শ্বশুরবাড়িতে একজন মেয়ের কত ধরণের গুণাবলী থাকা প্রয়োজন!
- ফারজানা আক্তার
- মার্চ ১, ২০১৯
খুব ধুমধামের সহিত রিয়া আর রাসেলের বিয়ে হয়ে গেলো। একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে দুইজন একইসাথে চাকরি করে। সেখানেই পরিচয়, তারপর প্রণয়, ফাইনালি বিয়ে। বিয়ের পর পর রিয়াকে রাসেলের বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। নতুন বউকে দেখার জন্য পাড়া - প্রতিবেশী, আত্মীয় - স্বজন সবাই ভিড় করছে। এক একজনের এক এক রকম মন্তব্য, প্রশ্ন। কেউ জিজ্ঞেস করছে নতুন বউয়ের পরিবার সম্পর্কে, কেউ জানতে চাচ্ছে মেয়ের বাবা মেয়ের সাথে কী দিলো, কেউ জানতে চাচ্ছে বউয়ের বংশ পরিচয় ইত্যাদি। সেদিনের মতো বউ দেখা শেষ হলে রিয়া কোন রকমে ফ্রেস হয়ে নিজের বিছানায় গেলো।
গায়ে হলুদের একদিন আগে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে রিয়া। বিয়ের পর ছুটি বাড়িয়ে নিয়েছে বলে বিয়ের আগে ছুটি কম নিয়েছে রিয়া। অফিস, শপিং, হলুদ, বিয়ে সব মিলিয়ে গত কয়েকদিন রেস্ট নেই ঘুম নেই একদম। রিয়ার মনে হচ্ছে কত বছর সে ঘুমায় না। পরদিন সকালে রিয়ার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেলো। দেরি করে ঘুম থেকে উঠে রিয়া নিজেই লজ্জিত হলো। রাসেলের বড় দুই ভাবী রয়েছে। রিয়া তাদের কাছে যেয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে দেরি করে উঠার জন্য সরি বললো। পাশের এক আত্মীয় এসে বললো, 'এই যে নতুন বউ, শ্বশুরবাড়িতে এতো দেরি করে উঠলে হবে? নতুন বউয়ের হাতে নাস্তা খাবো বলে আমরা সবাই বসে আছি।'
রিয়া কিছুটা বিব্রত হলো। রান্নাবান্না করতে রিয়া জানে কিন্তু এতো মানুষের জন্য কখনো রান্না করে নি। তাছাড়া বাসায় মা আর বুয়া সব করে। চাকরি করে এসে রান্না ঘরে ঢুকা হয় না। হুট করে নতুন পরিবেশে এতো সব নতুন মুখের জন্য নাস্তা তৈরী করতে হবে ভেবেই রিয়ার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসলো। আত্মীয়ের দিকে তাকিয়ে কিছুটা হেসে রিয়া রান্না ঘরে ঢুকলো। রিয়ার পিছনে পিছনে বড় দুই জা এসে বললো এই বাড়ির নিয়ম এমনই। নতুন বউ আসলে পরদিন তাকেই সবার জন্য নাস্তা তৈরী করতে হবে। বড় দুই জায়ের সাহায্য নিয়ে রিয়া নাস্তা বানানো শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর একজন আত্মীয় এসে বলে গেলো, 'নাস্তা কি আজকে খেতে পারবো নতুন বউ!' শাড়ি পরে অভ্যস্ত নয় রিয়া। সকালে উঠে ফ্রেস হয়ে শাড়ি পরতে হয়েছে। সেই শাড়ি পরে আবার এখন রান্না করতে হচ্ছে। মাথার কাপড়টা বারবার পরে যাচ্ছিল। বড় জায়েরা বারবার মাথার কাপড় তুলতে তাড়া দিচ্ছিল।
কোনরকমে নাস্তা তৈরী করে সবার সামনে দিলো রিয়া। কেউ খেয়ে ভালো বললো, কেউ টিপ্পনী কাটলো। কেউ রাসেলকে ডেকে বললো চাকরিজীবী বউয়ের হাতে রান্না খাওয়ার শখ থাকলে ভুলে যাও। নাস্তার পর্ব শেষ করে সবাই বউ নিয়ে চুল চেরা বিশ্লেষণে বসলো। রাতে বউয়ের মেকআপ করা ছিলো। মেকআপ ছাড়া বউ কতটা সুন্দর সেটা নিয়ে আলোচনায় বসলো আত্মীয় -স্বজন আর প্রতিবেশীরা। রিয়ার চুল ছোট করে কাটা। বড় চুল সে সামলাতে পারে না তাই কেটে চুল ছোট করে রাখে।
প্রথমে শুরু হলো চুল থেকে, তারপর রিয়ার মুখে দুই একটা ব্রণ আছে সেটা নিয়ে। দুই একজন তাদের মুখ দেখিয়ে বললো আমরা বাবা ওতো কিছু মাখি না, তবুও আমাদের চেহারা কেমন চকচক করছে। এরপর আসলো রিয়ার কথাবার্তা নিয়ে। সবার কথার কেমন চটাং চটাং জবাব দেয়। শিক্ষিত মেয়েদের এই এক স্বভাব! আর কিছু পারুক বা না পারুক কথা বলতে জানে। রিয়া যদি এখন সবার কথার জবাব না দেয় তাহলে হবে আরেক যন্ত্রনা। সবাই ওকে অহংকারী বলবে। রিয়ার বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে আর কী করবে না।
কেউ কেউ এসে জিজ্ঞেস করছে রিয়া কত টাকা বেতন পায়, কেউ জিজ্ঞেস করছে বিয়ের পর চাকরি করবে নাকি ছেড়ে দিবে! কেউ জানতে চাচ্ছে রিয়া শ্বশুরবাড়িতে থাকবে, নাকি আলাদা বাসা নিবে! কেউ এসে বলছে তুমি চাকরি করো, বাচ্চা হলে কী করবা! কেউ এসে বলছে সারাদিন অফিস করলে, ঘর সামলাবে কে! নানান মানুষ, নানান প্রশ্ন, নানান কিউরিসিটি।
গল্পে তো একজন রিয়ার কথা বলা হয়েছে। এমন হাজারো রিয়া রয়েছে যাদেরকে মুহূর্তে মুহূর্তে হাজারো গুণাবলীর পরিচয় দিতে হয়। সেই গুণাবলীর পর্যায় কত টুকু হবে সেটা কেউ জানে না এবং বলেও দিতে পারবে না। তবে সবাই সর্বোচ্চ পর্যায়ের গুণাবলী আশা করে। যে মেয়েটা একটু কম পড়াশোনা করেছে বা উচ্চ শিক্ষিত হয়েও এখন সংসার সামলাচ্ছে তাদেরকেও বিব্রতকর পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়। একজন উচ্চ শিক্ষিত মা যখন তার মেয়ের পড়াশোনায় জোর দেয় তখন তাকে শুনতে হয়, 'তুমি এতো পড়াশোনা করে কী করেছো? সেই তো সংসার সামলাতে হচ্ছে। মেয়েকেও এতো পড়াশোনা না শিখিয়ে সংসারের কাজ শিখাও ইত্যাদি।' যে মেয়েটা একটু কম শিক্ষিত সে তো কখনো মাথা উঁচু করে বা মুখ খুলে কিছু বলতে পারে না।
সবথেকে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় শহরে থাকা বউদের গ্রামে বেড়াতে যেয়ে। চাকরিজীবী বউদের তো আরো বড় সমস্যা। শহরের পরিবেশ আর গ্রামের পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই সহজ শব্দটা অনেকেই বুঝতে চান না। শশুরবাড়ির লোকজনের তাদের ছেলের বউকে নিয়ে যতটা না চিন্তা, তার থেকে সেই বউকে নিয়ে বেশি চিন্তা পাড়া প্রতিবেশী আর আত্মীয় স্বজনদের। অবিবাহিত অবস্থায় মেয়েদের প্রধান শত্রু পাশের বাসার আন্টি, আর বিবাহিত মেয়েদের প্রধান শত্রু শশুরবাড়ির পাড়া - প্রতিবেশী আর আত্মীয় - স্বজন।