সৌন্দর্য বদলায় না, বদলায় দেখবার চোখ!

  • জান্নাতুন নুর দিশা
  • জানুয়ারি ২১, ২০১৯

আমার কৈশোরে আমাকে কেউ কখনো প্রপোজ করে নি। কেউ আমার জন্য গোলাপ হাতে পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে নি। স্কুল থেকে ফেরার পথে কখনোই কেউ আমার পিছু নেয় নি। এমনকি ক্লাসের যে ছেলেগুলো প্রত্যেক সহপাঠিনীকেই প্রপোজ করে বেড়াতো, দেখা গেছে তারাও কখনো আমার দিকে তাকায় নি। সে সময় বিষয়গুলো আমাকে কখনো ভাবায় নি। এমনকি এটা ভেবেও আমার তখন আফসোস হতো না যে আমাকে কেন কেউই প্রপোজ করলো না।

কৈশোরে আসলে এসব নিয়ে ভাববার মত মানসিক পরিপক্বতাই আমার হয় নি। বাবা-মায়ের কঠোর নিয়ন্ত্রণে বড় হওয়া মেয়ে আমি। যেসব সন্তানদের বাবা-মায়েরা বেশি নিয়ন্ত্রণে রাখে তাদের মানসিক পরিপক্বতা আসে দেরীতে। এই নিয়ন্ত্রণটুকুর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যৌবনে পদার্পণের পর আমার যখন মানসিক পরিপক্বতা এলো, কৈশোরে একটিও প্রেমের আহবান না পাবার বিষয়টি আমাকে বেশ ভাবিয়েছে। ভেবে ভেবে আমি কারণটা বের করেছি। 

খেয়াল করে দেখলাম, পারিবারিক এলবামে আমার শৈশবের অসংখ্য ছবি, সে সময় আমি ছিলাম তুমুল ফ্যাশনাবল শিশু। মূলত আমার মা অত্যন্ত ফ্যাশন সচেতন রমণী। তিনি নিজের বাচ্চাকে বেশ ফ্যাশনদুরস্ত চালচলনে রাখতেন। আশ্চর্যজনকভাবে, এলবামে আমার কৈশোরের ছবি খুব কম। সে সময় আমি তেমন একটা ছবিই তুলতাম না। এই বয়সের সন্তানের পোশাক, সাজসজ্জা ইত্যাদির উপর মায়ের নিয়ন্ত্রণ কমতে থাকে। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। 

আমি কৈশোরেই ছিলাম সবচেয়ে ক্ষ্যাত! ক্ষ্যাত মানে চরম ক্ষ্যাত! ঢোলা ঢোলা জামাকাপড় পরতাম, কাজল দিতে জানতাম না, লিপস্টিক দিলে ঠোঁটের দুপাশে লেপ্টে থাকতো। সমসাময়িক মেয়েরা যেখানে চুলে বেণী করে স্কুলে যেতো, আমি কোনো রকম কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুলটায় ব্যান্ড লাগিয়ে মারতাম দৌড়। তার উপর আমি ছিলাম চরম হেলদি। আমার মত মাঝামাঝি উচ্চতার মেয়েরা পায়ে পেন্সিল হিল পরে। আমি পেন্সিল হিল কিনেছি জীবনে একবার। পরিধানের প্রথম দিনেই পড়ে গিয়ে এলাহি কান্ড বাঁধিয়েছিলাম নানাবাড়ীতে। ফ্ল্যাট স্যান্ডেলে মাঝামাঝি উচ্চতার আমাকে মোটামুটি খাটোই তো লাগতো! গায়ের রঙও ময়লা। মেকআপ টেকঅাপ আমি এখনো চিনি না। তখন রঙ কিছুটা খোলানোর জন্য একমাত্র জিনিশই যা আমি চিনতাম তা হল টেলিকম পাউডার! সেই টেলকম পাউডার মুখে দিলে ধোঁয়াশার মত ঘামে ভেজা মুখে লেপ্টে লেপ্টে থাকতো। 

এরকম মদনমার্কা সাজসজ্জার মেয়েকে কেউ প্রপোজ করার কথাও না। প্রথম যৌবনে ছেলেরা ক্রাশ খায় লিকলিকে ধবধবা মেয়েদের উপর, এদের কোমরের বাঁকেবাঁকে যৌবন খেলে। কাজল টেনেটেনে এরা চোখকে করে হরিণীর মত। ঠোঁটে লালটাল মেখে সদ্য ফুটন্ত গোলাপের মত বানিয়ে ফেলে। বেণী দুলিয়ে হাঁটে। 

এমন সুন্দরী মেয়েরা কৈশোরে অসংখ্য প্রপোজাল পায়। তাদের কেউ কেউ আঠারো-ঊনিশে পা রাখতে রাখতেই দশবারোজনকে ছ্যাঁকাও দিয়ে ফেলে! এতে অবশ্য দোষের কিছু নেই। অপ্রাপ্তবয়স্ক একটা মেয়ের স্কুলজীবনে যাকে ভালো লেগেছে, কলেজে উঠেই সে দেখে ছেলেটি তার চেয়ে সামাজিক অবস্থানে, পড়ালেখায়, যোগ্যতায় অনেক নিচে। মেয়েরা এসব বিষয়ে অনেক সচেতন। অসফল পুরুষদের মেয়েরা নিজেদের জীবনে রাখে না, আবেগের উপর মেয়েদের প্রচণ্ড নিয়ন্ত্রণ। তাছাড়া সুন্দরীদের হাতে অসংখ্য অপশন, পেছনে অসংখ্য আসিক! 


যাই হোক, যৌবনে আসার পরই যে আমি ব্যাপক ফ্যাশনদুরস্ত হয়ে গেছি তা নয়। আমি এখনো হেলদি, এখনো আমার উচ্চতা মাঝামাঝিই, এখনো আমার গায়ের রঙ ময়লা। পরিবর্তন এসেছে সামান্য, যেমন পোশাকে। এখন আমি গুছিয়ে শাড়ি পরতে জানি। আমি কাজল লাগাতে জানি, লিপস্টিক লাগালে ঠোঁটের দুপাশে লেপ্টে যায় না। কপালে মধ্যম আকারের উজ্জ্বল রঙের টিপ পরি।  যৌবনে আমি অসংখ্য প্রপোজ পেয়েছি! কিন্তু কেন! গুছিয়ে সাজি বলে? 

এই প্রশ্ন মনে বারবার ঘুরপাক খেয়েছে। তাই কেউ প্রপোজ করলে জানতে চেয়েছি আমাকে কেন ভালো লাগে। কেউ বলেছে আমার চোখ সুন্দর, কেউ বলেছে নাক বা ঠোঁট, চাহনি, চুল, হাসি, কন্ঠ, কথা! এসব কি কৈশোরে ছিলো না আমার? আমি কি যৌবনে এসে আমার নাক, চোখ, ঠোঁট, কন্ঠ পরিবর্তন করেছি?  এ প্রশ্ন তাদের অবশ্য করি নি। করলে তারা বলতো, কৈশোরে কেন আপনার সাথে পরিচয় ঘটলো না? তখনই প্রেমে পড়তাম!  পুরুষ প্রচণ্ড রকম ফ্লাটারার জাতি! এরা মেয়ে পটাতে মিথ্যের পর মিথ্যে বলতে পারে। 

কৈশোর আর যৌবনের এই দুই চলন আমাকে মিথ্যে ধরতে শিখিয়েছে। আমি যা ছিলাম, তাই আছি, তাই থাকবো। যারা বলে আমি সুন্দর তাই প্রেমে পড়েছে, সৌন্দর্য ফুরোলেই ওদের প্রেম ফুরোবে জানি। যারা বলে আমার কন্ঠে কবিতা শুনে প্রেমে পড়েছে, কন্ঠা হারালেই তারা হারাবে জানি। যারা বলে আমার লেখা পড়ে প্রেমে পড়েছে, লেখা ছেড়ে দিলেই ওরা ফিরবে না আর জানি। পুরুষের প্রেমে কি তবে আমার বিশ্বাস নেই তবে? অবশ্যই আছে। পুরুষ পরিপক্ব হলে লিকলিকে ধবধবে সাদা আর খোঁজে না। তারা খোঁজে একজন ব্যক্তিত্ববান, দায়িত্ববান প্রেয়সী। আসলে প্রেম আসে এক মুহূর্তের জন্য। সেই প্রেমটা সৌন্দর্য দেখে আসে না, আসে অকারণেই, অহেতুক। 

তারপর মোহ আসে, মায়া বাড়ে। এক সময় সেসবও কেটে যায়। তারপর যা থাকে তার নাম দায়িত্ববোধ। এটাই বাস্তবতা। কোনো প্রেমই স্থায়ী নয়। স্থায়ী হয় নির্ভরতা। আমি যদি কৈশোরে অসুন্দর ছিলাম, এখনো আমি তাই।আসলে তা নয়। আমি তখনও সুন্দর ছিলাম, এখনো সুন্দর। সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি মানুষকেই গড়েছেন সুন্দর গড়নে। আর নারীকে গড়েছেন আরো বেশি সৌন্দর্য দিয়ে। প্রতিটি নারীই সুন্দর। শুধু দেখার চোখটাই বদলায় পুরুষের।


 

Leave a Comment