বৃদ্ধ বয়সে থাকার জন্য আমি আমার জায়গা তৈরী করছি!

  • ফারজানা আক্তার 
  • মে ১৮, ২০১৮

আমি রিটার কাছে জানতে চাইলাম তার কি খেতে ইচ্ছে করে । রিটা বললো তার কিছুই খেটে ইচ্ছে করে না । আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম একদম কিছুই না ? রিটা মাথা দুইপাশে নাড়লো । নাহ! একদম কিছুই খেটে ইচ্ছে করে না তার । আমি বললাম কিছু না খেলে তো অসুস্থ হয়ে যাবেন । শরীরে কোন শক্তি পাবেন না । চলাফেরা করতে পারবেন না । জোর করে হলেও তো খেতে হবে । রিটা বললো জোর করেই তো খাই । মিল্টন জোর করে চেপে চেপে খাওয়ায় । খাবো না বললেই কি মিল্টন কথা শুনে! খায়িয়েই ছাড়ে ।

 

আমি খোদেজাকে জিজ্ঞেস করলাম তার কি খেতে ইচ্ছে করে। খোদেজা বললো তারও কিছু খেতে ইচ্ছে করে না। আর মিল্টন মোটামুটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব ধরণের খাবারই খাওয়ায়। আমি একে একে সবাইকে কি খেতে ইচ্ছে করে জিজ্ঞেস করলাম। কেউই কোনো খাবারের নাম বললো না। তারা সবাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মিল্টন মিল্টনই করে গেলো। 

কথা হচ্ছে এই মিল্টন কে? রিটা কে? খোদেজা কে? তাদের সাথে আমার সম্পর্কই বা কি? তাদের সাথে আমার কথা হলোই বা কোথায়? মিল্টনের সাথে রিটা বা খোদেজার সম্পর্কই বা কি? 

মিল্টন

বর্তমানে রিটা, খোদেজা আর মিল্টনের সম্পর্ক মা ছেলের। তবে মজার ব্যাপার কি জানেন?খোদেজা মুসলমান আর রিটা, খিস্টান। বিরক্ত হচ্ছেন? ভাবছেন আমি কি আবোল তাবোল বকছি। বর্তমানে মা ছেলে, তাহলে অতীতে কি ছিলো তারা ?আর দুই মায়ের এক সন্তান হয় কিভাবে? বর্তমানে মা ছেলে! এই রকম সম্পর্ক আবার হয় নাকি? এক মা মুসলমান, অন্য মা এবং ছেলে খিস্টান তাহলে বাবা কোন ধর্মের? আপনাদের মনে অনেক প্রশ্ন,  তাই না? অপেক্ষা করুন সব উত্তর পেয়ে যাবেন। 

মিল্টন একজন মানুষ। আমার আপনার মতোই খুব সাধারণ মানুষ।  তবে মিল্টন আর আমার, আপনার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে মিল্টনের কলিজা আকাশের মতো বিশাল, আর মনটা সাগরের মতো গভীর। মিল্টনের সাহস নিয়ে কথা বলার মতো সাহস আমার নেই।  বিশাল কলিজা আর গভীর মন নিয়ে এই ছেলে একটি বৃদ্ধাশ্রম খুলে বসেছে। বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিটা সদস্য এখন মিল্টনের মা এবং বাবা।  মিল্টনই তাদের সবার একমাত্র সন্তান।  মিল্টনের কাছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খিস্টান বলে কিছু নেই। মিল্টনের কাছে মানুষগুলোই বড়, ধর্ম নয়। 

রিটার মতো আরো এমন অনেক বাবা মা রয়েছেন এই বৃদ্ধাশ্রমে।  যাদের ঠান্ডা থেকে জ্বর, মাথা ব্যথা থেকে পা ব্যথা, নরমাল অপারেশন টু আইসিইউ, মন খারাপ টু ভাল্লাগেনা সকল সমস্যার সমাধান এই এক মিল্টন করে থাকেন।  সবার গল্পের এক নায়ক মিল্টন। অসহায় এই মানুষগুলোর অন্ধ চোখে আলো ফুটিয়েছেন মিল্টন। বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্ন জাগিয়েছেন। মিল্টনের ভালোবাসায় তারা তাদের দুর্বিষহ অতীত ভুলে বর্তমানে সুন্দর জীবনযাপন করছেন। 

মিল্টন ভাইয়া আমাকে বলে, "আপু জানেন? মুসলিম ধর্মের কেউ মারা গেলে আমি নিজ হাতে কবর দেই, হিন্দু মারা গেলে নিজ হাতে মুখাগ্নী করি। এখানের সবাই আমার বাবা মা এবং তাদের ধর্মের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সমাহিত করাও আমার দায়িত্ব।" এই ছেলেটার কথা আমি শুনি আর তাকিয়ে থাকি। কতটা সাহস নিয়ে এমন দুঃসাহস কাজ করতে পারে একজন মানুষ! 

মিল্টন ভাইয়ার বৃদ্ধাশ্রমের নাম Child & Old Age Care. এই বৃদ্ধাশ্রমের অধিকাংশই হারিয়ে যাওয়া বাবা মা, কুড়িয়ে পাওয়া বাবা মা।  নিজের সংসার , সন্তান , আত্মীয় স্বজন থেকে যারা হারিয়ে যায়, সন্তানেরা যাদের ময়লার স্তুপ, বাস স্টেশন, রেল স্টেশনে ফেলে রেখে চলে যায় তাদের জায়গা হয় মিল্টনের কাছে।  হারিয়ে যাওয়া, কুড়িয়ে পাওয়া বাবা মাকে মিল্টন গ্রহণ করেন ভালোবেসে। তাদের জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত মিল্টন তাদের একইভাবে ভালোবেসে আঁকড়ে রাখেন। 

আমি মিল্টন ভাইয়ার কাছে জানতে চেয়েছিলাম কোন ভাবনা থেকে তিনি এমন মহৎ একটি কাজের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি আমাকে উত্তর দিলেন - কাজটি মহৎ কিনা জানি না! তবে আমি বৃদ্ধ বয়সে থাকার জন্য আমি আমার নিজের জায়গা তৈরী করছি। আজকাল ছেলে মেয়েরা নিজের বাবা মাকে বোঝা মনে করে।  আমার ছেলেও যে আমাকে মনে করবে না সেই কথাও বা বলি কি করে! তাই নিজের শক্তি আর সামর্থ্য থাকাকালীনই নিজের জায়গা তৈরী করছি। রাস্তা ঘাটে আমি কোন বাবা মাকে দেখতে চাই না। প্রতিটা মা বাবাকে আমি একটি ছায়ার তলে আশ্রয় দিতে চাই। 

এই মানুষটির চিন্তা ভাবনা অনেক সহজ  সরল কিন্তু খুব গভীর। তার কথা শুনেই আমার মনে হলো বৃদ্ধ বয়সে থাকার জন্য আমি কি আমার জায়গা তৈরী করছি? বৃদ্ধ বয়সে থাকার জন্য আমি কি করছি? আমি থাকবো কোথায়? মিল্টন ভাইয়া আমার মাথায় নতুন আরেকটি চিন্তা ভাবনা ঢুকিয়ে দিলেন। 


 

Leave a Comment