নারী আত্মসম্মানের সাথে নারী হয়েই বাঁচুন

  • জান্নাতুন নুর দিশা
  • জানুয়ারি ১১, ২০১৯

স্বপ্ন যে খুব বড় বড় দেখতাম তা নয়। ছোটবেলায় কাগজ কেটে কেটে মিথ্যে মিথ্যে টাকা বানাতাম। সেই মিথ্যে টাকার বান্ডিল বানিয়ে আব্বুর হাতে দিতে পারলে কী যে মজা লাগতো! আব্বু কিন্তু সেসব অযত্নে ফেলে রাখতেন না। একটা একটা করে গুণে বলতেন, "আরে এত অনেক টাকা দিয়েছে আমার মেয়েটা আমাকে।" আম্মু হাসতেন। আমি স্বপ্ন দেখতাম এভাবে একদিন সত্যি সত্যি টাকার বান্ডেল তুলে দিবো আব্বু আম্মুর হাতে।

ক্লাস ফোরে পড়ি তখন। যেমন খুশী তেমন সাজো প্রতিযোগিতা হবে। অনেকেই নতুন বউ সাজছে, অনেকে সাজছে মালিনী, অনেকে গ্রামের বুড়ি, আরো কত কি! আমি সাজলাম ফটো সাংবাদিক। স্কুলের মাঠে একটা ক্যামেরা নিয়ে এমনভাবে ছুটছিলাম যেভাবে খুব ঝামেলার মধ্যে একজন ফটো সাংবাদিক ছবি তোলার জন্যে ছোটে। এসএসসির পর থেকেই আমি বাসার বিদ্যুৎ/গ্যাস বিল দেয়া, বিভিন্ন প্রয়োজনে অফিস-আদালতে যাওয়া, বাইরের নানা দায়িত্ব সম্পাদন করতাম। আব্বুকে এসব করতে হতো আমি না করলে। আবার ঘরের কাজেও অনীহা ছিলো না।

ছোটবেলা থেকেই অনেকে বলতো আমার চিন্তাভাবনা, আর ইচ্ছেগুলো পুরুষালি! অথচ আমার চালচলন, আমার সাজসজ্জা সবকিছুতেই তীব্র নারীত্ব। সাত বছর বয়সে আমি আম্মুর কিনে আনা জিন্সের প্যান্ট পরবো না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, "এসব ছেলেদের পোশাক। তুমি বরং আমাকে শাড়ি কিনে দাও।" সাত বছর বয়সী সে আমার তখন পাঁচটা ছোট ছোট শাড়ি ছিলো।

তবু আমাকে অনেকেই পুরুষালি বলতো। আমার ভাবনার কারণে। আমি চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করতাম। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর, উপার্জনের স্বপ্ন দেখতাম। কর্তৃত্বপরায়ণ ছিলাম, দায়িত্ব কাঁধে নিতে ভালোবাসতাম। আমাদের সমাজে এভাবে ভাবাটা পুরুষের ভাবনা বলে ধরে নেয়া হয়। আর নারীর ভাবনা ধরে নেয়া হয় কেবল সাজগোজ, কেনাকাটা রান্নাবান্না এসব নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভোগা।

আসলে অনেক মেয়েই আজকাল পুরুষ হতে চায়। পুরুষ হবার জন্য পুরুষের মত পোশাক পরে, সিগারেট খায়, মাঝেমাঝে মুখে মন্দ শব্দ ব্যবহার করে বুঝাতে চায় তারা পুরুষের মত। অথচ এসব কিছু দিয়ে পুরুষের মত হবার চিন্তা ভ্রান্ত। আমাদের সমাজে পুরুষ মানেই দায়িত্ববান, কর্তৃত্ববান, উপার্জনক্ষম ও সংসারের নিরাপত্তা বিধানকারী ব্যক্তি। আর নারী মানেই দুর্বল, অবলা, নিরীহ আর ভীতু। চ্যালেঞ্জ নিয়ে না জানা চরিত্র।

কেবল এতটুকু ধারণাকে পালটে দিতে হবে। নিজেদের উপর আরোপিত এই অবলা নামক শব্দ ঘুচিয়ে ফেলাটাই এখন জরুরী। পুরুষের মত হবার প্রয়োজনই নেই নারীর। নারী তার নারীত্ব নিয়েই কেবল দায়িত্ব নিতে শিখুক। উপার্জন করে পিতামাতার দায়িত্ব নেয়া, সংসারে কন্ট্রিবিউট করবার দায়িত্ব কেবল ছেলে সন্তানের নয়, কন্যাসন্তান তার দায়িত্ব আর এড়িয়ে না যাক।

পিতামাতারাও কেবল মেয়ে বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হবার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসুক, মেয়েকে দায়িত্ব নেবার যোগ্য করে গড়ে তুলুক। নারী মানে অবলা না হোক। আবার নারী পুরুষ হতেও না চাক। নারী কেবল নারীই হতে হোক, নারী হয়েই নারী দায়িত্ববোধ, আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক।

 

Leave a Comment