নারীর অবকাঠামোগত উন্নয়নে সমাজ এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা

  • ফারজানা টুম্পা
  • ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৯

নারী শিক্ষার অগ্রগতির জন্য যুগে যুগে অনেক মহামানব কাজ করে গেছেন। যেই নারী ছিল একসময় পুরোপুরি অবরুদ্ধ, যার কাছে পৃথিবী বলতে ছিল কেবলমাত্র ঘর আর বারান্দা, পৃথিবীর এই বিস্তৃত ভূমিতে যে ছিল উপেক্ষিত! সেই নারী এই একবিংশ শতকে নিজের অবস্থান তৈরিতে সোচ্চার হতে শিখেছে। ধীরে ধীরে নিজের উপরে আস্থা অর্জনের পথ বেছে নিতে শিখেছে এবং শিক্ষাক্ষেত্রেও নিজের দৃঢ় পদক্ষেপ রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, শিক্ষামন্ত্রী, স্পিকার সহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনেকেই নারী, তবে এতে অতি উৎসুক হওয়ারও কোনো কারণ নেই! কেননা এই কয়েকজন উজ্জ্বল নারী নেতৃত্ব দেশের সর্বস্তরের নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে না বা করতে পারে না! বরং বাস্তব চিত্র খানিকটা হতাশাব্যাঞ্জকই বলা যায়। এখন আসা যাক নারী শিক্ষা প্রসঙ্গে, এই যে নারীদের শিক্ষার পথ, সেটা কতটা মসৃণ, কতটা প্রশস্ত? তারা কি নির্বিঘ্নে তাদের অধিকার আদায় করতে সক্ষম হচ্ছে? নাকি হাজারো প্রতিবন্ধকতাকে পাশকাটিয়ে তাদেরকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে? তাদের কি বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে? তারা কি শিক্ষাক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা ভুগছে?

এর প্রেক্ষিতে প্রথমেই কিছু পরিসংখ্যান দেখিয়ে যেতে চাই। সমাজের কোন স্তরের নারীরা শিক্ষার সুযোগ থেকে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত, অবহেলিত এবং এই জনগোষ্ঠীর শিক্ষার হার কতোটা কম! এমনকি এই সমস্ত জনগোষ্ঠী যে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতেও সক্ষম নয় সেটা এই পরিসংখ্যান দেখলেই স্পষ্ট ধারণা পাবেন। সরকারি হিসাব থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রাথমিক পর্যায়ে বর্তমানে ভর্তির হার শতকরা ৯১ ভাগ যার মধ্যে মেয়ে শিশুরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে (যথাক্রমে ৯৪.৭ শতাংশ ও ৮৭.৮ শতাংশ)। গত কয়েক বছরের এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফল থেকেও দেখা যায়, সব শিক্ষাবোর্ডেই মেয়ে শিক্ষার্থীরা ছেলেদের তুলনায় ভালো কিংবা সমান ফলাফল করছে। এই একই সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কখনো ভর্তি হয় নি এমন শিক্ষার্থীদের হিসাব থেকে দেখা যায়, সারাদেশে ১২ শতাংশেরও বেশি শিশু রয়েছে যারা কখনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় নি এবং এক্ষেত্রে ছেলেদের হার মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি। সব মিলিয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীরা অন্তত বিদ্যালয় প্রবেশগম্যতার জায়গাটিতে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে।

বাংলাদেশের বস্তির শিশুরা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি অবহেলিত, যদিও তাদের একটি বিশাল অংশ খোদ রাজধানীতে বসবাস করে। যেসব পথশিশুদের রাজধানী বা বড় শহরগুলোতে দেখা যায়, তাদের অনেকেই বস্তিতে বসবাস করে। এক জরিপ থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের বস্তিগুলোতে প্রায় তিন লাখ ৮০ হাজার ১৮ বছর বয়সের নিচে শিশু বসবাস করে যারা মোটামুটি সব ধরনের মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত এবং এদের প্রায় ৫৫ শতাংশের বাস রাজধানী ঢাকায়। পথ শিশুদের ৭৬ শতাংশ ছেলে ও ২৬ শতাংশ মেয়ে। এক গবেষণা থেকে দেখা যায়, তিন-চতুর্থাংশ পথশিশু জীবনের কোনো না কোনো সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমন করলেও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তাদের গমনের হার খুবই সীমিত। মাত্র ৪.৩ শতাংশ শিশু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গমন করেছে। 

মেয়ে শিশুদের শিক্ষার হার ছেলেদের তুলনায় কম এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে তাদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। অন্যদিকে সার্বিকভাবে বস্তিতে বসবাসকারী মাত্র ৫৯.৪ শতাংশ মেয়ে শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায় যাদের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করতে পারে। যারা প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করতে পারে তাদের ৮৪.৫ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয় যায়। বস্তি এলাকায় শিক্ষার এই নিম্নহারের অন্যতম কারণ হচ্ছে, সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা খুবই কম এবং এসব জনগোষ্ঠীর মেয়েদের শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করার ইচ্ছাও অনেক কম। বস্তিতে বসবাসকারীদের যাদের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো, তাদের অনেকের সন্তান পার্শ্ববর্তী কোনো বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলেও সার্বিকভাবে সেই সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। তাছাড়া সেখানকার পারিপার্শ্বিকতা ও ঘিঞ্জি এলাকায় পড়াশোনা করার পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় অনেকে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহীও হয় না। বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই মেয়েদের বিয়ে দেয়ার প্রবণতাও লক্ষণীয়। এসব কারণে বস্তি এলাকার বিশেষত মেয়েদের পড়ালেখা অবস্থা করুণ।

অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বেদে জাতি বা যৌনকর্মীদের আর্থসামাজিক অবস্থার তথ্য একেবারেই অপ্রতুল। এসব প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর সাথে বর্তমানে কিছু এনজিও কাজ করলেও সার্বিকভাবে এসব গোষ্ঠী নিয়ে তথ্য বা গবেষণা প্রতিবেদন খুব কম পাওয়া যায়। এক গবেষণা থেকে দেখা গেছে, বেদে গোষ্ঠীর মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ কখনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায় নি। দুই শতাংশেরও কম বেদে শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা রয়েছে। ধারণা করা হয় বেদে দেরকে পেশাগত কারণেই ভ্রাম্যমাণ জীবনযাপন করতে হয় তাই তাদের পক্ষে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করাটাও সম্ভব হয় না। সাম্প্রতিক এক গবেষণা থেকে দেখা গেছে, যৌনকর্মীদের শিশুদের মাত্র ৫১ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়। মূলত সামাজিক কারণেই যৌনকর্মীদের সন্তানরা তাদের এলাকার বাইরে থাকা বিদ্যালয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে না। প্রথমত, সাধারণ মানুষের একটি বিরাট অংশ চায় না যৌনকর্মীদের সন্তানরা তাদের সন্তানদের সঙ্গে একসঙ্গে পড়ালেখা করুক। সামাজিকভাবে নানা বাধা আসে। দ্বিতীয়ত, যৌনকর্মীরাও অনেক সময় এসব সামাজিক বাধা দেখে তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে উৎসাহী হয় না।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে ধারণা করা যায় যে, সারা দেশে ৪৫,৬৮০ শিশু স্বল্পমাত্রার প্রতিবন্ধিতায় (mild disabilities) ভুগছে যাদের ৪৩.৪ শতাংশ মেয়ে। প্রতিবন্ধিতা চিহ্ণিত করার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো, নানা সামাজিক বাধার ভয়ে পিতামাতা তাদের সন্তানকে বাইরের মানুষের কাছে প্রতিবন্ধি হিসেবে পরিচয় দিতে চান না। তাছাড়া দেশের বিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবন্ধি শিশুর বিশেষায়িত শিক্ষার আলাদা ব্যবস্থা নেই। সাম্প্রতিককালে এ বিষয়টি প্রাথমিক শিক্ষায় বেশ গুরুত্ব পেলেও সেটি মূলত অবকাঠামোগত স্তরেই রয়ে গেছে। প্রতিবন্ধি শিশুর কথা মাথায় রেখে বিদ্যালয়ে ভবনে ঢালু সিড়ির ব্যবস্থা করা বা ক্ষেত্রবিশেষে বিশেষ উপকরণও সরবরাহ করা হলেও যে পদ্ধতিতে প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা

ব্যবস্থা করা উচিত, সেখানে ঘাটতি রয়েই গেছে। শিক্ষকদেরও এ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নেই। ফলে অনানুষ্ঠানিক পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায়, এসব কারণে প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আসার হার যেমন তুলনামূলক কম, তেমনি তাদের ঝরে পড়ার হারও বেশি। বিশেষত প্রতিবন্ধি মেয়ে শিক্ষার্থীরা এক্ষেত্রে পুরোপুরি উপেক্ষিত। প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগের দিক দিয়ে নারীদেরকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে এবং সেই হার ৬০ঃ৪০। পরেও একশভাগ প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে আমরা সক্ষম নই! এছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়ে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা অনেকাংশে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে সামাজিক বৈষম্য, ধর্মীয় গোড়ামি, যৌন নিপীড়ন, ইভটিজিংয়ের অাশংকা, বাল্যবিয়ে, সচেতনতার অভাব এবং বদ্ধ প্রকোষ্টে নারীদের বধ করে রাখার মতো অন্ধবিশ্বাস! তবে আশা করা যায় যে, অার (২০-২৫) বছরের মধ্যে উক্ত বৈষম্য কাটিয়ে নারীরা নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হয়ে উঠবে। তবে তার জন্য তাকে পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পরিক্রমা। এবং এই বন্ধুর পথে প্রতিটি পদক্ষেপে মানসিকভাবে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে তাকে। তার জন্য সর্বস্তরের মানুষের সার্বিক সহযোগিতা একান্ত কাম্য। তবেই তৈরি করা সম্ভব হবে একটি শিক্ষিত সমাজ এবং রাষ্ট্র, যা বিনির্মাণে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। 

Leave a Comment