একটা মেয়ের জন্য অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া কতটা জরুরী?

  • কামরুন নাহার স্মৃতি
  • মার্চ ২০, ২০১৯

ভদ্রমহিলার সাথে আমার দেখা হয় মাস দুয়েক আগে। এর আগেও বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে তার সাথে কিন্তু তার কথায় আমি প্রায়শই খুঁজে পেতাম হতাশা আর যন্ত্রণার ছাঁপ। আমি নিজে থেকেই দেখা করতে চাই তার সাথে, অনেকটা তার হতাশার কারণ জানার আগ্রহ থেকেই। উনি আমাকে প্রথম দেখাতেই অবাক করে দিয়ে গল্প শুরু করলেন। প্রথম পরিচয়ে কেউ কারো এতোটা কাছে চলে আসতে পারে আমার জানা ছিল না। কথার একপ্রসঙ্গে উনি বললেন, বলো তো একটা মেয়ের সবচেয়ে বেশি কি দরকার? আমি বললাম, আত্ননির্ভরশীলতা।

উনি একটু হেসে বললেন, পুরোটা ঠিক বলোনি। আত্ননির্ভরশীলতার চেয়ে বেশি জরুরী, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া। মেয়েরা প্রতিনিয়ত পরিবার, সমাজ, চারপাশের মানুষের অন্যায় অত্যাচার মুখ বুজে মেনে নেয় এই একটা কারণেই যে সে টাকা রোজকার করে না। আজ সে যতোই অন্যায়ের প্রতিবাদ করুক, অন্যায় - অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস দেখাক না কেন দিনশেষে তাকে সেই পরিবার, সমাজের কাছেই প্রয়োজনে হাত পাততে হবে। এই জন্যই হাজারো অন্যায়েও একটা মেয়ে সাহস দেখায় না, এমন না যে সে ভীষণ ভীতু কিন্তু যে মানুষটা থেকেই সে খাবার পায়, পোষাক পায়, প্রয়োজন মেটায় সেই মানুষটা যতোই অন্যায় করুক ভাগ্যদোষ বলেই সব মেয়ে মুখ বুজে মেনে নেয়। 

আমার স্বামী বাহিরে কাজ করতো, সারাদিন কাজ করে ফেরার পর আমি খুব করে চেষ্টা করতাম তাকে খুশি রাখার জন্য। তিনি না চাইতেও খাবার পানি, গামছা এগিয়ে দিতাম কিন্তু তবুও তিনি সবসময় আমার উপর রাগ দেখাতেন। প্রায়ই আমাকে শুনতে হতো, সারাদিন ঘরে বসে বসে কি বুঝবি! বাহিরে বেরুলে বুঝতি টাকা কামানো কতো কঠিন। আমি মেনে নিতাম উনার কথা, আমি ভাবতাম ঠিকই তো সব, আমি তো রোজকার করিনা উনার টাকাতেই খাই - শখ, আহ্লাদ মেটাই। সারাদিন ঘর ঝাড়া মোছা, সংসার সামলানো, রান্নাবান্না করা, শ্বশুর শাশুড়ির হুকুম তামিল করা, ছেলেকে স্কুলে নেওয়া - আনা সবটা একা হাতেই সামলাই। তবুও শ্বশুর - শাশুড়ি - স্বামীর কাছে শুনতে হয় আমি বসে বসে খাই, সারাদিন করিটা কি! সংসারের এতো কাজে যেখানে আমি নিজেকে দেওয়ার মতো এতোটুকু সময় পাইনা সেখানে ওরা খুঁজেই পায়না আমি সারাদিন করিটা কি, ভাবতেই অবাক লাগে!  

হাত পুড়িয়ে রান্না করেও আমার কপালে জুটেছে অত্যাচার। প্রায় প্রতিদিনই আমাকে দিন শুরু করতে হতো স্বামীর হাতের আঘাতে, যেখানে আমিও চেয়েছিলাম ভালোবাসা। সবার মুখে প্রতিনিয়তই শুনতাম, অন্যের ঘাড়ে বসে খাই। বিয়ের আগে ভাবিকেও বলতে শুনেছি, আর কতোদিন ভাইয়ের ঘাড়ে বসে খাবো। কিন্তু আমি কখনোই চাইনি এ ঘাড় থেকে ও ঘাড়ে বসে জীবন চালাতে। আমি প্রতি পদে পদে অনুভব করেছি, একটা মেয়ের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া কতটা দরকার। সংসারে যদি আমিও কিছু অর্থ দিতে পারতাম তাহলে প্রতিনিয়ত কেউ হিসেব টানতো না সারাদিন করিটা কি কিংবা কথায় কথায় গায়ে হাত। আমার স্বামীকে বেশ কয়েকবার বলেছিলাম বাহিরে গিয়ে কাজ করার কথা কিন্তু রাজি হয়নি, তাতে তাদের সম্মান থাকবে না। কিন্তু আমার মাথায় চেপে বসেছিল আমাকে টাকা আয় করতেই হবে। 

আমি যেহেতু বাহিরে কাজ করতে পারবো না সেহেতু ঘরে  করতে পারি এমন কিছুই ভাবতে হবে। বাবা প্রায়ই একটা কথা বলতেন, প্রতিটা মানুষই কিছু না কিছু পারে। এমন কখনো হয়না যে একটা মানুষ কিছুই পারেনা! আমার মনে হলো, আমি তো বিয়ের আগে পুতি দিয়ে ব্যাগ বানানোর কাজ শিখেছিলাম আর যেহেতু পড়াশোনা জানি দু'চার জনকে পড়াতেও খুব বেশি সমস্যা হবে না। আমি পাশেরই এক দোকানীর সাথে কথা বলি এ বিষয়ে তারপর থেকে শুরু করি স্বাবলম্বী হওয়ার লড়াইয়ে।

কয়েকমাসের ব্যবধানে আমি সংসার খরচের বেশকিছু টাকা দিতে শুরু করি। আমার সংসারে এখন আর রোজ অশান্তি হয়না, কথায় কথায় গায়ে হাত তুলে না স্বামীও কিংবা কথার বাণ ছোড়ে না শাশুড়ি। আমি চাই মেয়েরা স্বাবলম্বী হোক, নিজের পায়ে দাঁড়াক, অন্যের টাকায় চলতে হবে ভেবে অন্যায়ের সাথে আপোষ না করুক। কিন্তু আবার এইদিকটাও ভেবে দেখতে হবে, আমি উপার্জন করছি বলেই সবার মাথা কিনে নিয়েছি তা কখনোই ভাবা যাবে না বরং আমি উপার্জন করছি মানে আমি মেয়ে হিসেবে কোন অংশে কম বই, অবহেলা কিংবা অবজ্ঞা করার কোন জায়গা নেই কারণ আমি মানুষ।

কিন্তু এতো কিছুর পরেও আমি সমাজের চোখে ভীষণ অপরাধী, বেপরোয়া। চারপাশের মেয়েরা যখন বলে আপনার মতো আমিও স্বাবলম্বী হবো তখন আমার মনে হয় আমি স্বার্থক। মেয়েদের সারাদিন ঘরের কাজের মূল্য কোথাও নেই। অথচ স্বার্থপর এই মানুষদের কাছে টাকা ছাড়া কোন মূল্য নেই, সম্পর্কগুলোও আজকাল টাকার অঙ্কে মাপা হয়। একথাগুলো ভাবলেই হতাশায় ডুবে যায় প্রতিনিয়ত।  মেয়েদের সমস্ত বাঁধা বিপত্তি ঠেলে এগিয়ে যেতে হবে। কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলাম। সত্যিই তো সংসারে একটা মেয়ে কতদিক সামলায়, কতোটাই বা মূল্য দিই আমরা তার! সব হিসাব কি আর টাকার অঙ্কে হয়।

Leave a Comment