলহাতা একটা ঢিলেঢালা ড্রেস, লম্বায় মাটি ছুঁই ছুঁই। কেন জানিনা আজকাল ঘোমটা দিলে নিজেকে নিজে খুব সুন্দর লাগে। আজও ঘোমটা দিয়ে বেশ যত্নকরে ওড়নাটায় গুনে গুনে ছয়টা পিন লাগালাম যাতে কোন কাল বৈশাখী বাতাসে আমি উড়ে গেলেও আমার ঘোমটা যেন ঠিক থাকে। আমি তাকিয়ে দেখছি আর ভাবছি, "কি দেখা যায় আমার? কি এমন আছে যার জন্য পুরুষের চোখ এড়ানো যায় না?" চোখে কাজল দিতে গিয়ে দেখলাম চোখটা ভিজে আছে। তোয়ালে দিয়ে মুছে নিলাম চোখ। কিন্তু না, কি এক অদ্ভুত কষ্ট বুকটা চিড়ে খাচ্ছে। চোখটা ভিজে যাচ্ছে আবারো। কাজলটা রেখে দিলাম। অসহায়ের মত তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ নিজের দিকে। হঠাৎ মায়ের ডাক, "কখন বের হবি? ডাবের পানিটা এখনো গ্লাসে?" আমার ধ্যান ভাঙলো। চট করে পানিটা খেয়ে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বের হলাম রুম থেকে।

রাস্তায় আসার পর নিজের সমস্ত ব্যস্ততা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মন চাইছে কিছুটা ব্যতিক্রম সময় কাটাই। নাহ, আজ আর কাজ হবেনা। ফোনটা নিয়ে কল দিলাম একে, ওকে। আজকের আবহাওয়াটা বড্ড চঞ্চল। নিজেকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। বাসে জানলার পাশে হাওয়া খেতে খেতে লিখলাম এসব। এক ফোটা বৃষ্টিজল আমার গালে এসে পড়ল এইমাত্র। এখন আর কিছু লিখবোনা। উপভোগ করব পুরো বিকেল। স্কুটি চালাবো পুরোটা ক্যাম্পাসে। আমাকে এক্সপার্ট হতে হবে স্কুটি চালানোয়। সামনে কত কাজ আমার, কত দায়িত্ব। ধর্ষণের ভয়ে বসে থাকলে চলবে? বরং চোখ, কান, বোধ, বুদ্ধি খোলা রেখে সতর্কতার সাথে এগিয়ে যেতে হবে আমাকে। যে দেশ, যে সমাজ আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয় না শুধু সুযোগ দেয় এগিয়ে যাবার, সেই দেশে নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে দোষ কি?

 


 

Leave a Comment