ধর্ষণ সংবাদে মেয়ের মায়েরা ভয় পেলেও ছেলের মায়েরা লজ্জা পায় না।

  • রোমানা আক্তার - শুদ্ধবালিকা
  • জুলাই ১১, ২০১৯

ধর্ষণ নিয়ে একেকজনের প্রতিক্রিয়া দেখলাম। বেশিরভাগই কন্যা শিশুর মা হয়ে দুঃখ প্রকাশ, মেয়েকে সাবধানে চলার পরামর্শ, আর যাতে কারও মেয়ে না হয় এইসব বক্তব্য। ছেলের মা হয়ে কেউ শঙ্কা প্রকাশ করলো না, ছেলেটাকে সামলে রাখার কথা তেমন কেউ বলছে না, এমনকি আর যাতে কারও পুত্র সন্তান না হয় এই কামনাও কেউ করছে না। কেউ কেউ তো মহল্লায় মহল্লায় পতিতালয়ের দাবি করছে। বিষয়টা অবাক করছে।

আচ্ছা, একটা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে কার দ্বারা? আমি আমার ছেলেকে কেবল ছেলে অযুহাতে যাচ্ছে তাই করার স্বাধীনতা দিয়ে রেখে আমার মেয়েকে যতোই ঘরকুনো করে রাখি না কেন আমার মেয়ে কিন্তু মোটেও নিরাপদে থাকবে না। আমরা মেয়ের বিপদ এড়াতে তাকে সন্ধ্যার আগে ঘরে ফিরতে বলি আর ছেলেটা সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে, গলির মোড়ে আড্ডা দিতে চলে যায় সেই ব্যাপারটা আমরা স্বাভাবিকভাবে দেখি। বলুনতো, সন্ধ্যার পর মেয়েটা রাস্তায় অনিরাপদ কেন? মহল্লার চার পেয়ে কুকুর কামড়ে দেবে এই ভয়ে নাকি গলির মোড়ে আড্ডা দেয়া ছেলেগুলার ভয়ে?

আমরা মেয়েকে কোথাও ঘুরতে দিতে চাইনা কিন্তু ছেলের ট্রাভেলিং ব্যাগটা নিজ হাতেই গুছিয়ে দেই। আমাদের মেয়েটা দূর পথ ভ্রমণে অনিরাপদ কেন? প্রাকৃতিক দূর্যোগের কথা ভেবে নাকি একই স্থানে দলবলসহ ঘুরে বেড়ানো ছেলেদের কথা ভেবে?

একটা মেয়ে ঠিক কি কারণে অনিরাপদ? কাদের জন্য অনিরাপদ? মেয়েটা ভীড় বাসে উঠতে চায় না কেন? রিক্সায়, সিএনজিতে বসে ভয়ে থাকে কেন? আপনি নিশ্চই দায় এড়ানোর জন্য অন্য অনেক কথা বলতে পারেন কিন্তু মূল কারণতো ওই একটাই, 'পুরুষ'। কন্যা সন্তান ধর্ষণ হচ্ছে বিধায় আপনি আপনার কন্যা সন্তানের বাবা মা হয়ে আফসোস করছেন, ভয় পাচ্ছেন, কিন্তু কোন ধর্ষকের জন্য আপনি পুত্র সন্তানের বাবা মা হয়ে লজ্জা পাচ্ছেন না, আফসোস করছেন না। আপনাদের এই মনোভাব পরোক্ষভাবে যে ভিকটিমকেই দোষারোপ করে এবং ধর্ষককে উৎসাহ দেয় সেটা বুঝতে পারেন?

একটা মেয়েকে যতোটা সাবধানে রাখা উচিত তার চাইতেও অধিক পরিমাণে সাবধানে রাখা উচিত ছেলেটাকে। সে কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে বসছে, কি দেখছে, কি শিখছে, কিভাবে সময় কাটাচ্ছে এসব ব্যাপারে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা উচিত। আপনার মেয়েটা যেমন অন্য কারও ছেলের হাতে অনিরাপদ তেমনি অন্যের মেয়েটাও আপনার ছেলের কাছে অনিরাপদ। আমরা সকলেই ভালো সন্তানের বাবা মা কিন্তু এই ভালো সন্তান থেকেই একেকটা ধর্ষকের জন্ম। মেয়েটাকে ছেলে থেকে সাবধানে থাকার পাশাপাশি ছেলেটাকেও শেখান, মেয়েটা যাতে তার কাছে অনিরাপদ না হয়।

মেয়েটাকে সন্ধ্যার আগে ঘরে ফেরার কথা বলার পাশাপাশি ছেলেটাকেও বলেন, অযথা ঘরের বাহিরে আড্ডাবাজী যেনো না করে। মেয়েকে ঘুরতে নিষেধ না করে ছেলের ব্যাগটা গোছানোর সময় বলুন, "তোদের বোনেরাও যাতে ঘুরতে যেতে পারে সেইভাবে নিজেদের আচার ব্যবহার ঠিক রাখিস।" মেয়েটাকে বোরকা পরানোর পাশাপাশি ছেলেটাকে শেখান, "নারীকে সম্মান দিয়ে চলবা।" কোন ধর্ষকের খবর শুনে আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে যতোদিননা শঙ্কিত হবেন, আফসোস না করবেন, ততোদিন ধর্ষণ বন্ধ হবে না। আপনি আপনার ছেলের অবাধ বিচরণকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে কন্যা সন্তানের ধর্ষণ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে তার জন্ম আটকাতে পারবেন ঠিকই কিন্তু ধর্ষণ বন্ধ করতে পারবেন না।

নারীর স্বল্পতায় আপনার আদরের অবাধ্য সন্তান একদিন হয়তো আপনারই উপর আক্রমণ করে বসবে নিজের যৌন চাহিদা মেটাতে। আপনি আপনার মেয়েকে অন্য ছেলের থেকে যতোই দূরে রাখুন না কেন, আপনার ছেলেটাকে যদি সঠিক শিক্ষায় বড় করতে না পারেন তবে আপনার নিজ ছেলের কাছেই আপনার নিজের মেয়েটা নিরাপদ থাকবে না, থাকে না। আমরা হরহামেশাই খবর দেখি, ভাইয়ের হাতে বোনের ধর্ষণ। ঘরে থাকা কন্যাকে নিয়ে আফসোস করার আগে পুত্রটাকে নিয়ে শঙ্কিত হন। আপনার অবহেলা, পুত্র সন্তান নিয়ে মুক্ত চিন্তাই আপনার ছেলেকে আগামী দিনের ধর্ষক বানিয়ে দিচ্ছে না তো?

এই পৃথিবীতে কন্যা সন্তান ততোদিন নিরাপদ নয় যতোদিন পুত্র সন্তানের চলনে বলনে মনোযোগ দেয়া না হবে।

 

Leave a Comment