আগের বাঙ্গালীর পহেলা বৈশাখ কি আজও হয়?

  • ইয়াসিন প্রধান সাজিদ 
  • এপ্রিল ১৪, ২০১৮

বাঙ্গালীদের একমাত্র ঐতিহ্যবাহী উৎসব নববর্ষ। নববর্ষতে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের নতুন হালখাতা শুরু হয়। নৌকাও নববর্ষের একটি প্রতীক। বড় বড় নৌকাগুলো এই দিনে নতুন করে রং করা হয়। নৌকাগুলোকে পুণরায় ফুটিয়ে তুলা হয় নদীর বুকে। কৃষকদের মুখের হাসিগুলো রঙ্গিন করে তুলে জমির প্রত্যেক কর্ণগুলোকে। ধান, এবং অন্য ফসলও ফলন হওয়ার পর নববর্ষের সময়ে কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়ে ঘরে উঠে।

আরও অনেক বিষয়বস্তু ঘিরে রয়েছে এই পহেলা বৈশাখকে। তবে দিনদিন বাঙ্গালীরা হারাতে বসেছে এই অপরুপ সৌন্দর্যের নববর্ষ। এই সময়ে বাঙ্গালীরা নিজের মতো করে প্রস্তুতি নেয় পুরো বছরের। গরিবরা যদিও আজকাল পূর্নরুপে ভোগ করতে পারেনা এই পহেলা বৈশাখ, তবুও তারা নিজেদের মতো করে পালনের চেষ্টা করে। ধনীরাতো নিজেদের মনের মতোই করে আজকাল বানিয়ে নিচ্ছে বৈশাখকে। যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই পালন করছে। তবুও তারা সবাই একটি জিনিসই মনে করে সবকিছু করছে। সেটি হলো পহেলা বৈশাখ।

আজকালের এই বৈশাখী নামে ভালোর চেয়ে খারাপ গন্ধটাই বেশি। আশেপাশে সব খানেই ঐদিনে শুনা যায়, বৈশাখ, বৈশাখ, বৈশাখ। তবে শুধুমাত্র বৈশাখ এগিয়ে এলেই মানুষের মনে, প্রাণে, মুখে, চোখে, মাথায়, মেজাজে, সব জায়গায় বাংলাপ্রেম জেগে উঠে। তবে ফাল্গুন মাসের শেষ পর্যন্ত তারা মুখে বাংলায় কথা বললেও, বাংলার ব-এর জন্যেও তার কোনো সম্মান থাকেনা। আবার বৈশাখ মাসের ৫-১০ তারিখের মধ্যেই বটতলার মেলার সাথে হারিয়ে যায় মিথ্যা বাঙ্গালির দেখানো মিথ্যা প্রেম। আজকের যুগে কি প্রকৃত নববর্ষ আছে? বটতলার বৈশাখ কি এখন বসে? আগের বাঙ্গালীর পহেলা বৈশাখ কি আজও হয়?

আসলে বলছি আদি বাঙ্গালীরা যেভাবে পহেলা বৈশাখ পালন করতো, আজকের বৈশাখ কি সেভাবেই হয় নাকি, ডিজিটাল বাঙ্গালী, ডিজিটাল বৈশাখ।মানুষ বৈশাখের চিত্র আকতে গিয়ে আজকাল ছবি দেয়, ইলিশ মাছ, পান্তা, ইলিশ শুটকির ভর্তা, ঢাক, একতারা ইত্যাদি। বৈশাখের গান বের হয় গিটার আর অত্যাধুনিক মিউজিক সিস্টেম দিয়ে। বৈশাখের গান একতারা আর তবলা দিয়েই তৈরী করা উচিত নয় কি? বৈশাখ মানেই ঘরে ইলিশ মাছ আর শুটকি থাকতে হবেই। নয়ত কাল পাশের বাড়ির মাসির কাছে মুখ দেখাতে পারবেনা।

তবে কেউ কি দেখেছিলেন নাকি যে, আগের বাঙ্গালিরা ইলিশ মাছ দিয়েই ভাত খেতো । বাংলার ঐতিহ্য অনুযায়ী মানুষের সাধারণ খাবার ছিল পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ/ পোড়া মরিচ। যেটা এই সময়েও প্রতিটি ঘরে ঘরে নববর্ষের উৎসব নিয়ে আসতে পারতো। অথচ দেশ উন্নতির সাথে সাথে মানুষ নববর্ষের ধরণ টাও বদলে দিল। ইলিশ মাছ আবার সাথে ইলিশ শুটকির ভর্তা। মাছের দাম ১০০০-১২০০ টাকা আর শুটকির দামও প্রায় এখন এই মানের। যা গরিব মানুষদের পক্ষে দুর্লভ। দিন দিন এই মানুষদের জীবন থেকে এত উৎসবময় একটি দিন হারিয়ে যাচ্ছে।

শুধুমাত্র ডিজিটাল মানুষের মিথ্যে একটি প্রথার কারণে। হায়রে মানুষ, এটা বুঝেনা যে তাদের এই মিথ্যে ইলিশের প্রথার ফাদে পরে অনেকের কাছেই বৈশাখ টা আসেনা। সেটা চৈত্র থেকে সোজা জৈষ্ঠ্যে চলে যায়। কেননা তাদের ১০০০-১২০০ টাকা দিয়ে ১ কেজি ইলিশ কিনে বৈশাখ পালন করার মতো ক্ষমতা থাকেনা। মানুষ আজ নববর্ষ টাকে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছে যে ইলিশ আর পান্তা ছাড়া প্রত্যেক মানুষ ঐ দিনটাকে নববর্ষ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেনা। উৎসবময় দিনের নামে ধনী গরিবের বৈষম্য টা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার নামই কি নববর্ষ? যখন কোনো ঘরে পহেলা বৈশাখের সকালে ইলিশ খেয়ে খেয়ে আনন্দ করছে, তখন অন্য আরেকটি ঘরে ছোটো বাচ্চাটি হয়ত তার বাবা মাকে জিজ্ঞাসা করছে মা, কেনো তারা সকলে আজ ইলিশ খাচ্ছে?

আমরা কেনো খাচ্ছিনা? ছোটো বাচ্চাটির কথা শুনার পর মা হয়তো দুফোটো চোখের পানি ফেলে দিয়ে কোনোকিছু বুঝিয়ে বাচ্চাটিকে সামলে নিয়েছে। উৎসবটা তো সব বাঙ্গালীর জন্য। তাহলে খুশিটাওতো সবারই পাওয়া উচিত। সে অনুযায়ী নববর্ষ টা তো আদিযুগের খাবার পেয়াজ আর মরিচ দিয়ে পালন করা উচিত। নতুন মিথ্যে আবিষ্কৃত ইলিশ দিয়ে নয়। হে জাতি, কোথাও কি লিখা আছে যে, নববর্ষে ইলিশ মাছই খেতে হবে? মাছ খেতে হলে এমন মাছ খাও যেটা সব বাঙ্গালী ভাই-বোনেরাও খেতে পারে। নিচু, উচু, মধ্যবিত্ত সব মানুষ যেন সমভাবে আনন্দ উপভোগ করতে পারে।

বাঙ্গালীর জন্য ঐতিহাসিক পোশাক হলো ফতুয়া আর লুঙ্গী। অথচ বৈশাখের সকালে বাহিরে দেখতে পাবেন দামী জিন্স আর উন্নতমানের শার্ট অথবা গেঞ্জি। তবে খুব কম দেখা যায় পাঞ্জাবী। এটাই বা কোন ধরনের নববর্ষ। নববর্ষের সাথে খুব গভীরভাবে মিশে আছে বটতলা সম্পর্কটি। নিয়মানুযায়ী বটতলায়-ই বসার কথা মেলার। তবে আমি নিজেই মেলা পালন করি বাজারে। যেখানে কোনো গাছই নেই। তবে এই মেলাকেই অনেক জায়গাতে গাছতলা হিসেবে অভিহিত করা হয়। আজকের দিনে এটি হলো নববর্ষ।

মাটির পুতুল, পুতুল নাচ, বেতুন, গুড়ের জিলাপী, বাশি, কাচের চুড়ি, মাটির ব্যাংক, বেলের শরবত, বইমেলা, এগুলো নববর্ষের সাথে উতপোতভাবে জড়িত। এগুলো না থাকলে নববর্ষের মেলাটা ঠিক সম্পূর্ণই হয়না। আর ঠিক-ই মেলায় গিয়ে এর অনেকগুলোরই দেখা মিলেনা। ঐ যে প্রথমই বললাম নববর্ষটা দিন দিন ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে। বাঙ্গালী জাতির কাছে আমার একটাই অনুরোধ বাংলার। এই আনন্দ যেন সব বাঙ্গালী পায়, সেজন্যে মিথ্যে পান্তা ইলিশ প্রথাটিকে গুরুত্বপূর্ণ না করে সবাই যেন পান্তা আর যেকোনো মাছ কেই নববর্ষের সাথে মানানসই করে নেয়। তবে সবচেয়ে ভালো হতো যদি বাংলার আদিযুগের প্রথা অনুযায়ী পেয়াজ আর মরিচের সাথে পান্তাটাকে নববর্ষের মূল খাবার হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এতে করে সোনার বাংলার প্রতিটি ঘরে উৎযাপন হবে বাংলার ঐতিবাহিক উৎসব "নববর্ষ"।

Leave a Comment