সন্তানের উপর কলহ পূর্ণ পরিবারে ৬ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া

  • তামান্না ইসলাম
  • নভেম্বর ২০, ২০১৯

পরিবার বলতে আমরা সবাই বুঝি এমন একটা আশ্রয় যেখানে বাবা মা, ভাই বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানি, এমন কাছের মানুষগুলো আমাদের ঘিরে থাকে। আমাদের বেড়ে উঠার পথে তারা আমাদের ভালোবাসা পূর্ন নিরাপদ আশ্রয় হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে সব সময় পরিবার মানেই নিরাপদ আশ্রয় হয় না। অনেক পরিবারে বিভিন্ন রকম কলহ দেখা যায়। আপন মানুষগুলো স্রেফ মৌলিক চাহিদা পূরনের মাধ্যম হয়ে থাকে। একে অন্যের প্রতি মানসিক নির্ভরতা, মানসিক যোগাযোগ একেবারেই থাকে না! পারিবারিক কলহের সবচেয়ে বাজে প্রভাব পরে ঘরের সন্তানদের উপর। তারা এই কলহের মাঝে নিজের মতো করে থাকতে পারে না, আবার ঘরের সদস্যদের এমন নেতিবাচক আচরণ মেনে নিতেও পারে না। এমন অবস্থায় সকলের অগোচরে তাদের মনের উপর কিছু নেতিবাচক প্রভাব পরে।

চলুন জেনে নেই পারিবারিক কলহের মাঝে বেড়ে উঠা সন্তানের ৬টি মানসিক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া।

• ব্যবহৃত হবার ভয়ঃ কলহপূর্ণ পরিবারে বেশিভাগ সময় দেখা যায় এক সদস্য অন্য সদস্যদের নিজ অধীনস্হ মনে করেন ও সেভাবে তাদের সাথে ব্যবহার করেন। অন্যকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার এই প্রবনতা ঘরের সদস্যদের মানসিকতায় ভীষণ বাজে রকম প্রভাব ফেলে। বাচ্চারা ক্রমাগত এর শিকার হয় বা তাদের প্রিয় কাউকে এমন অবস্থায় দেখার ফলে অন্যের প্রতি তাদের রাগ ও ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়। ঘরের দ্বায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এমন আচরণ শিশু মনে ভয় ও অনিরাপদ অনুভূতির সৃষ্টি করে। ফলাফল হিসেবে তারা নিজেকে রক্ষার তাগিদে অন্যদের প্রতি পরোয়াহীন ব্যবহার করে বা নিজেকে গুটিয়ে নেয়।

• নিজস্ব পরিচয় উন্নত করার সংগ্রামঃ কলহপূর্ন পরিবারে বড় হওয়া ছেলে মেয়েদের প্রায় নিজস্ব অবস্থান ও আত্মপরিচয় সম্পর্কে লুকোচুরি করার মনোভাব দেখা যায়। এমন মানসিকতার একটা বড় কারন হলো নিজের প্রতি তাদের আত্মবিশ্বাস এর অভাব। এধরণের পরিবারে বাবা-মায়ের প্রায় সময়ই বাচ্চাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার, মেধা, সৃজনশীলতা, বা সীমাবদ্ধতার মূল্যায়ন করে না। সন্তানের উপর নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়। ফলাফল হিসেবে সন্তান আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগে ও ক্রমাগত অন্যের হিসেব অনুযায়ী নিজ আত্মপরিচয় উন্নত করার চেষ্টা করে।

• কাউকে বিশ্বাস করতে না পারাঃ অন্য মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টা সন্তান সর্বপ্রথম বাবা-মায়ের কাছ থেকে শেখে। সেটা আত্মীয়তা হোক, বন্ধুত্ব হোক বা জীবন সাথী নির্বাচনের ক্ষেত্র হোক। যে কোনো সম্পর্কে ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। কলহ পূর্ন দাম্পত্য থেকে সন্তান ক্রমাগত সম্পর্কের নেগেটিভ বিষয়গুলো দেখে, ফলে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে তারা অন্য কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না।

• সামাজিক আলাপচারিতায় সমস্যা তৈরিঃ টেক্সাস ওমেন্স ইউনিভার্সিটির এক জরিপে দেখা যায় যে, যেসকল প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ছেলেবেলার কলহ পূর্ণ পরিবারে বড় হয়েছে তারা চারপাশের জগতের সাথে সামাজিক যোগাযোগ তৈরি করতে পারে না। তারা সারাক্ষণ নিজের নেতিবাচক আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার ভয় পায়। তাই বেশিরভাগ সময় তারা নিজেদের অন্য সবার থেকে লুকিয়ে রাখতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

• অধিক উদ্বিগ্ন থাকাঃ Journal of Behaviour Therapy And Experimental Psychiatry -এর এক জরিপ মতে যে সকল ব্যক্তি ছেলেবেলায় ভয়াবহ পারিবারিক সমস্যা বা কলহের মাঝে বেড়ে উঠেছে তারা পরবর্তীতে মানসিক ভাবে 'অধিক উদ্বিগ্নতা'র রোগে ভোগে। পারিবারিক কলহের মাঝে বড় হওয়া বাচ্চাদের মাঝে প্রায়ই অমিশুক, পড়ালেখায় অমনোযোগ, কাজে অপরিপক্ক, অন্যকে বিশ্বাস করতে না পারার মতো বিষয়গুলো লক্ষ্য করা যায়, কেননা তাদের মস্তিষ্কে সারাক্ষণ স্ট্রেস হরমোন নিঃসৃত হতে থাকে। মাথা ব্যাথা, ঘামতে থাকা, অল্পতেই অধিক চিন্তা করা, সবকিছু অসহ্য বোধ করা, খুব ক্লান্তিবোধ করা, ইত্যাদি অধিক উদ্বিগ্ন থাকার লক্ষন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

• পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরাঃ কলহ পূর্ণ পরিবারে বড় হওয়া সন্তান যখন উপার্জনে সক্ষম হয় তখন প্রায়ই পরিবারের সাথে তাদের দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। আমেরিকান সাইকোলজিস্ট Marie Bowen এর মতে, পরিবারের সাথে দূরত্ব বৃদ্ধি বলতে পরিবারের সাথে অবস্থানগত দূরত্ব তৈরি বা এক সাথে থেকেও সেন্সেটিভ বিষয়গুলো একে অন্যের থেকে আড়াল রাখা বুঝায়। এমন ব্যক্তি পরিবারের সাথে এই দূরত্ব বৃদ্ধিকে তাদের অবিবেচক আচরণের শাস্তি হিসেবে ধরে নেয় ও এই দূরত্বের মাঝে নিজ মানসিক প্রশান্তি অনুভব করে।

পারিবারিক কলহ আমাদের কারোই কাম্য নয়। একসাথে জীবন চলার পথে সমস্যা যেমন আছে তেমনই সমাধানও আছে। যে কোনো সমস্যা নিজেদের মাঝে আলোচনার মাধ্যমে যতো দ্রুত সম্ভব সমাধান করে নেয়াই ভালো। আমাদের একটু ভুল, একটু জিদ, যেনো আমাদের বাচ্চাদের উপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব না ফেলে সে ব্যপারে সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি।

কে/এস

Leave a Comment