ডিপ্রেশন আসলে কী? কেন হয় এই ডিপ্রেশন?

  • ফারজানা টুম্পা
  • জুন ১২, ২০১৯

ডিপ্রেশন বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত একটি শব্দ। কিশোর কিশোরী, তরুণ তরুণী, এমনকি মধ্যবয়সী সকলের মুখেই কম বেশি এই শব্দটা শোনা যায়!

এই ডিপ্রেশন আসলে কী? কেন হয় এই ডিপ্রেশন অথবা এর লক্ষণগুলোই বা কী! 

যদি আমরা ডিপ্রেশনের খুব কাছাকাছি বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজতে চাই, সবার আগে আসবে ‘অবসাদ’ শব্দটি। অবসাদ – এই শব্দটির সাথে যে দুঃখ বা বিষাদ লেগে থাকে, সর্বনাশা রোগটিও ঠিক সেইরকমই। ডাক্তারী মতে যা ডিপ্রেশন বলে পরিচিত, তার পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে মনখারাপ আর ভাল না লাগা। যে বিভিন্ন আঙ্গিকে  ডিপ্রেশন বা অবসাদ রোগটিকে বোঝবার চেষ্টা করা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র দেওয়া নিয়মাবলী। এই নিয়মাবলী অনুযায়ী, অবসন্ন মন (‘লো মুড’), শক্তিহীনতা (‘লো এনার্জী’) এবং উৎসাহহীনতা (‘লো ইন্টারেস্ট’)-কে ডিপ্রেশনের আওতায় ফেলা হয়েছে। আরেকটু গভীরে গিয়ে, বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী অ্যারন বেক-এর তত্ত্ব অনুযায়ী, নিজের, পরিবেশের এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা এর সম্মিলিত প্রকাশই হল ডিপ্রেশন। অবশ্য, শুধু নেতিবাচক ধারণা থাকলেই চলবে না, রোজকার জীবনে তার প্রভাবও পড়া চাই। বই-এর ভাষায় যাকে বলে – ‘Significant Socio-occupational impairment’।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র আরও একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, "বর্তমানে ডিপ্রেশন সবচেয়ে প্রচলিত একটি অসুখ যা কিনা মানসিক অস্থিরতা থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে।পৃথিবীতে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন মানুষ ডিপ্রেশনে আক্রান্ত!"

একটা বিশাল জনগোষ্ঠী নিজেদের অজান্তেই ডিপ্রেশন ভেতরে দিয়ে জীবনযাপন করছেন! এখন কথা হলো, ডিপ্রেশন আসলে কাদের হয়?
পুরুষের তুলনায় নারীদের ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেশনের উপসর্গগুলো নিম্নরূপঃ

১. বিষন্ন অথবা খিটখিটে মেজাজ।

২. পূর্বে যেসব বিষয়ে সুখানুভূতি হতো সেসব বিষয়কে বিরক্তিকর লাগা।

৩. শারীরিক চাহিদা ক্রমশ কমে আসা।

৪. হঠাৎ করে অস্বাভাবিকভাবে ওজন কমে যাওয়া।

৫. ঘুম না হওয়া অথবা অত্যধিক ঘুম হওয়া।

৬. মানসিক উৎকণ্ঠাবোধ করা। 

৭. মানসিক দক্ষতা কমে আসা।

৮. অকারণে নিজেকে অপরাধী মনে করা।

৯. অবসাদগ্রস্ততা, দূর্বলতা।

১০. আত্মহত্যা প্রবণতা।

এখন জানা যাক এই ডিপ্রেশনের মূল কারণগুলো আসলে কী কীঃ ডিপ্রেশনের মূল কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে ডিপ্রেশন অনেকগুলো জটিল বিষয়ের একটা সামষ্টিক রূপ। আর সেগুলো হলোঃ

#জেনেটিক 

#বায়োলজিক্যাল- নিউরোট্রান্সমিটার স্তর পরিবর্তন

#পরিবেশ

#মানসিক ও সামাজিক পরিবর্তন 

সম্প্রতি অনেকে ডিপ্রেশনকে অনেকটা ফ্যাশানের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। তারা সাময়িক মন খারাপকেও ডিপ্রেশন বলে আখ্যা দিচ্ছেন! রিলেশন ব্রেকআপ হলেই তারা তথাকথিত ডিপ্রেশনে পড়ে যাচ্ছেন। এর ভয়াবহতা কতটুকু তা না জেনেই "আমি ডিপ্রেশন ভুগছি" বলে খামোখা চিৎকার করা মোটেই সমীচীন নয়! 

এরপর আসা যাক কারা ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে বিপদসীমার মধ্যে আছেন :

১. জীবন সংক্রান্ত ঘটনা: মৃত্যুজনিত শোক, তালাক, পেশাগত সমস্যা, বন্ধু এবং পরিবারের সাথে সম্পর্কের অবনতি, আর্থিক সমস্যা, চিকিৎসা সংক্রান্ত উদ্বেগ বা তীব্র চাপ অন্তর্ভুক্ত।

২. ব্যক্তিত্ব: তুলনামূলক কম সাফল্য, প্রতিযোগিতামূলক কৌশলগুলি আয়ত্ব করতে না পারা বা পূর্ববর্তী জীবনযাপনের সাথে যারা বেশি সংবেদনশীল হয়।

৩. জেনেটিক কারণ: ডিপ্রেশন সঙ্গে প্রথম শ্রেণীর আত্মীয়দের ঝুঁকি বাড়ে।

৪. অসুস্থ শৈশব।

৫. কিছু প্রেসক্রিপশনের ওষুধ: এতে কর্টিকোস্টেরয়েড, কিছু বিটা-ব্লকার, ইন্টারফেরন এবং অন্যান্য প্রেসক্রিপশন ড্রাগ রয়েছে।

৬. বিনোদনমূলক ওষুধের অপব্যবহার: অ্যালকোহল এবং অন্যান্য ওষুধের অপব্যবহার দৃঢ়ভাবে বিষণ্নতার সাথে সংযুক্ত করা হয়।

৭. অতীতের কোনো আঘাত ।

৮. দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা এবং অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা। যেমন ডায়াবেটিস, দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধক ফুসফুসের রোগ, এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগ আরো বিষণ্নতা বাড়ে।

উপরিউক্ত উপসর্গগুলো কারো মধ্যে সুপ্তাবস্থায় থাকলে তার ডিপ্রেশনে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকে।

পূর্বেই বলেছি পুরুষের তুলনায় নারীদের ডিপ্রেশনে পড়ার সম্ভাবনা বেশি! কেননা মেয়েদের হরমোন এমনভাবে তৈরি যা খুবই সংবেদনশীল! এছাড়া তাদের শারীরিক গঠনও পুরুষের তুলনায় নমনীয়। কিন্তু আশার কথা, ডিপ্রেশন নামের অসুখটি চিকিৎসাযোগ্য। তিনটে উপায়ে ডিপ্রেশন থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়।

১. পারিবারিক সমর্থন
 
২. সাইকোথেরাপি এটা কথোপকথন থেরাপি নামেও পরিচিত। 

৩. ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা। এটা সাধারণত এন্টিডিপ্রেশনে থাকা রোগীদের জন্য প্রযোজ্য। 

চিকিৎসা এবং প্রতিকারের উপায়ঃ রোগী এবং তার স্বজনদের সাহস দিতে হবে, আশ্বস্ত করতে হবে। সবার উচিৎ রোগীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা, তাকে সময় দেওয়া, সুন্দর স্বপ্ন দেখতে উদ্বুদ্ধ করা। দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে যোগব্যায়াম, প্রার্থনা ও ধ্যান করতে হবে। ভালো সাইকার্টিস্টের কাছ থেকে প্রয়োজনে কাউন্সেলিং এবং প্রয়োজনীয় ঔষধ গ্রহণ করতে হবে। নিয়মিত শরীরচর্চা করা, প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, খোলা পায়ে ঘাসের ওপরে হাঁটার মাধ্যমে ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। 

বর্তমানে প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে করেছে সহজ কিন্তু কেড়ে নিয়েছে বন্ধু-বান্ধবে সমৃদ্ধ সুস্থ সবলীল পারিবারিক ও সামাজিক জীবন! আমাদের অধিকাংশ সময় কাটে মোবাইলফোন কিংবা ল্যাপটপে! এটাও অবসাদগ্রস্ততার একটি অন্যতম কারণ। সুতরাং সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের প্রয়োজনে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করুন, প্রকৃতির কাছাকাছি যান, বই পড়ুন, নিজেকে সময় দিন। জীবন হোক সুস্থ এবং আনন্দময়।
শুভকামনা!

 

Leave a Comment