ভালোবাসা পাগলামি নয়!

  • জান্নাতুন নুর দিশা 
  • জানুয়ারি ১৪, ২০১৯

ষোলো বছর বয়সী একটা মেয়ে ইনবক্সে আমাকে নক করেছে। বলছে, "আপু আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। আমাকে হেল্প কর।" এত ছোট একটা মেয়ের বাঁচতে ইচ্ছে না হওয়া ভয়ানক বিষয়। বললাম, "কেন?" "আমি একজনকে পাগলের মত ভালোবাসি। তাকে ছাড়া বাঁচবো না। কিন্তু সে আমাকে ধোঁকা দিয়েছে।" "পাগলের মত যেহেতু ভালোবাসো, তুমি পাগলই। তোমার চিকিৎসা দরকার।" "আপু, এভাবে রুডলি কথা বলছেন কেন? আপনি তো কত সুন্দর পরামর্শ দেন স্ট্যাটাসগুলোতে। আমাকে প্লিজ ভালো পরামর্শ দিন। আমার সত্যিই বাঁচতে ইচ্ছে করে না।"

"পুরো ঘটনা খুলে বল।" "আপু, এলাকার এক সিনিয়রের সাথে রিলেশনে গেছি গত বছর। খুব ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু কয়েক মাস যেতেই উনি শুধু ফিজিক্যালি ক্লোজ হতে বলে। আমি এসব চাই না। তাই ব্রেকআপ করে ফেলেছি। কিন্তু ওনাকে ছাড়া কিছু ভালো লাগে না। পাগলের মতো ভালোবাসি। বাঁচবো না তাকে ছাড়া।"

কোনটা ভালোবাসা আর কোনটা পাগলামি সেটা বুঝাটা খুব জরুরী। আমি মেয়েটাকে অনেক করে বুঝালাম। কিন্তু সে এখনো পুরোপুরি বুঝতে চাইছে না। ষোলোসতেরো বছর বয়সের আবেগ খুব ভয়ানক। মানুষ এসময় নিজেকে সবজান্তা ভাবে। কিছুই বুঝতে চায় না। তবে শেষ পর্যন্ত আমি ঠিক মেয়েটাকে বুঝাতে সক্ষম হবো। সে বিশ্বাস আমার আছে। মেয়েটা যে ছেলেকে ভালোবাসে সে ছেলে তার এলাকার সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলে। এলাকার সব মেয়ের ক্রাশ। তার প্রেমিকা হতে পারার একটা আলাদা ফ্যান্টাসি আছে। মেয়েটা এই ফ্যান্টাসিকেই পাগলের মত ভালোবাসা হিসেবে ভাবছে।

ফ্যান্টাসি আর ভালোবাসা যে এক না এই পার্থক্য অনেক ছাব্বিশ সাতাশের ছেলেমেয়েরাও বুঝতে চায় না আজকাল। কাউকে না পেলে মরে যাবার ভাবনা আসে তাকে ঘিরে থাকা ফ্যান্টাসি থেকে, মোহ থেকে। একটা মানুষের কাছাকাছি আসবার পর তাকে ঘিরে একটা কল্পনার জগত, একটা ভবিষ্যৎ স্বপ্ন তৈরি হয়। হুট করে সে জগত ভেঙে পড়লে মানুষ অসহায় অনুভব করে। নিজের ভাবনার জগতে ঐ মানুষটার শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে না। তাই মরে যেতে ইচ্ছে হয়।

অথচ এইসব অনুভূতি খুবই সাময়িক। একটা সময় এসব মরে যেতে ইচ্ছে হওয়ার স্মৃতি নিজেকেই হাসায়। মানসিক টানাপোড়ন কাটানোর জন্য নিজের চেয়ে বেশি সাহায্য কেউ কাউকে করতে পারে না। অপরিপক্ব বয়সে প্রেমে পড়া খুব কম মানুষই তা বুঝতে পারে। অস্থির হয়ে পড়ে, অধৈর্য হয়ে পড়ে। কেউ মরে যেতে চায়, কেউ ড্রাগ এডিক্টেট হয়ে পড়ে, কেউ সিগারেট ধরে, কেউবা হয়ে যায় সেক্সফ্রিক! অস্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত প্রায় প্রত্যেকটা মানুষের প্রথম জীবনে পাগলের মতো ভালোবেসে কষ্ট পাবার একটা করে গল্প থাকে! সেই কষ্ট, সেই ধাক্কা সামলাতে না পেরেই তারা অস্বাভাবিক জীবনে চলে যায়, হয়ে ওঠে বেপরোয়া।

অনেক মেয়ে নায়ক, লেখক, সেলিব্রেটিদের ডাইহার্ট ফ্যান হয়ে ওঠে প্রথম যৌবনে। ঘরের দেয়ালে দেয়ালে প্রিয় তারকার ছবি লাগিয়ে রাখে। প্রিয় তারকার ছবির উপরে মাথা রেখে ঘুমায়। কিন্তু সমস্যা তখন হয় যখন প্রিয় তারকার নজরে আসতে স্লিপিং পিল খেয়ে পত্রিকার নিউজ হতে চায় কেউ, অথবা প্রিয় তারকার সাথে দেখা করতে ঘর থেকে না বলে বেড়িয়ে পড়ে অন্য শহরের উদ্দেশ্যে। ক্রাশ/ফ্যান্টাসির সুযোগ নিয়ে অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করে অনেক নামীদামী ছেলেও। আবার অনেক মেয়েও নিজের ক্রাশ সেলেব্রিটিকে পাবার জন্য নষ্ট করে দেয় সেই সেলেব্রিটি ছেলের জীবন এবং ক্যারিয়ার।

এসব তথাকথিত ভালোবাসার বিচ্ছেদ হয় খুব নোংরাভাবে। এক পক্ষের অবহেলা, সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসবার প্রাণপণ চেষ্টা অন্যপক্ষের জোর করে আটকে রাখবার চেষ্টা, ভালোবাসা নামের পাগলামি। তারপর ভিডিও ফাঁস, স্ক্রিনশট ফাঁস, প্রাক্তনকে গালাগাল দিয়ে তিনবেলা স্ট্যাটাস, সিগারেট, ড্রাগ, আত্মহত্যা! পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধহীন এসব সম্পর্ককে ভালোবাসা নাম দিয়ে ভালোবাসা শব্দরাই অপমান করা হয়। ভালোবাসার কোনো স্কুল নেই যে শেখানো যাবে। নিজেকেই ভালোবাসাটা ঠিকঠাক শিখতে হবে। ভালোবাসা মানে শ্রদ্ধাবোধ, এক সাথে বাঁচবার দ্বিপাক্ষিক দায়বদ্ধতা। একসাথে বাঁচা না গেলেও দ্বিপাক্ষিক বিচ্ছেদ, বিচ্ছেদের পরও সেটাকে মেনে নিতে শেখা এবং শ্রদ্ধাবোধ বাঁচিয়ে রাখা। ভালোবাসার মানুষটিকে সুখী দেখতে চাওয়াটাই ভালোবাসা। আরো বেশি জরুরী কথা হলো নিজেকে ভালোবাসা। নিজেকে সর্বাবস্থায় সুখী দেখতে চাওয়া।

"লাভ এট ফার্স্ট সাইট" বলে আসলে কিছু নেই। প্রথম দেখায় ভালো লাগতে পারে, ফ্যান্টাসি ক্রিয়েট হতে পারে। অল্প দিনের পরিচয়ে মোহ কাজ করতে পারে। কিন্তু ভালোবাসা? ভালোবাসতে হলে একটা মানুষকে আদ্যোপান্ত পড়তে জানতে হবে, তার চাকচিক্য নয়, তার জীবনের আলো-অন্ধকার সবটাকে গ্রহণ করতে জানতে হবে। "মেডলি লাভ" বলেও কিছু নেই। পাগলামি শুধুই পাগলামি, ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা।

Leave a Comment