যৌতুকের যাঁতাকলে আজও বলি মেয়ের পরিবারই!

  • কামরুন নাহার স্মৃতি
  • জুলাই ১৯, ২০১৯

যৌতুক শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তবুও যৌতুক নেওয়া কিন্তু থেমে নেই। যৌতুক নেওয়া হচ্ছে ঠিকই কিন্তু অপরপক্ষ খুব সহজ সমাধান দিয়ে দেয়, এসব কি আর আমাদের লাগবে! এসব আপনার মেয়েরই তো থাকবে। মেয়ের সুখের নামে আজও আমরা সেই যৌতুকই দিয়ে আসছি। কয়েকদিন আগে কথা হলো যৌতুকের যাঁতাকলে পিষে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া এক মহিলার সাথে। যৌতুক যার সব কেড়ে নিয়েছে।

বিয়ের সময় ছেলেপক্ষ জানায় তাদের মেয়েপক্ষ থেকে কিছু চাওয়ার নেই কিন্তু তাদের মেয়ের জন্য তারা যা দেবে তা নিতে তাদের আপত্তি নেই! কথাটা সহজ সাবলীল হলেও, সহজ সাবলীল ছিল না তাদেত চাওয়াগুলো। কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন সুমি আক্তার। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তিনি, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোই সবসময় ব্যথার সাগড়ে ডুবে যায়। যাদের না থাকে হাত পাতার ক্ষমতা আর না থাকে কাউকে হাত ভরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা। তবুও সুমি আক্তারের বাবা মেয়ের সুখের কথা ভেবে নিজের সমস্তটা উজার করে দিয়েছিলেন। অথচ দফায় দফায় সুমিকে বাপের বাড়ি পাঠানো হয় টাকা আনার জন্য। বাপের করুণ অবস্থা, ভাইবোনের অসহায় চাহনি তার কথা বলার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে নিমিষেই। টাকা ছাড়াই ফিরেছে শ্বশুরবাড়িতে আর পেয়েছে গঞ্জনা, তিরস্কার। সুমি আক্তারের স্বামী কখনো তার কথায় পাত্তা দিতো না, বাবা-মা যদি বলে রাত তাহলে রাত আর দিন বললে দিনই।

মায়ের কাছে নিজের ব্যথা বলেও নিস্তার পায়নি সুমি আক্তার। সমাজ, সংসার আর সম্মানের ভয়ে সুমির মা সুমিকে নানা উদাহরণ, ব্যাখা দিয়ে বুঝাতেন মেয়েদের সুখ বলে কিছু হয়না। যত কষ্টই হোক না কেন সংসার ভাঙতে হয় না। মায়ের কথাগুলো পুরোপুরি মেনে নিতে না পারলেও, মায়ের চোখের পানি আর বাবার অশ্রুসিক্ত চোখ তাকে মেনে নিতে বাধ্য করেছে। স্বামীর হাতে প্রতিদিনই জখম হতে হয়েছে সুমি আক্তারের। শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, জা'য়ের কথায় কারণে অকারণে মারতো সুমির স্বামী। সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেলেও সাহস করে নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারেন নি তিনি। বাবা-মায়ের কষ্টের সংসার থেকে শ্বশুরবাড়িতে ভালোমন্দ খাবার, পোশাক দিতে পারে না বলে প্রতিনিয়ত সুমিকে সহ্য করতে হয় তিরস্কার, গঞ্জনা৷

দুই সন্তানের জন্ম দিয়েও সম্মানের সাথে জীবন কাটাতে পারেনি নি সুমি আক্তার। ছেলেমেয়েদের সামনেই কারণ ছাড়া তার গায়ে হাত তুলতো তার স্বামী। একসময় বাবা-মায়ের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করতে বাধ্য করে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। সহ্য করতে না পেরে বাড়ি থেকে পালিয়ে বাপের যান সুমি আক্তার। বাবা-মাকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, স্বামীর সংসারে আর ফিরে যাবেন না তিনি। প্রয়োজন হলে বাবা-মায়ের বাড়ি ছেড়েও চলে যাবেন। বাবা-মা জোর করেনি তাকে।

বেসরকারি এনজিও থেকে লোন নিয়ে মুরগির ব্যবসা শুরু করেন সুমি আক্তার। কাজের প্রতি আগ্রহ আর তার অমানুষিক পরিশ্রম তাকে পৌঁছে দিয়েছেন সফলতার শীর্ষে। আজ তিনি অন্যের প্রেরণা হয়ে আছেন। নিজের কষ্টগুলো আজও ভুলতে পারেন নি সুমি আক্তার৷ তিনি বলেন, আজও আমাকে সেই দুঃস্বপ্নগুল তাড়িয়ে বেড়ায়। আমি স্বস্তি পাইনা। আমি নিজের সন্তান, সংসার ছেড়ে দূরে আছি কিন্তু আজও আমি ভুলতে পারিনা আমার ওপর হওয়া সেই অমানবিক নির্যাতন আর অপমান। আমি চাইনা আর কারো সাথে এমন হোক আর এরজন্য আমাদের মেয়েদের স্বাবলম্বী হতে হবে। মেয়েদের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠাটা খুব বেশি দরকার। দেশ যতোই উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাক না কেন, উন্নত হয়নি আমাদের সমাজের মানুষগুলো, আমাদের চেনাজানা সামাজিক পরিবেশ। মেয়েদের নিজেদের নিয়ে ভাবার সময় এসে গেছে।

কেএস/

Leave a Comment