পুঁজিবাদের মোড়কে ‘বিকৃত’ ও ‘বিক্রিত’ নারীবাদ

  •  মো. ইফতেখার উদ্দিন
  • ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৯

পশ্চিমা ধনীদের দেশে নানা রকম শখ-আল্লাদ থাকে, তাদের অভাব নেই। সুখও আছে সাথে আরো বেশি কিছু। পশ্চিমা পুঁজিবাদের অন্যতম উপাদান পুরুষের তুষ্টির জন্য নারীকে প্রদর্শন ও উপস্থাপন। সেখানকার গণমাধ্যমে নারীদের যৌনবস্তু হিসেবে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন এমনটা হবারই ছিলো। পশ্চিমা পুরুষতান্ত্রিক ফাঁদে নারী যৌনারক এতটাই প্রভাব ফেলে যে ' তাদের দেখার জিনিস বটে' বলে আখ্যা দেয়া হয়। নারীকে ছাপা ছবি থেকে স্ট্রিপটিজ পর্যন্ত পুরুষের ভয়ারেস্টিক প্লেজারের (লুকিয়ে সুখ নেয়া) উপাদান হিসেবে তুলে ধরা হয়। পূ্জিবাদীদের কর্পোরেট স্বার্থ ধরে রাখতেই উন্নয়নশীল ও তৃতীয় বিশ্বে নারীবাদের বিকৃতকামাচার ও নগ্নতার প্রয়োগ। 

সেই সব পশ্চিমাদের অনুসরণ করে আমাদের দেশের কথিত নারীবাদিরা। তাদের কথিত নারীবাদ দিয়ে নারীদের আবেদনময় উপস্থাপনটা আরো জোড়ালো করা আরকি! এসব পশ্চিমা এনজিওর টাকায় পুষ্টিপ্রাপ্ত  নারীবাদী সংস্থাগুলো উন্নয়নশীল বা তৃতীয় বিশ্বের নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা কখনই বলে না। বললে তো নারী স্বাধীন হয়ে যাবে, গৃহপালিত নারীবাদের দামই থাকবে না। বাংলাদেশের গ্রামের প্রায় প্রতিটি নারীই কৃষিকাজে জড়িত, তাদের গল্পগুলো নারীবাদের এত্তেলা দেয়া শ্রেণীর আলোচ্য নয়। এই শ্রেণীর নারীদের সমাজ উন্নয়নে কখনই তাদের পাশে পাওয়া যায় না। অথচ অর্থনৈতিকভাবে নারীকে মুক্ত করতে না পারলে উন্নয়নশীল দেশে নারীর স্বাধীনতা সম্ভব নয়।

নারীবাদের তপ্পীবাহকদের মাধ্যমে নারীর মনে ঢুকিয়ে দেয়া হয়, পোশাক আশাক, বেশভূষা ও খোলামেলা জীবনই স্বাধীনতা। রাস্তায় চুমু খাওয়া, পরকিয়ার বৈধতা, একাধিক বিকৃত যৌনাচার, দাড়িয়ে মূত্র বির্সজন  এসবই যেন নারী স্বাধীনতার মূল প্রতিপাদ্য। 'নগ্নতাই সাহসীকতার পরিচয়' এ তত্ব নারীকে আরো বড় পণ্য করে তুলছে।  কিন্তু এ বিষক্রিয়া নিয়ে নারীবাদী সংগঠনগুলোর কথা বলা চলে না। নারীর সংগ্রামের কথা উঠে আসে না। ভাবখানা এমন, সমাজ, ধর্ম থেকে নারীকে তুলে বড় বাজারে পণ্য করাই যেন নারী স্বাধীনতা!

তৃতীয় বিশ্বের নারীরা যদি স্বনির্ভর হয়  তারা কোনো কাজে লাগবে না পশ্চিমাদের কিংবা পূঁজিপতিদের। একটি গাভী দিয়ে যাত্রা শুরু করে ৫০ টি গাভীর মালিক হওয়া মরিয়ম তার সংসারের হাল ফেরালে এনজিও বা নারীবাদিদের কোনো লাভ নেই, বরং ক্ষতি আছে। এভাবে যদি মরিয়মরা নিজের পায়ের দাঁড়িয়ে যায়, তবে অমুক তমুকের মতো পশ্চিমাদের এজেন্টরা তাদের রুটি রুজির সংস্থান কি করে করবে?  উন্নয়নশীল দেশের নারীরা স্বর্ণির্ভর হলে পূঁজিবাদের বিশ্বায়নের বড় বাঁধা হয়ে যায়। এরচেয়ে বরং মরিয়মদের বাদ দিয়ে বিকৃতকামাচারের স্বাধীনতা নিয়ে নারীদের ব্যস্ত  করা যাক। নারীকে নারীবাদ ও নারী স্বাধীনতার মোড়কে যদি বিকৃত কামাচারের অভ্যস্থ করা যায় তার প্রভাব পড়বে পূঁজিবাদের পণ্যে। নারীকে রগরগে ক্লোজ শর্টে নারীর বক্ষ কিংবা নিতম্ব প্রদর্শিত  করে সে সুযোগে পণ্যের বাণিজ্য ও বাজার দুটোই দখলে থাকবে। নারীকে প্রভূত্বের শেকলে ও পণ্যের বাজারে আরেকটু ভালো মতন বেঁধে নেয়া যাবে তাতে।  

১৯৭৫ সালে ললা মালভির লিখা ' প্লেজার অ্যান্ড ন্যারেটিভ সিনেমা 'প্রবন্ধটি প্রকাশিক হয় চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রভাবশালী সাময়িকি ' স্ত্রিণ' এ। প্রচার হবার পরেই ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয়। ফ্রয়েড ও লাকার মনঃসমীক্ষণ তত্বের সাহায্যে হলিউডে নারী উপস্থাপনদের চিত্র ফুটে ওঠে। ললা মালভির প্রস্তাবে দাঁড়ায়, ন্যারেটিভ সিনেমার প্রধান কর্তব্য দাঁড়ায় ‘ভিজুয়াল প্লেজার’ বন্দোবস্ত করা। তার এই প্রস্তাব হলিউড ছবিসহ প্রায় অধিকাংশ ছবির বেলাতে প্রযোজ্য। মালভি দু’ধরণের ভিজুয়াল প্লেজার খুঁজে পেয়েছেন, সিনেমার চরিত্রে দৃশ্যমান চরিত্রকে বিপরিত ধরে যৌন আনন্দ নেয়া।  মোদ্দাকথা হচ্ছে দর্শক সিনেমায় বা পর্দায় দেখা  চরিত্রকে ‘আমার বস্তু’ ও ‘আমি স্বয়ং’  এই দুইভাগে উপভোগ করে।  নারী সিনেমায় ঠিক কী ধরণের অবস্থান রাখে তা নিয়েও লিখেছেন মালভি। তিনি সিনেমায় তিন ধরণেল গেজ বা দৃষ্টি খুঁজে পেয়েছেন। তার মধ্যে একটি ক্যামেরার, একটি ছবিতে অভিনয় কারী চরিত্র অপরটির অধিকারী সিনেমার দর্শক।  এই তিন পক্ষের নজরেই নারী ইরোটেক বা রতিবস্তু হিসেবে প্রতিয়মান হয়। এ ছাড়া ন্যারেটিভ ছবিতে নারীর অন্য ভূমিকা নেই। 

নারীকে সবসময় দুর্বলভাবে উপস্থাপন করে আসছে পশ্চিমা অনুসরণকারী গণমাধ্যমও। সংবাদেও নারী রতিবস্তু। ধরা যাক  সংবাদ হলো ' ইয়াবা সুন্দরীর অন্ধকার জীবন, মধুবনে যেত অনেকেই' রুপলাবণ্য নিয়ে গণকৌতুহল সৃষ্টিকারী শিরোনাম দেখে বোঝারই উপায় নেই, 'কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ! ইয়াবা নাকি ইয়াবা সুন্দরীর ব্যক্তিজীবন? ঠ্যাঁং ছেড়ে লাঠি নিয়ে টানটানি! সম্ভব হলে ফলোয়াপ করে ইয়াবা সুন্দরীর ত্বক নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যও জুড়ে দেয়ার প্রচেষ্টা। শুধু ইয়াবা নয়, যে কোনো কেইসে নারী জড়িয়ে পড়লে সে পায় বিশেষ ট্রিটমেন্ট। স্পেশাল স্টোরি আসে।

কিন্তু নারীবাদের কথিত তপ্পীবাহকেরা জীবন সংগ্রামে লড়াই করা নারীর পাশে দাঁড়ান না সচরাচর। তারা খুঁজে  বেড়ান পুঁজিবাদী কর্পোরেট প্রেমের মধু আহরণের সুখ, লিখে বেড়ান পরকিয়া বলে কিছু নেই স্বকীয়তা চাই। পুরুষ দাঁড়িয়ে মূত্র বিসর্জন করতে পারলে নারী কেন নয়? এসব হাস্যকর গণ উদ্বেগ সৃষ্টিকারী বিষয়াবলি নিয়ে। উন্নয়নশীল যে দেশে এখনও মাতৃমৃত্যু শিশুমৃত্যুহার করেনি সে দেশে কী নারীর দাঁড়িয়ে মুত্র ত্যাগ খুবই প্রয়োজনীয় ? নাকি নারীর অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন!

পুঁজিবাদী সভ্যতায় নাটক ও চলচ্চিত্রে নারী একাকী, জৌলুশময় ও যৌনদেবী। নায়িকা শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় নায়কের সম্পত্তিতে। এ সভ্যতায় প্রথম পাতায় খবর হয়, রুনার বস্ত্রহরণ, গায়িকার দাম্পত্য কলহ, বি গ্রেড নায়িকার খোলামেলা পোশাক কিংবা উঠতি নায়িকার স্ক্যান্ডাল। দেশের বাকী ৯৯ ভাগ বঞ্চিত ও সংগ্রামী নারীর খবর প্রথম পাতায় আসে না, কারণ তাতে সেনসেশন নেই, আছে রুঢ় বাস্তবতা। কিন্তু সেই সংগ্রামী হতদরিদ্র কিশোরী বা নারী মা হলে, ধর্ষর্ণের শিকার হলে, কারও মুখ এসিডে ঝলসে গেলে তা আবার জম্পেস খবর হয়, মানবাধিকার নারীবাদি সংগঠন সোচ্চার হয়, বিকৃতি সভা সেমিনার আরো কতকি ! কিন্তু যে সংগ্রামী মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হলো তার জীবনমানে উন্নয়নে নারীবাদি সংগঠনের কোনো উদ্যেগ নেই। তার জীবনে টেকসই কোনো সমাধান আসে না। মেলেনা অর্থনৈতিক মুক্তি। 

কিছু ভাড়া করা বিদেশী  পোশাক ও সংস্কৃতি অনুসরণ ছাড়া বাদবাকী অন্ত:সারশূণ্য কিছু তত্বের চক্রে আবদ্ধ থাকে দেশের কথিত স্বঘোষিত নারীবাদীদের দর্শন। পুঁজিবাদের সাথে স্বঘোষিত পশ্চিমা অনুসরণকারী ফেমিনিস্টদের হাত ধরেই শুরু হয় নারীকে পণ্য হিসেবে ‘বিকৃত’ এবং ‘বিক্রিত’করার সূচনা। 
 

Leave a Comment