ভাত খাওয়া থেকে ট্যাটুঃ আমরা কোথায় যাচ্ছি ?

  • মারুফ ইমন 
  • এপ্রিল ১৯, ২০১৯

সকালে পত্রিকায় দেখলাম, ‘বাদশা ট্যাটু’ কে গ্রেফতার নিয়ে সংবাদের শিরোনাম। বিস্তারিত ছিল এমন- 

'একজন অর্ধউলঙ্গ নারীর শরীরে হাত দিয়ে মেসেজ করা ও কুরুচিপূর্ণ কথা বলার ভিডিও তৈরি করে তা ভাইরাল করার অপরাধে এক যুবককে গ্রেফতার করেছে ডিএমপির সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ দমন বিভাগ। গ্রেফতার হওয়া যুবকের নাম মো. তরিকুল ইসলাম বাদশাহ ওরফে বাদশা ট্যাটু । তরিকুলের বিরুদ্ধে রমনা থানায় পর্নগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা করা হয়েছে। বুধবার তাকে আদালতে পাঠিয়ে চার দিনের রিমান্ড চাইবে পুলিশ।'

খুব সম্ভব আগের রাতেই ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি আমার নজরেও এসেছিল। একইসাথে দুটি ব্যপারের সমন্বয় খেয়াল করলাম। একটি হল – আমরা সোসাল নেটওয়ার্কিং ব্যবহার করে আসলে কোথায় যাচ্ছি আমরা বোধহয় জানিনা আর পরেরটি হল সাইবার অপরাধ দমন এখন খুব সক্রিয়। বাদশাহর অপরাধ যদি কুরুচিপূর্ণ ভিডিও আপলোড হয়, তবে বোধকরি তারমত অপরাধী আরো বেশ কয়েকজন রয়েছে। তারচেয়েও বড় কথা, কুরুচিপূর্ণ কনটেন্টও অনেক আছে যেগুলো জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। 

যেমন কয়েকদিন আগেও একটা ভিডিও দেখলাম, যেখানে একজন পুরুষ তার স্ত্রী কিংবা বোনসহ ভাত খাচ্ছে ও কিভাবে ভাত খাচ্ছে, কি দিয়ে খাচ্ছে বা খাওয়ার পর কিভাবে হাত ধুচ্ছে সেসব দেখাচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্য থ হয়ে গেলাম এটা দেখে সেখানে লক্ষ লক্ষ ভিউস। মানে একটা নিত্যকার ঘটনার বাজে পরিবেশনা সামাজিক মাধ্যমে আপলোডও হচ্ছে আবার আমরা সেটা দেখছি বা দেখতে হচ্ছে।  তার চেয়েও বড় কথা তাদের কথা বলার অশুদ্ধতাকে সামাজিক মাধ্যমে অনেক মার্জিত মানুষকেও দেখলাম অনুকরণ করতে। এটাই শুরু বা শেষ নয়। নির্বাচনকালীন সময় 'খুশিতে, ঠেলায়, ঘোরতে’র ব্যাপক ব্যবহার আমরা দেখেছি, হেসেছি। এভাবেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি এক আজব ও অনিশ্চিত ভার্চুয়াল সামাজিক ভবিষ্যতের দিকে।

বলা হয়, বুদ্ধি বিবেচনায় এসব কুরুচিপূর্ণ বিষয় বন্ধ না হলে আনা হয় আইনের আওতায়। সে হিসেবে সাইবার অপরাধ আসলে কি? সহজভাবে বললে, ফেসবুকে বা কোনো গণমাধ্যমে কাউকে নিয়ে মানহানিকর বা বিভ্রান্তিমূলক কিছু পোস্ট করলে, ছবি বা ভিডিও আপলোড করলে, কারও নামে অ্যাকাউন্ট খুলে বিভ্রান্তমূলক পোস্ট দিলে, কোনো স্ট্যাটাস দিলে কিংবা শেয়ার বা লাইক দিলেও সাইবার অপরাধ হতে পারে। কাউকে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে হুমকি দিলে, অশালীন কোনো কিছু পাঠালে কিংবা দেশবিরোধী কোনো কিছু করলে তা সাইবার অপরাধ হবে। আবার ইলেকট্রনিক মাধ্যমে হ্যাক করলে, ভাইরাস ছড়ালে কিংবা কোনো সিস্টেমে অনধিকার প্রবেশ করলে সাইবার অপরাধ হতে পারে। এ ছাড়া অনলাইনে যেকোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হলে তা-ও সাইবার অপরাধ। 

সেক্ষেত্রে আইনের সীমাবদ্ধতা কোথায়? ফেসবুকে কোন ধরনের আপত্তিকর পোস্ট সাধারণত স্পন্সরড আকারে আসে। অর্থাৎ যারা এসব আপত্তিকর ভিডিও এবং ছবি ছাড়ে তারা এর প্রসারের জন্য ফেসবুককে ডলারে পেমেন্ট করে। ফেসবুক তাদের জন্য বিজ্ঞাপনের কাজ করে। এ ধরনের স্পন্সর অ্যাড পুলিশের পক্ষে কন্ট্রোল করার সুযোগ নেই। তবে তাদের কাছে যদি আপত্তিকর এসব পোস্টের প্রভাব-সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ আসে আমরা সেসব পোস্ট ও ওয়েবসাইটের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ফেসবুককে জানাতে পারে। অনলাইন ব্যবহার করে কেউ কোন অপরাধ করলে সংক্ষুব্ধ/ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাক্তি/প্রতিষ্ঠান থানায় অভিযোগ করতে পারে। 

উক্ত অভিযোগ এর ভিত্তিতে অথবা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং টিমের পর্যবেক্ষণে যদি অপরাধ হয়েছে বলে যুক্তিসংগত কারন থাকে তাহলে অপরাধীর বিরুদ্বে আইনগত পদক্ষেপ নিবে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে অবহিত করে মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু করতে পারবেন। পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা (ওয়ারেন্ট) ছাড়াও গ্রেপ্তার করতে পারে।এ অপরাধ কিন্তু জামিন অযোগ্য। কোনো অপরাধী, ব্যক্তি বা সংগঠনের ফেসবুক, স্কাইপ, টুইটার বা ইন্টারনেটের যেকোনো মাধ্যমের অপরাধ-সংশ্লিষ্ট আলাপ-আলোচনা ও কথাবার্তা অথবা অপরাধ-সংশ্লিষ্ট স্থির ও ভিডিওচিত্র অপরাধের আলামত হিসেবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আদালতে উপস্থাপন করতে পারবেন। এবং আদালতে আমলযোগ্য হবে।অর্থাৎ সাক্ষ্য আইনে যাই থাকুক না কেন, মামলার স্বার্থে তা আদালতের গ্রহণযোগ্য হবে। অপরাধ প্রমাণিত হলে, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) এর ৫৭ (দুই) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে অপরাধ করিলে তিনি শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং ১ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় আট কোটি। তাদের মধ্যে প্রায় আড়াই কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছেন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নিষিদ্ধ এসব ভিডিও ও ছবির প্রতি তরুণ-তরুণীরাই বেশি আকৃষ্ট হচ্ছেন। আর সেসবে যদি এড স্পন্সর থাকে তবে তো বিপদের মাত্রা আরো উপরে।

আইন আর গ্রেফতার কোন কিছুর স্থায়ী সমাধান না। এর আগেও থেকে যায় রুচি আর মূল্যবোধের ব্যপার। উন্নত বিশ্বে প্রায়ই দেখা যায়, শিশু বা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য হুমকি হতে পারে এমন কোন কিছুকে তারা ভাইরাল করেন না, সচেতনভাবে এড়িয়ে যান। আমাদের জন্য ব্যাপারটি ঠিক উল্টো। আশা করা যায়, স্রোতে গা না ভাসিয়ে রুচি আর বাঙালি মূল্যবোধকে আকড়ে ধরে আমরা এই কঠিন সময় পার করতে পারবো।
 

Leave a Comment