কাঁদা ছুড়াছুঁড়ি : চাকরিজীবী বনাম গৃহিনী 

  • ফারজানা আক্তার 
  • আগস্ট ২৯, ২০১৯

ফেসবুকে গৃহিণীদের কিছু গ্রুপ আছে, দাম্পত্য জীবনের গ্রুপ এবং, সংসারের নানান খুঁটিনাটি নিয়েও কিছু গ্রুপ আছে। এই গ্রুপগুলোতে প্রায় দেখি কিছু কর্মজীবী মায়েরা গৃহিনী মায়েদের অপমান করে পোস্ট দেয়, আবার কিছু গৃহিনী মা কর্মজীবী মায়েদের অপমান করে পোস্ট দেয়।
এক পক্ষ ওপর পক্ষকে সার্ফ এক্সেল ছাড়া একেবারে ধুয়ে দেয়। 

বর্তমানে আমরা সবাই নিজের অবস্থানকে বেস্ট মনে করি আর অন্যের অবস্থানকে তুচ্ছ মনে করি। নিজের চিন্তা ভাবনা সেরা আর অন্যের চিন্তা ভাবনা জিরো। 

প্রতিটি ক্ষেত্রের সুবিধা এবং অসুবিধা দুইটিই রয়েছে। সবাই যেমন ইচ্ছে করে গৃহিনী হয় না, তেমনি সবাই ইচ্ছে করে চাকরিও করে না। চাকরিজীবী মায়েদের প্রতি গৃহিনী মায়েদের প্রধান এবং প্রথম অভিযোগ তারা তাদের সংসার ভালোবাসে না, তাদের সন্তানকে ভালোবাসে না! এই অভিযোগের কোন ভিত্তি বা যুক্তি কোনোটাই আমি খুঁজে পেলাম না। 

তাদের এই অভিযোগের ক্ষেত্রে আমার  'মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি' প্রবাদ বাক্যটা মনে পড়ে যায়। সবার সংসার এবং সন্তান সবার কাছেই প্রিয় এবং প্রায়োরিটির  শীর্ষে। একজন মেয়ে যদি তার মেধা শুধু সংসার আর সন্তাদের পিছনে ব্যয় না করে দেশ এবং সমাজের জন্যও ব্যয় করে তার মানে এই নয় সে সংসারী না! সে একজন ভালো মা না! তার মানে এই হতে পারে 'যে পারে সব সকল ক্ষেত্রেই পারে'।  

গৃহিণীদের আরেকটি অভিযোগ চাকরিজীবী মায়েদের সন্তানরা মানুষ হয় না। আমার তো মনে হয় চাকরিজীবী মায়েদের সন্তানরা খুব  অল্প বয়স থেকেই সেলফ ডিপেন্ডেড হয়ে উঠে। নিজের কাজটুকু নিজে করতে শিখে। বাস্তবতা বুঝতে শিখে। তারা একটি নিদিষ্ট সময় মেনে সব কাজ করে। তবে এটাও সত্যি সকল ক্ষেত্রেই ভালো খারাপ উদাহরণ আছে। সব গৃহিনী মায়েদের সন্তানরা যে মানুষ হয়েছে এমন কোন নজিরও নেই।  

এবার আসি গৃহিণীদের প্রতি চাকরিজীবীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে। গৃহিণীরা অলস, স্বামীর টাকায় বসে বসে খায়, সারাদিন অন্যদের নিয়ে গল্প করে, সিরিয়াল দেখে ইত্যাদি অভিযোগ করে থাকেন চাকরিজীবীরা। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও এইরকম নয়। আর স্বামীর টাকা কিন্তু অন্যের টাকা নয়। স্বামী যদি নিজের হয়, স্বামীর ইনকাম করা টাকাটা অন্যের কিভাবে হয়! গৃহিণীরা মোটেও অলস নয়। একটা সংসারের কাজ কিন্তু কম নয়। বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে আসা, নিয়ে আসা, টিউশনে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা, বাজার করা, আর ঘরের সকল কাজ তো আছেই এই কাজগুলোও কোন অংশে কম বা কোন অংশে সহজ নয়। 

অনেকের বাচ্চাটা বেশি দুষ্ট, অনেকে বিশ্বস্ত হেল্পিং হ্যান্ড পায় না, অনেকের স্বামীর কর্মক্ষেত্র নিজের কর্মক্ষেত্র থেকে অনেক দূর হয়ে যায় ইত্যাদি নানান কারণে তাকে তার চাকরি ছেড়ে পুরো গৃহিনী হয়ে যেতে হয়। অনেকের এসব সব ঠিক আছে কিন্তু পরিবার থেকে সাপোর্ট পায় না বা অফিসের পরিবেশে সে কোন কারণে মানিয়ে নিতে পারছে না ইত্যাদি। 

কারো ভিতরের খবর না জেনে বুঝে কাউকে হুট্ করে অপমান করে কথা বলা উচিত না। আমি এমন অনেক মেয়েকে (মেয়ে বললাম কারণ গৃহিণীদের পাশাপাশি অনেক অবিবাহিত মেয়েকেও এই কথা বলতে শুনেছি ) দেখেছি তারা বলে অফিসে কামলা খেটে টাকা আয় করার থেকে স্বামীর কামলা খাটা ভালো। তাদের মন মানসিকতার লিমিটেশন দেখে আমি অবাক হই। সাথে এটা ভেবেও অবাক হই তাদের চিন্তা ভাবনার গন্ডি কত্ত ছোট। 

একজন ভালো রাঁধুনি কখনো ভালো ডাক্তার হতে পারবে না কিন্তু একজন ভালো ডাক্তার অবশ্যই একজন ভালো রাঁধুনি হতে পারবে। এই সহজ সত্যিটা অনেকের মাথায় ঢুকে না। আমার লেখাটা পড়ে অনেকে হয়তো বলবে আমি চাকরিজীবী মায়েদের কথা বেশি লিখেছি। হ্যাঁ! তাদের কথা বেশি লিখেছি কারণ তাদের নিয়েই সমালোচনাটা একটু বেশিই হয়। অনেকে হিংসা থেকেও তাদের সমালোচনা করে থাকে। 

বর্তমানে আমাদের জীবনযাপনের যে খরচ তাতে একজনের ইনকামে কুলিয়ে উঠা কঠিন। তাছাড়া সবথেকে বড় কথা সবার নিজস্ব একটি আইডেন্টিটির প্রয়োজন আছে। দেশ এবং সমাজকে প্রত্যেকের কিছু না কিছু দেওয়ার আছে।

কাঁদা ছুড়াছুঁড়ি আমাদের এক ধরণের নেশা হয়ে গেছে। এই নেশা ভয়ংকর নেশা। এই নেশা থেকে আমরা যত দ্রুত বের হতে পারবো আমাদের তত মঙ্গল। সবাই সবার অবস্থানে বেস্ট হোক এটাই আমাদের সবার চাওয়া হোক। 


 

Leave a Comment