আমার ছেলে মেয়ে আমার একটু খোঁজও নেয় না!

  • ফারজানা আক্তার 
  • মে ১৮, ২০১৮

জগৎ সংসারে একজন দম্পতির অনেকগুলো সন্তান দেখা যায়।  কিন্তু এমন একটি জায়গা যেখানে যারা কেউ দম্পতি নন, সবার বয়স ষাটউর্ধ , পূর্বে তাদের পরস্পরের সাথে পরস্পরের কোনো পরিচয়ও ছিলো না, সেখানে মায়ের সংখ্যাও অধিক, বাবার সংখ্যাও অধিক এবং সবার এদের সবার একটি মাত্র সন্তান! হ্যাঁ, ঠিক ধরতে পেরেছেন সে জায়গাটার নাম বৃদ্ধাশ্রম। 

বৃদ্ধাশ্রম নামটা শুনলে আপনার কেমন অনুভূতি হয়? আমার সামনে আমার বাবা মায়ের মুখটা ভেসে উঠে। তাদের করুণ চেহারাটা আমার চোখে ভাসে, আর আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠে। আমার মায়ের রোগের কোন শেষ নেই।  এক প্রকার আল্লাহর রহমতে আর ওষুধের উপর দিয়েই আমার মা বেঁচে আছেন।  ভাতের মুঠোর মতো করে তাকে ওষুধ খেতে হয়। জানি না কেন! অতিরিক্ত ওষুধের প্রভাবেই হোক, অথবা রোগের কারণেই হোক আমার মায়ের কিছু মনে থাকে না।  এক কথা তিনি মিনিমাম ৬-৭বার বলবেন।  তার মন খুব অল্পতেই খারাপ হয় আর খুব অল্পতেই রেগে যান। মন খারাপের সময় তিনি অনেক কথা বলতে থাকেন। 


 

আমি আমার সংসারে থাকি, আমার বাবা তার কাজে থাকেন, আমার ছোট ভাই বোন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাসায় আরো মানুষ আছেন কিন্তু সবাই সবার সংসার সন্তান নিয়ে ব্যস্ত। আম্মা কথা বলারও তেমন মানুষ পান না।  লাষ্ট স্টোক করার পর ডাক্তার তাকে বলে দিয়েছেন মন খারাপ হলেই যেন সে মানুষের সাথে থাকে , তাদে সাথে কথা বলে।  একা একা ঘরে বসে না থাকে। ব্যস্ত এই জীবনে এতো কথা বলার মানুষ কই ? আমার মা আমাকে ফোন দেন। একই কথা অনবরত বলতেই থাকেন। 

আমি এতো ব্যস্ত থাকি,তবুও তাকে কিছু বলি না। কতক্ষন তার কথা শুনি তারপর বলি বাকি কথা একটু পর শুনবো।  এই যে একটু পর বলি, সে একটু পরের জন্য অপেক্ষা করতে করতেই তার মন খারাপ দূর হয়ে যায়। আমার ব্যস্ত সারাদিনের শিডিউলে আমার মা একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে। মায়ের সেই শিডিউলে বাবা সাথে সাথে ভাগ বসান। বাবার সাথে কথা হয় সংবাদের হেডলাইনের মতো, আর মায়ের সাথে কথা হয় বিস্তারিত সংবাদের মতো।   

আমি খুব দায়িত্ববান সন্তান সেটা কিন্তু নয়, তবে আমি একজন কেয়ারিং সন্তান। আমি আমার বাবা মায়ের কষ্ট সহ্য করতে পারি না।  আমি ভাবতে পারি না আমার অস্তিত্ব থাকাকালীন সময়ে তারা একাকিত্ব অনুভব করবেন। তাদের ছলছল চোখ আমার দুনিয়া এলোমেলো করে দেয়। বাবা মায়ের মুখের হাসি দেখে আমি স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলি । জীবনের তাগিদে, বাস্তবতার মুখোমুখিতে, সমাজের নিয়মে আমাকে নিজের পরিবার ছেড়ে অন্য পরিবারে চলে আসতে হয়েছে, আমি একটা চাকরি করছি তাই চাইলেই আমি যখন তখন বাবা মায়ের কাছে যেতে পারি না, কিন্তু একাকিত্ব কমাতে প্রযুক্তি যত কিছু আবিষ্কার করেছেন তার সৎ ব্যবহার আমি করছি। রাত নেই, দিন নেই আমার বাবা - মায়ের যখন ইচ্ছে আমাকে ফোন করেন, আমিও সেই কলে সাড়া দিয়ে তাদের কথা শুনি। 

সম্প্রতি একটি বৃদ্ধাশ্রমে আমি ভিজিট করলাম। সেই বৃদ্ধাশ্রমের ম্যাক্সিমাম বাবা মা হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া বাবা মা। তারা সবাই তাদের সংসার থেকে ফুরিয়ে গেছে, পরিবার থেকে হারিয়ে গেছে। তাদেরকে রাস্তার ধার থেকে, রেল লাইনের পাশ থেকে, আবর্জনার স্তুপ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া হয়েছে। তাদের সবার গল্পগুলো কোথায় যেনো একটি জায়গায় এসে আটকে যায়! সেই গল্প আর এগুতে চায় না। 

ছোটবেলা বাবা মায়ের কণ্ঠ শুনলে আমাদের কান্না থামতো, আমাদের ভয় দূর হতো, মুখে হাসি ফুটে উঠতো। বাবা মায়ের বৃদ্ধ বয়সে যখন তাদের মুখে আমাদের হাসি ফুটানোর কথা, তখন আমরা তাদের দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছি! আমরা কেন এমনটা করছি? দায়িত্বের কথা বাদ, আমাদের কি একটুও  কৃতজ্ঞতাবোধ নেই? বাবা মায়েরা কি সন্তানের থেকে খুব বেশি কিছু চান? ছোটবেলা যারা আমাদের বুকের ভিতরে রেখে মানুষ করেছেন, তাদের বৃদ্ধ বয়সে আমরা আমাদের পাশে তাদের রাখতে পারবো না?
 

Leave a Comment