ভালোবাসা যখন হাসি- আনন্দ না হয়ে গলার ফাঁসি হয়! 

  • কামরুন নাহার স্মৃতি
  • মার্চ ২৬, ২০১৯

ভালোবাসা যখন হাসি- আনন্দ না হয়ে গলার ফাঁসি হয় তখন নিজের আপন মানুষগুলোকে সময় দিন, অনুভূতি শেয়ার করুন দেখবেন জমানো কষ্ট কমে যাবে, জীবন হবে সুন্দর।

স্বপ্নিল আর তমার প্রেমের আনন্দঘন তিন বছর অতিবাহিত হয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। আজ তাদের প্রেমে শুধুই বিরহের কালো ছায়া আর কান্নার লোনাজল। স্বপ্নিল আর তমার প্রেম শুরু হয় তিন বছর আগে কলেজে পদার্পনের পর। স্বপ্নিল কলেজে যাবার বেশ কিছুদিন পর থেকেই একটা মেয়ের প্রতি ভীষণ রকম দূর্বল হয়ে পড়ে। এভাবেই কেটে যায় প্রায় ছয়মাস, তারপর একদিন সামনেপিছনে না ভেবে প্রপোজ করে বসে তমাকে! তমা বেশ কিছুটা সময় নিয়ে একদিন সায় দেয় স্বপ্নিলের একতরফা ভালোবাসায় আর শুরু হয় প্রেম। দুজন দুজনকে ভীষন রকম ভালোবাসে, সম্মান আর বিশ্বাসও করে। 

কিন্তু তিনবছরের মাথায় তমার পরিবার প্রেমের বিষয়টা জানতে পেরে অনেকটা চুপিচুপি বিয়ে দেওয়ায় চেষ্টা শুরু করে। তমা খুব চেষ্টা করেও বিয়েটা আটকাতে পারেনি, কান্না কিংবা বিরহবেদনা বিয়েটা বন্ধ করতে পারেনি কোনভাবেই। বাবা - ভাইয়ের সবচেয়ে আদরের  তমা, যার জন্য সবাই জীবন দিতেও প্রস্তুত। অথচ সময়ের ব্যবধানে তমাই সবার চক্ষুশূল। তমাকে যে মানুষগুলো কখনো ফুলের টোকা দিতে দেয়নি কষ্ট পাবে ভেবে, সেই মানুষগুলোই দিনরাত তমাকে শারীরিক আর মানসিক নির্যাতন করে যাচ্ছে, বিয়েটা হয়ে যায় তমার। স্বপ্নিল বিষয়টা জানতে পেরে অনেকটা মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা হয়। ভালোবাসার তিনটি বছরের স্মৃতি দিনরাত তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে, সময়ে অসময়ে সাথী যেন ইশারায় কাছে ডাকে মুরাদকে। স্বপ্নিল ধীরে ধীরে পড়াশুনাটাও ছেড়ে দেয়, পড়াশুনায় সে আর আগের মতো আর আগ্রহ খুঁজে পায়না। 

কেমন যেন সবকিছু কেউ উলটপালট করে দিয়ে গেছে, আগের সেই স্বপ্নিলে চাইলেও সে ফিরে যেতে পারেনা আর পারেনা  স্মৃতি ভুলে নিজেকে নতুন করে সাজাতে। স্বপ্নিল নিজের উপর ধীরেধীরে আয়ত্ত হারিয়ে ফেলে, তমার স্মৃতির তাড়ায় একসময় দিশেহারা হয়ে পড়ে। নিজেকে কিছুটা সময়ের জন্য পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট থেকে দূরে সরানোর জন্য স্বপ্নিক একসময় আশ্রয় নেয় মাদকের। সময়ের সাথে সাথে স্বপ্নিল মাদকের সাথে জড়িয়ে ফেলে নিজেকে আরো থেকে আরো। আস্তে আস্তে স্বপ্নিল আর মাদক হয়ে উঠে একে অপরের খুব আপনজন আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে মুরাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে কাছের মানুষদের সাথে, ভেঙ্গে যেতে থাকে বাবা মায়ের যত্নে লালন করা সব স্বপ্ন। 

তমার প্রেমের হাসৌজ্জল ঠোটটা ইদানীং পুড়ে কালো হয়ে যায় দহনে দহনে। এই দহনে স্বপ্নিল একটুও স্বস্তি পায় কিনা সে নিজেও জানেনা। মন যতবার স্বপ্নিলকে বলে উঠে মাদক কখনো কারো বন্ধু হতে পারেনা, এই দহন কখনো শান্তি এনে দিতে পারবে ততবারই মনকে শাসিয়ে চুপ করে দেয় কারন তার শান্তি অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে, তমার বিদায়ের সাথে সাথেই। এখন আর নতুন করে শান্তি হারানোর ভয় তার নেই। পরিবার পরিজন, আপনজন, কাছের মানুষ, রক্তের সম্পর্কগুলো একসময় গুলিয়ে ফেলে মাদকের সাথে। স্বপ্নিল ইদানীং ছাইপাঁশ গিলতে শুরু করেছে, সিগারেটের দহনে এখন আর তার অশান্তি পুরে ছাই হয়ে যায় না তাই একসময় বেছে নেয় তার চেয়েও মারাত্মক পথ। এখন স্বপ্নিল একজন মাদকাসক্ত মানুষ, মাদক ছাড়া যার একমুহূর্ত চলে না। বাবা মায়ের কান্নার লোনাজল আর দীর্ঘশ্বাস - আর্তনাদ মিশে যায় বাতাসে। মাদক গ্রহনের পর থেকেই স্বপ্নিলের মেজাজের ভোল্টেজ হাই পাওয়ারে থাকে। মা, বাবা, ভাই, বোন যে যাই বলুক একগাদা কথা শুনিয়ে দেয়। কথায় কথায় রেগে যাওয়া আজকাল স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবনের সমস্ত সুখ নিংড়ে নিয়েছে মাদক।

স্বপ্নিলের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে যে কারো সংসারে, যে কারো আপন মানুষের মাঝে বেড়ে উঠতে পারে। আপনার খুব কাছের মানুষটি হতে পারে স্বপ্নিল। তাই খুব কাছের মানুষগুলোকে সময় দিন, জানার চেষ্টা করুন তার লুকিয়ে কান্না আর দীর্ঘশ্বাসের কারন। একটু আলাদা সময় রাখুন প্রিয়মানুষদের জন্য। আপনার একটু অবহেলা হতে পারে কারো মাদকাসক্তির পথ। সকল ব্যস্ততা সেড়ে খোঁজ নিন প্রিয় মানুষটার কিংবা আপনার সন্তানের। প্রাণখুলে নিজে কথা বলুন এবং তাকেও প্রাণখুলে কথা বলার সুযোগ দিন যাতে সে তার সমস্ত কষ্ট, যন্ত্রনা, অনুভূতি আপনাকে বিনা দ্বিধায় বলতে পারে।

আপনার সন্তান বা কাছের মানুষ কোথায় কি করছে তার খোঁজ নিন। কোনরকম সন্দেহজনক কিছু জানলে জানার চেষ্টা করুন এবং খুব শান্তভাবে তাকে সেই জিনিসটার ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরুন যাতে সে এটা থেকে বিরত হতে পারে। আপনার সন্তান বা বন্ধু বা ভাই বোন বা কাছের মানুষ কারো দ্বারা মাদকের প্রতি আসক্ত হচ্ছে কিনা তা বোঝার চেষ্টা করুন। কোনরকমভাবে বুঝতে পারলে তা থেকে আপনজনকে দূরে রাখার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন।

নিজের মতামত, ইচ্ছা কারো উপর চাপিয়ে দিবেন না হোক সে আপনার সন্তান বা আপনজন। কারন কেউ চায়না তাকে জোর করা হোক যাতে সে নিজের ইচ্ছাটাকে প্রাধান্য দিতে না পারে। বরং আপনি মাদকের মারাত্মক দিকগুলো আলোচনা করুন যাতে সে নিজেই বুঝতে পারে এই মারাত্মক পথ থেকে দূরে যাওয়া উচিত। প্রেমিকা বা অন্য কেউ আপনাকে ছেড়ে চলে গেলো বলে আপনি নিজের জীবনে দাবানলে আনবেন এটা নিশ্চয় বুদ্ধিমানের কাজ নয়! একটা কথা আমাদের মনে রাখা উচিত যে,  ভালোবাসা বাঁচতে শেখায়, ধুঁকে ধুঁকে নিজেকে শেষ করতে নয়। ভালোবাসা মানুষকে নতুন জন্ম দেয়, মা বাবার কোল থেকে কেড়ে নেয়না! মানুষ মাত্রই কষ্ট আছে, থাকবে তাই বলে নিজেকে সবার অগোচরে তিলে তিলে শেষ করা কাজের কথা নয়।

আমরা সবাই জানি মাদক এক মারাত্মক ব্যাধি। যা একবার আক্রমণ করলে তাকে নিঃশেষ করে দেয় তারপরও আমরা জেনেশুনে কেনো পা বাড়াবো সেই পথে? সুন্দর সুখী জীবনের স্বপ্ন সবাই দেখে অথচ মাদকের কড়াল গ্রাস কেড়ে সুন্দর সুখী জীবনের স্বপ্ন। আপনি যদি বলেন ভালোবাসা না পাওয়ার তীব্র যন্ত্রনা, প্রেম হারানোর বেদনা, হৃদয়ে আশ্রয় দেওয়া মানুষটাকে হারানোর বেদনা থেকে একটু শান্তির আশ্রয় পেতে কিংবা ভুলে থাকতে বেছে মাদকের মতো এমন মারাত্মক পথ। তাহলে আমি বলবো আপনি স্বার্থপর, না হলে কেউ গর্ভেধারন থেকে শুরু করে জন্ম, লালনপালন আর বড় করে তুলল তার ভালোবাসার মূল্যের কাছে আপনার দু'চার দশবছরের ভালবাসা বেশি মূল্যবান হয়ে গেল!

যে মা নিজে কষ্ট সহ্য করেছে অথচ আপনাকে কষ্ট সহ্য করতে দেয়নি তার কথা না ভেবে কয়েকদিনের সম্পর্কের জন্য মাদকের কড়াল গ্রাসে নিজেকে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন আর জলাঞ্জলি দিচ্ছেন বাবা মায়ের স্নেহের চাদরে জড়ানো স্বপ্ন।জীবনে ঝড় আসবে আর তা একদিন কেটেও যাবে। কখনো দেখেছেন যে আকাশে মেঘ করলে আর সূর্য ওঠে না। একসময় আকাশ ঢেকে যায় কালো মেঘে কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই আকাশেই ঝলমল করে লাল সূর্য। এ থেকে কি আমরা শিক্ষা পাইনা যে, জীবনে কিছুই চিরস্থায়ী নয়। আজ আপনার পাশে কেউ নেই, কষ্ট আর যন্ত্রনা আপনার একমাত্র চিরসঙ্গী কিন্তু একটু ধৈর্য্য ধরুন আপনার আকাশেও ঝলমলে সূর্য উঠবে। তারজন্য চাই শুধু একটু মাত্র অপেক্ষা, ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা। মাদকতা কোন সমাধান নয় বরং সমস্যার আবার নতুন করে পদার্পণ। পরিবার পরিজন থেকে আলাদা করার পন্থা, কাছের সম্পর্কগুলোতে চির ধরা। মাদকতা কখনো আপনাকে কষ্ট ভুলিয়ে রাখতে পারেনা কিংবা আশ্রয় হতে পারেনা একটু শান্তির বরং এটা কেড়ে নেয় জীবনের সমস্ত রং, আনন্দ, সুখ।  

Leave a Comment