আমরা ঘৃণা করি বেশি, ভালোবাসি কম

  • রোমানা আক্তার শুদ্ধবালিকা
  • অক্টোবর ২৭, ২০১৯

রিনা নামের এক সেক্স ওয়ার্কের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো মালিবাগ রেলগেটে। আমার অনেকগুলো বাজে অভ্যাসের মধ্যে একটি হচ্ছে, সময়ে অসময়ে বস্তিতে গিয়ে ঢু মারা। মালিবাগ রেলগেটে, রেললাইনের দু'পাশ দিয়ে গড়ে উঠা বস্তিতে আমি মাঝে মাঝেই যেতাম। মূলত রেললাইন ধরে হাটা, ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দটা আমার খুব পছন্দ। রেইললাইন, ট্রেন, বস্তি সবকিছু একসাথে পাওয়ার জন্য তাই এখানেই ফিরে ফিরে যাওয়া হতো। বাজে অভ্যাসবশত সেদিনও গিয়েছিলাম সেখানে আর পরিচিত হই রিনার সাথে। তবে রিনা বস্তির মেয়ে নয়, ওর বাসা অন্যকোথাও। এখানে এসেছিলো গাঁজা নিতে। পুলিশের সামনে গাঁজার লেনদেনটা দেখে আমি নির্বিকার হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম, তখন রিনা আমার দিকে এগিয়ে আসে,

- আপু লেখাপড়া করেন?

- হ্যাঁ।

- কোন ক্লাশে?

- অনার্সে।

- আমি এবার এইচএসসি দেবো। এখানে আসছেন কেন?

- এমনি, ভালোলাগে।

- নিয়ম করে আসবেন না। নজরে পরে যাবেন। এভাবে অনেকটা সময় তার সাথে গল্প হয় আমার, হয় মুঠো ফোনের নাম্বার আদানপ্রদান। ধীরে ধীরে জানা হয় অনেককিছু।

একদিন গভীর রাতে রিনা আমাকে ফোন দিলো।

- আপু, আমি সেক্স ওয়ার্কারের জীবনটা থেকে বেড়িয়ে আসতে চাই। কিন্তু এমনভাবে ফেঁসে গেছি যে আমি বের হতে পারছি না।

রিনা দশম শ্রেণীতে তার প্রেমিকের হাতে ধর্ষণ হয়। বন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে এক বাসায় নিয়ে যায় কিন্তু সেই বাসায় কোন অনুষ্ঠান ছিলো না। ছিলো শুধু রিনা আর তার প্রেমিক। ছেলেটা জোর করেই শারিরীক সম্পর্ক করে। প্রেমিক হিসেবে রিনার উপর তার সব অধিকার আছে বলেই ছেলেটার দাবি। সেদিনের সেই ঘটনার পর রিনা ব্রেকাপ করে নেয় কিন্তু ছেলেটি বলে ভিডিও আছে, ব্রেকাপ করলে বিপদ। এক বিপদ এড়াতে গিয়ে একের পর এক বিপদে জড়িয়ে যায় রিনা। ভালোবাসার মানুষের সাথে বিয়ের পর যা হতো তা নাহয় বিয়ের আগেই হয়েছে, ছেলেটাতো আর বিয়ে করতে আপত্তি করছে না, তাই সম্পর্ক কন্টিনিউ করে রিনা। এস.এস.সি পাশ করার পর ওর সেই প্রেমিক ওকে টিউশন না করে পার্টটাইম জব করতে বলে। জবটা হলো, কারও জন্য কেনা সারপ্রাইজিং উপহারগুলো কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির হাতে পৌঁছে দেওয়া। রিনা রাজি হয়ে যায়। সত্যি বলতে ওর হাত দিয়ে উপহারের বক্স হিসেবে লেনদেন হতো ড্রাগস। একদিন এক পুরুষকে উপহার দিতে গিয়ে তার নজরে পরে যায় রিনা। ফলাফল, তার সাথে এক রাত থাকতে হবে।

তখনই রিনা জানতে পারে ওর জবটা আসলে উপহার নয়, ড্রাগস লেনদেনের। পুলিশ কেস, আর ওদিকেতো নিউড ভিডিও আছেই। নিউড ভিডিওটাকে সাহসের সাথে মোকাবেলা করতে চাইলেও পুলিশ কেসটাকে মোকাবেলা করার সামর্থ্য রিনার নেই। ছোট মাথায় বড় বড় চিন্তা সামাল দিতে না পেরে স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। রিনা নিন্মমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। তার পুরো বংশে সেই একমাত্র কলেজ পড়ুয়া। পারিবারিক ব্যাকাপ বলতে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জলজ্যান্ত কয়েকজন মানুষ। যারা সর্বোচ্চ রিনাকে কন্যা হিসেবে অস্বীকার করতে পারবে, অন্য আর কিছু করা সম্ভব নয়।

এভাবে একজন, দুইজন করে অনেকজনের সাথে থেকেছে রিনা। তবে ও যা করতো সব দিনের আলোয়। রাতে লক্ষ্মী মেয়ে হিসেবে ঘরে ফিরতো। উপর মহল থেকে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে রিনাকে ফ্যামিলি থেকে আলাদা থাকার ব্যবস্থা করা হবে। যাতে রাতে সার্ভিস দিতে কোন সমস্যা না হয়। মূলত অসম্ভব রকম সুন্দরী হবার কারণেই ওর ডিমান্ড বেশি। রিনা বলেছিলো, প্রতি সার্ভিসে নেয়া হতো বিশ-ত্রিশ হাজার কিন্তু রিনাকে দিতো মাত্র তিন-চার হাজার। রিনা অবশ্য এই টাকার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলো না। কারণ ও এই পেশাটাকে মেনেই নিতে পারেনি কোনদিন, ফলে ওকে দিয়ে বেশি লাভবান হতো কুচক্রীরা।

আমাকে যে রাতে রিনা ফোন করে সেই রাতে ও একবার বলেছিলো, "ছেলেদের সাথে শুইতে যাই আমি আর বড়লোক হয় মানুষে। কপাল খারাপ তো খারাপ, তাই বলে এতো খারাপ? মুক্তিও পাই না, মরতেও পারি না।" ও আরও বলেছিলো, "একসময় পুলিশের ভয়ে একের পর এক অন্যায় করেছি আর এখন পুলিশের পাহারায় অন্যায় করি।" আমি চুপচাপ ওর কথা শুনছিলাম। আসলে ওকে ওই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য যতোটা ক্ষমতা দরকার তার এক সিকি ভাগও আমার ছিলো না। তবুও আমি কিছু মানুষের সাথে কথা বলেছিলাম, কেউ একজন আমাকে আশ্বাসও দিয়েছিলো কিন্তু সেই আশ্বাস বাস্তবায়নে যা যা করণীয় তা করতে গেলে আমার জন্য বিপদ।

সর্বশেষ রিনার সাথে কথা হয়েছিলো আমার অসহায়ত্ব নিয়ে। অনেকেই আমাকে সাবধান করেছিলো, রিনা হয়তো আমাকেও জড়িয়ে নেবে ওর খারাপ কাজে। কিন্তু আমার ওর প্রতি বিশ্বাস ছিলো। ও সেই বিশ্বাস রেখেছে। আমার সাথে ওর যেদিন শেষ দেখা হয় সেদিন আমরা দু'জনেই খুব কেঁদেছিলাম। রমনা পার্কের ভেতরে যে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আছে তার পাশেই এক বেঞ্চিতে বসে আমরা অঝোরে কেঁদেছিলাম। আমি চাইনি ওর সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ হোক। ও বলেছিলো, "তোমার জীবন সুন্দর আপু, সুন্দর জীবনের মানুষের সাথে আমার উঠাবসা নিষেধ।"

মাঝেমাঝে নিজেকে খুব দুঃখি মনে হয়। চাওয়া পাওয়ার হিসেবে গড়মিল হয়ে মাথাটা এলোমেলো হয়ে যায়, তখন এই মানুষগুলোর কথা আমার মনে পড়ে। মনটা শান্ত হয়ে যায় আমার। কষ্টে হয়তো আছি কিন্তু রিনার মতো মানুষদের কাছে আমার জীবন সুন্দর। সুন্দর জীবনের অযুহাতে ওরা আমাকে ছেড়ে যায়। এর পরেও নিজেকে দুঃখি ভাবছি ভেবে আমার লজ্জা হয়। আমি আবার ফিরে আসি আমার সুখি জীবনে। বলি, "আমি ভালো আছি।"

আমরা প্রত্যেকেই আসলে কারও না কারও কাছে সুখি মানুষ। কিন্তু আমরা নিজেকে নিজে দুঃখি ভাবতেই পছন্দ করি। আমরা অনবরত ছুটতে থাকি, কিসের আশায়, কিসের নেশায় ছুটি জানিনা। কিন্তু ছুটতেই থাকি। আমাদের চাওয়ার কোন শেষ নেই, পাওয়ায় কোন তৃপ্তি নেই। আমরা ঘৃণা করি বেশি, ভালোবাসি কম। কি বিশ্রী একটা ব্যাপার! 

কে/এস

Leave a Comment