সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের বৈষম্যমূলক আচরণ

  • রোমানা আক্তার শুদ্ধবালিকা
  • আগস্ট ১৫, ২০১৯

সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের বৈষম্যমূলক আচরণ সেই সন্তানকে যতোটা না প্রভাবিত করে তার চাইতে বেশি প্রভাবিত করে সেই সন্তানের হাত ধরে আগত পরিবারের নতুন সদস্যটিকে। সন্তান তার নিজ জন্ম, লালন-পালন নিয়ে বাবা মায়ের কাছে কৃতজ্ঞ থাকলেও নতুন সদস্যটির কৃতজ্ঞতা বেশিদিন থাকে না, বরং অপমান হিসেবে কষ্ট পেয়ে দূরে সরে যায়। প্রতিটা সন্তানই নাড়ি ছেড়া ধন, কিন্তু সমতা রক্ষায় অনেক বাবা মা'ই অপারগ। ভালোবাসায় ঘাটতি নেই কিন্তু প্রাধান্যের জায়গায় কেউ একজন এগিয়ে থাকে। এক মেয়ের জামাইয়ের সামনে অন্য মেয়ের জামাইকে বেশি খেয়ালে রাখলে কম খেয়াল রাখা জামাইটা শ্বশুরবাড়ি যেতে চাইবে না, চায় না। 

এক ছেলের বউকে বরণ করে ঘরে তুলে অন্য ছেলের বউকে হাটিয়ে নিয়ে আসলে হেটে আসা বউটা শ্বশুরবাড়ির প্রতি নাকোচ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কেউ যদি অতি উদার হয়ে সব মেনে নিতে চায়ও সেক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব পাওয়া মেয়ের জামাই বা ছেলের বউয়ের নানা রকম টিপ্পনিতে সেই মেনে নেয়াটা ধরে রাখা সম্ভব হয় না। তখন নিজের অজান্তেই প্রশ্ন জাগে, "আমি কি ফেলনা?" অথবা "আমি কি বেশি হইছি?"। আত্মসম্মানে বিরাট ধাক্কা লাগে। অনেক বাবা মা ইচ্ছে করেই বৈষম্যমূলক আচরণ করেন, আবার অনেকে না বুঝেই করেন। যারা ইচ্ছে করে করেন তারা বরাবরই নিন্দিত হয়ে থাকেন অপর সন্তানের জামাই বা বউয়ের কাছে, আর যারা না বুঝে করেন তাদের সাথে বিষয়গুলো আলোচনা করলে তারা সন্তানের প্রতি সমতা এনে নন্দিত হয়ে উঠেন। তখন এককালে প্রাধান্য পাওয়া মেয়ের জামাই বা ছেলের বউটা সময় বুঝে অন্যকে ছোট করে টিপ্পনি কাটার জন্য লজ্জা পায়। বিয়ের পর ভাইবোনের মাঝে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার পেছনে এটি একটি কারণ। আজকাল বাবা মায়ের বৈষম্যমূলক আচরণ নিয়ে পারিবারিক  অনেক সমস্যা জানতে পারছি।

খুব ছোটবেলায় মাকে দেখতাম সবকিছুতে ভাইয়ের নাম আগে নিতো, তারপর আমার। আমরা দু'ভাইবোন। কোন খাবার খেতে গেলে মা বলতো, ভাইয়ের জন্য রাখিস, কিন্তু কোন কারণে যদি না রাখতাম অথবা মা খাবার রাখার কথা বলতে ভুলে যেতেন মা এ নিয়ে রাগারাগি না করলেও মন খারাপ করতেন। একই ঘটনা ভাই যখন করতো তখন মা আমাকে বুঝাতেন, "ভাই খেয়েছে, অন্য কেউতো নয়। তোকে আবার এনে দেবো।" বাবার আচরণ নিয়ে আমার কোন বৈষম্য চোখে পড়তো না। 

বাবা বরাবরই তোরা, তোদের, এই শব্দগুলো ব্যবহার করতেন। আদর করে ডাকার সময় দুজনকে একসাথে ডাকতেন, কইরে তোরা? বকার সময় দোষ একজনের থাকলেও দু'জনকেই বকতেন, তোদের জন্য...কিন্তু মায়ের আচরণে আমার মন নেগেটিভ ভাবে প্রভাবিত হতো। একটা সময় বলতে শুরু করলাম, তোমার ছেলে। ঝগড়ার সময় মূল অপরাধী ভাইয়া হলে আমাকে বুঝাতো, "থাক ভাইয়া বুঝে নাই।" কিন্তু আমি হলে আরও অনেক কথা শুনতে হতো। একবার রাগে ভাইয়াকে ইচ্ছে করে গরম স্ত্রী গায়ে লাগিয়ে দিয়েছিলাম, এর আগে ও আমাকে লোহার বল মেরে মাথা ফুলিয়ে দিয়েছিলো। আমি প্রতিনিয়ত মাকে বলতে থাকতাম, "তুমিতো তোমার ছেলের দোষ চোখেই দেখো না। তুমি আমাকে আদরি করোনা।" একদিন মা আমার রাগ খুব ভালোভাবে খেয়াল করলেন। 

মা অসহায়ের মতো বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, "ও বেশ কিছুদিন ধরে এ'কথা বলে। অথচ আমার ভেতরেতো এমন কিছু নেই। আমার ছেলেও একটা, মেয়েও একটা।" আমি রাগে উত্তর দিয়েছিলাম, "সবকিছুতে তুমি ভাইয়াকেই আগে ডাকো, ওকে কিছুই বলোনা। সারাক্ষণ শুধু আমাকেই বকো,ও দোষ করলেও আমাকে বকো, আমি করলেও আমাকে বকো।" আমাকে দুষ্টামী করে বলা হতো, এখনও হয়, আমাকে স্টেশনে কুঁড়িয়ে পেয়েছে। কিন্ত  ভাইয়াকে কুড়িয়ে পাওয়ার গল্প আমি কোনদিন শুনিনি। আমি সেই সময় বিশ্বাস করতে শুরু করলাম আমাকে স্টেশন থেকেই পেয়েছে। মানসিকভাবে এতোটাই ভেঙ্গে গিয়েছিলাম যে আমার মনে হয়েছিল ব্লাড গ্রুপ টেস্ট করালে আমি বিষয়টা আরও স্পষ্ট জানতে পারবো। কিন্তু সেসময় আমি জানতাম না ব্লাড গ্রুপ টেস্ট কই করায়? 

প্রচন্ড রাগে আমি সেদিন দরজা বন্ধ করে বসে ছিলাম। তখন আমি সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। সেদিনের পর থেকে আমি আমার মায়ের আচরণের পরিবর্তন পাই। হয়তো মা নিজেই বুঝে উঠতে পারেননি তার আচরণ আমার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আমার রিএকশন তাকে বুঝাতে সাহায্য করে। আমার মায়ের আচরণ বদলে যায়। ব্লাড গ্রুপ টেস্ট করার আগ্রহটা ভাইয়াকে বলেছিলাম। ও ওর ব্লাড গ্রুপ জানালো, বাবা মায়েরটাও। একদিন বিনামূল্যে ব্লাড গ্রুপ টেস্ট ক্যাম্পেইনে জানলাম আমার গ্রুপ তাদের গ্রুপের সাথে মিলে। আত্মীয়দের থেকে নিজের জন্মকালীন সময়ের গল্প শুনতাম। আমি একবার ছোট খালাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "আমি কি আমার এই মায়ের পেটে ছিলাম?" খালা তখন হাসতে হাসতে বলেছিল, তোর মা কয়টা? আমার খালাতো ভাইয়ের সাথে আমার বয়সের পার্থক্য ছয় মাস। সে নিয়ে অনেক গল্প শুনি। আমি এবার শতভাগ বিশ্বাস করতে শুরু করলাম, স্টেশনের গল্পটা শুধুই গল্প। আমি আমার মায়েরও মেয়ে। ভাই আমার প্রতিযোগি নয়, সহযোগী। আমাদের সম্পর্ক ভালো হয়ে যায় মনের গভীর থেকে। আমি আর আলাদা কিছু ভাবিনা। আমার মা নিজের অজান্তেই এমনটা করতেন। জানার পর শুধরে নিয়েছেন। আমি এখন মাকে কোনভাবেই বলতে পারিনা, তুমি ভাইয়াকে বেশি আদর করো।

তবে সব বাবা-মা আচরণ বদলায় না। সেদিন এক ভদ্রমহিলা জানালেন, তার বরের থেকে তার বোন জামাইয়ের বেতন ভালো, বড়লোক ফ্যামিলি।সেই জামাইয়ের জন্য ঘরে পর্দা, চাদর সব বদলায়, অথচ তার বরের বেলায় নিজে গিয়ে সব করতে হয়। খেতে বসলে মা আগে সেই জামাইয়ের দিকে আপ্পায়নের জন্য এগিয়ে যায়, তার বরকে তিনি নিজে তুলে খাওয়ান। এ নিয়ে মনকষাকষি হয়। মা যখন অসুস্থ তখন তিনি মাকে দেখতে গেলেও জামাই যায়নি। বলেছিল, "আমারতো সবকিছু দেরিতেই হয়, আমি দেরি করেই যাবো। তোমার মা, তুমি আগে যাও।" অসুস্থ্য সেনসিটিভ জিনিস, জামাই কেনো আগে আসেনি এ নিয়ে ভাই বোনেরা যেদিন কথা তুললো তখন অতীত ইতিহাস সামনে দাঁড়ালো। তুমুল ঝগড়া শেষে এখন জামাইয়ের অপমান দেখে মেয়ে নিজেও বাপের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করলো, এদিকে মেয়ের বাপের বাড়ির লোক জামাইকে অন্য জামাইয়ের সামনে ছোট করে জেনে শ্বশুরবাড়ির লোক মেয়েটিকে হরহামেশাই কথা শুনায়।

ছেলের বউ, নাতি নাতনি এসব ক্ষেত্রেও বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ পাই অনেক। দুই বউ একসাথে থাকলেওএক বউয়ের সামনে অন্য বউকে মা বলে ডাকা, গহনা দেয়া, খাবার দেয়া, যেটাকে বলা হয় একজনকে দেখিয়ে দেখিয়ে অন্য জনের জন্য ভালোবাসা উৎলে পড়া, এসব আচরণ বউটাকে শ্বশুর শাশুড়ি প্রতি বিতৃষ্ণা এনে দেয়। যা আমি দু'জনের জন্য পারবো না তা অন্যজনের সামনে করবো কেন?

আসলে, বাবা মায়ের সন্তান অনেকগুলো থাকতে পারে কিন্তু সন্তানের জন্য বাবা মা একজনই। পারিবারিক সম্পর্ক সুন্দর রাখা খুব সহজ। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই অর্থবিত্ত, ছোট বড় হিসাব বাদ দিতে হবে। আমি এমন এক মাকেও চিনি যিনি তার সর্বশেষ সন্তানটিকে পৃথিবীতে আনতে চান নি, স্বামীর জন্য ফেলতেও পারেননি। কিন্তু সেই সন্তানের প্রতি তার ভেতরে কোন দায়িত্ববোধ কাজ করেনা। মা নিজেই বলেন, জন্ম দিয়েছি এই বেশি। ছোটবেলা থেকে বাকি তিন ভাইবোনের সামনে অবহেলিত হতে হতে তিনি এখন পরিবার থেকে আলাদা থাকেন। একমাত্র বাবার সাথেই তার যোগাযোগ হয়। আমরা শান্তি চাই সবাই, কিন্তু শান্তিপূর্ণ আচরণ করতে সবসময় পিছিয়ে থাকি। অন্যের অপমান দেখার নেশা আমাদের সবসময় টালমাটাল করে রাখে।
 

Leave a Comment