আমি নারী হয়ে নারী কোটার বিপক্ষে, আপনি?

  • ফারজানা আক্তার
  • এপ্রিল ১০, ২০১৮

বর্তমানে সবথেকে আলোচিত বিষয় হচ্ছে কোটা। কোটা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরণের কথাবার্তা, আলোচনা হচ্ছে। আমি নিজে কিছু কোটার পক্ষে এবং কিছু কোটার বিপক্ষে। প্রথমেই বলি নেই আমি একজন নারী এবং আমি নারী কোটার সম্পূর্ণ বিপক্ষে। আমি আমার মেধার জোরে, নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেলে করবো, না পেলে করবো না। বর্তমানে অধিকাংশ নারী সমঅধিকারে বিশ্বাসী তাহলে চাকরি ক্ষেত্রে আলাদা কোটা কেন? যারা সমঅধিকারে সচেতন তাদের তো উচিত ছিলো অনেক আগেই আন্দোলন করে আলাদা কোটা বন্ধ করে দেওয়া। একদিকে সমঅধিকার চাচ্ছেন, অন্যদিকে বৈষম্য তৈরী করে বিশেষ সুবিধার জন্য আলাদা কোটা রেখেছেন। এই বিষয়টা কিঞ্চিৎ আপনাকে হাস্যকরভাবে তুলে ধরছে না তো?

আমি একজন নারী এবং আমি সমঅধিকারে বিশ্বাসী নয়, আমি আমার প্রাপ্ত সম্মানে বিশ্বাসী। আমি জানি যেখানে আমি আমার প্রাপ্ত সম্মান পাবো সেখানে আমার অধিকার এমনি চলে আসবে। আমি আমার প্রাপ্ত সম্মান নিয়ে নিজের মেধার যোগ্যতায় একজন পুরুষ সহকর্মীর সাথে চাকরির প্রতিযোগিতায় নামতে চাই।  আলাদা কোটা নিয়ে নিজেকে হাস্যকরভাবে তুলে ধরতে চাই না। কোটা যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কতটা ভয়ংকর সেটা আমি সত্যিকারের একটি ঘটনার মাধ্যমে তুলে ধরতে চাই।

আমার এক পরিচিত আপু নাম রাবেয়া (ছদ্মনাম)। আপুর সাথে আমার সম্পর্ক খুব ভালো। আপুর দুই ধরণের কোটা রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার কোটা এবং নারী কোটা। আপুর বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।  আপুর ইচ্ছে আপু সরকারি চাকরি করবে। এখানে বলে রাখা ভালো আপু মোটামোটি থেকে আরেকটু কম মেধাবীর স্টুডেন্ট। কিন্তু আপু সরকারি চাকরির ব্যাপারে খুব কনফিডেন্স ছিল। কারণ দুই কোটা এবং কিছু মামা খালুর জোরও ছিল। আপু প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা দিলেন এবং প্রথমবারেই ছক্কা লেগে গেল। আপুর ছক্কা লাগবে সেটা তো আপুর অনেক গল্প থেকেই জানতে পেরেছিলাম। চেনা জানা মানুষ সফল হলে শুনতে ভালোই লাগে কিন্তু আপুর চাকরি হওয়াতে আমি একদম খুশি হতে পারিনি। খুশি কেন হতে পারি নি সেটা আপুর ভাইভা পরীক্ষার গল্প শুনলেই বুঝতে পারবেন। ভাইভা বোর্ডে আপুকে বলা হয়েছিলো পল্লী কবির যেকোনো একটি জনপ্রিয় কবিতার দুইটি লাইন বলার জন্য।  আপু ২মিনিট চুপ থেকে 'ঐ দেখা যায় তাল গাছ' ছড়াটা বলে দিয়েছে। আমি অবাক হয়ে আপুকে জিজ্ঞেস করলাম আপু এটা তো ছড়া আর এটা পল্লী কবির লেখাও না।

আপু হেসে বললো সে পল্লী কবির আসল নাম ভুলে গেছিলো, আর তার কাছে নাকি ছড়া কবিতা সব একই! আমি অবাক হয়ে তাকে বললাম, 'ছড়া কবিতা এক তোমাকে কে বলল?' যাই হোক আসল কথায় আসি আমার সেই আপুটা এখন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।  আমি যেই ঘটনার কথা বললাম এটা বছর তিনেক আগের ঘটনা। একজন শিক্ষকের কথাবার্তা যেমন হওয়া উচিত, বিশেষ করে বাচ্চাদের! আপুর কথা বার্তা বিন্দুমাত্রও তেমন নয়।  সেই আপুও আজ মানুষ গড়ার কারিগর। দুই কোটার জোর আপুর মতো একজন মানুষকে আজ শিক্ষক বানিয়েছে। ছড়া আর কবিতা যার কাছে এক সে ফুলের মতো শিশুদের কি শিক্ষা দিবে আমি জানি না।

অথচ আজকে যদি কোটার এই সুবিধাটি না থাকতো আপু কিন্তু এতটা দূর যাওয়ার সাহসই করতো না। কারণ আপু জানে তার সীমাবদ্ধতা। দুই কোটার জোর আছে বলেই আপু তার সাথে আরো কিছু মামা খালু জোর যোগ করেছে। আজকে কোটার সুবিধা না থাকলে এই জায়গায় অন্য একটি যোগ্য মেয়ে কিংবা ছেলে চাকরিটি পেতো। মুক্তিযোদ্ধাদের আমি সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। একশবার সালাম করি বীর এই মানুষদের কিন্তু বীরের ঘরে এই কোন মেরুদন্ডহীন সন্তানদের জন্ম হলো? সব বীরের সন্তানরাই যে মেরুদন্ডহীন সেটা কিন্তু নয়। এমন অনেকেই আছেন যাদের কোটা আছে কিন্তু তারা সেসব সুবিধা নিচ্ছেন না। তারাও আজ কোটা বিরোধী আন্দোলনের একজন।  স্যালুট জানাই তাদের।

মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে অনেক মুক্তিযোদ্ধারা না খেয়ে জীবন পার করছে , অনেকে রিকশা চালাচ্ছেন, অনেকের সন্তানেরা ফেরি করে বেড়াচ্ছেন তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধরিত সিটে করা বসে আছেন ? কারা সুবিধা নিচ্ছেন?

লেখার প্রথমে আমি বলেছিলাম আমি কিছু কোটার পক্ষে এবং কিছু কোটার বিপক্ষে। আমি শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী এবং উপজাতি কোটার পক্ষে। প্রতিবন্ধী এবং উপজাতিদের জন্য যদি সম্ভব হয় তাহলে অন্য সকল ক্ষেত্রেই তাদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হোক। বলা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানাতেই তাদের ছেলে -মেয়ে, নাতি - নাতনিদের কোটা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে! তাহলে আপনি তাদের বিষয়ে কি বলবেন? যারা দেশের জন্য যুদ্ধ করে এখন বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করছেন।  যে মুক্তিযোদ্ধারা না খেয়ে দিন পার করছেন, যারা রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। যে মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছেন তাদের সেই লড়াই আগে দূর করুন। সব বীরের সন্তানরা কিন্তু বীর হয় না, পরিমলও হয়।  সো বীরের সন্তানদের মেধার লড়াইয়ে ছেড়ে দিন, তাদের আলাদা সুযোগ দিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে বৈষম্য তৈরী করে দিবেন না প্লিজ।

বি.দ্র: লেখকের একান্তই ব্যক্তিগত মতামত।

Leave a Comment