করোনায় টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারদের যুদ্ধটা এড়িয়ে যাচ্ছি নাতো আমরা?

  • ফারজানা আক্তার 
  • মার্চ ২৫, ২০২০

বুঝতে পারছি না এই কথাগুলো এখন বলা উচিত হচ্ছে কিনা! কিন্তু তবুও বলছি...

বর্তমানে পুরো বিশ্ব ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করে রীতিমতো ক্লান্ত! তবুও সবাই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। এই যুদ্ধে হেরে যাওয়া মানে মাথা নিচু করে বেঁচে থাকা নয়, এই যুদ্ধে হেরে যাওয়া মানে দুনিয়া থেকেই একদম একা হয়ে বিদায় নেওয়া। 

আমরা সাধারণ মানুষজন ঘরে বসে সতর্ক থাকছি। আর, কিছু অসাধারণ মানুষ রীতিমতো ভাইরাসের মুখোমুখি হয়ে যুদ্ধ করছে। তাদের মধ্যে ডাক্তাররা প্রথম সারিতে আছেন। নিজের জীবনের বাজি রেখে তারা রোগীদের সেবা দিচ্ছেন, কাউন্সেলিং করছেন, নিজেরা আক্রান্ত হচ্ছেন, নিজেরাও জীবন দিচ্ছেন। 

অসাধারণের তালিকায় প্রশাসনের লোকজনেরাও আছেন। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রবাসীদের খোঁজ খবর নিচ্ছে, কোয়ারেন্টিনে পাঠাচ্ছেন, রাস্তাঘাটে ভীড়, জটলা সরিয়ে দিচ্ছেন ইত্যাদি সহ নানান ধরণের কার্যক্রম করে যাচ্ছেন। 

অসাধারণের তালিকায় আছেন রিপোর্টাররা। তাদের মাঠে ঘাটে ঘুরে ফিরে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে হচ্ছে। আমরা ঘরে বসে কোথায় কি হচ্ছে, ভাইরাস কাদের ঘরে কতটুকু হানা দিলো সব পেয়ে যাচ্ছি। 

ভাইরাসের সাথে যারা যুদ্ধ করছে, ভাইরাস যেন কম সংক্রমিত হতে পারে সেই ব্যবস্থা যারা করছে, ভাইরাস সম্পর্কে যারা সঠিক তথ্য তুলে ধরছে তাদের আমরা প্রতিনিয়ত উৎসাহ দিচ্ছে, বাহবা দিয়ে, দোয়া করছি, ভালোবাসা দিচ্ছি। তারা এগুলো ডিজার্ভ করে। এই ভালোবাসা, বাহবা, দোয়া তাদের প্রাপ্ত। নানান পেশার হিরোদের ভিড়ে আমরা আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা হিরোদের ভুলে যাচ্ছি নাতো?

বলছিলাম পোশাক শিল্পের কথা! পোশাক শিল্পকে যারা আঁকড়ে ধরে রেখেছে তাদের কথা। সরকারি, বেসরকারি সব অফিস আদালত বন্ধ হলেও বন্ধ হয় নি গার্মেন্টস। গার্মেন্টসে হাজার হাজার মানুষ কাজ করেন। আল্লাহ না করুক একজন কোন রকমে এই ভয়ংকর ভাইরাসে আক্ৰান্ত হলে বাতাসের থেকেও দ্রুত গতিতে পুরো গার্মেন্টসে ছড়িয়ে যাবে। কতটা ভয়ংকর ঝুঁকিতে আছে গার্মেন্টসে কর্মরত এক একজন মানুষ। 

দেশের অর্থনীতির প্রায় ৮২% আসে পোশাক শিল্প থেকে। এক একটা গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে হাজার হাজার শ্রমিকের ঘরে চুলা জ্বলবে না, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারসহ গার্মেন্টসের নানান সেক্টরে যারা কর্মরত আছেন সবাই বেকার হয়ে যাবে, মালিক পক্ষের মাথায় হাত পড়বে। মানে পুরো মাথা নষ্ট অবস্থা!

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে লিখছেন যারা ভাইরাসে বেঁচে যাবে তারা দুর্ভিক্ষে মরবে! কথাটা কিন্তু একদম মিথ্যা না। দেশে যেন দুর্ভিক্ষ না আসে এই যুদ্ধটা যারা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের আমরা কয়জন বাহবা দিয়েছি, সাহস দিয়েছি, ভালোবাসা দিয়েছি, এবং তাদের জন্য দোয়া করছি?

পোশাক শিল্পে যারা কাজ করে তাদেরও তো পরিবার - পরিজন আছে, তাই না? তাদেরও তো জীবন আছে। তাদেরও তো স্বপ্ন আছে। উন্নত বিশ্বে তারা তাদের পরিশ্রম দ্বারা আমাদের দেশের নাম উজ্জ্বল করে যাচ্ছে। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের নিয়ে, বিভিন্ন খেলোয়াড়দের নিয়ে যেভাবে আমরা কথা বলি, নাচানাচি করি এই পোশাক শিল্পের যোদ্ধাদের নিয়ে তার ছিটেফোঁটাও কি আদৌ করি?

বিবাহসূত্রে আমি একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রী। নিজের ঘরে একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার থাকার কারণে তাদের যুদ্ধটা আমি চোখের সামনে দেখি। প্রতিদিন সকাল ৭-৭.৩০টায় ঘর থেকে বের হয়। তাদের অফিসে যাওয়ার সময় আছে কিন্তু ঘরে ফেরার নিদিষ্ট কোন সময় নেই। ছুটিছাটার কথা আর নাইবা বললাম!

দেশের অর্থিনীতির চাকা তারা সচল রাখে কিন্তু দেশ, দেশের সরকার বা দেশের জনগণ তাদের ন্যূনতম ধন্যবাদ টুকুও দেয় না। দেশের ক্রিকেটাররা ম্যাচ জিতলে প্রধানমন্ত্রী তাদের ফ্ল্যাট বাড়ি জমি জামা দিয়ে দেয়। কখনো শুনেছেন অর্থিনীতির চাকা সচল রাখার কারণে প্রধানমন্ত্রী গার্মেন্টসে কর্মরত সকলের জন্য শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন ?

যুগে যুগে এমনটাই হয়ে এসেছে মনে হয়! সকল যোদ্ধারা সবসময় ভালোবাসা পায় না। সকল যোদ্ধাদের প্রতিনিয়ত সকলে মনে রাখে না। তবে হারিয়ে যাওয়ার পর সকলে সেই ক্ষতটা ঠিক মনে রাখে। এবং এই ক্ষতটা সকলকে ক্ষণে ক্ষণে ভোগাবে। মহামারীর এই সময়ে যারা নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন তাদের সকলকে অনেক অনেক ভালোবাসা এবং দোয়া। 

পোশাক শিল্পের সাথে যারা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন তাদের জন্য আমার এই লেখাটা উৎসর্গ করলাম। আমার এই সামান্য উৎসর্গ করা, না করা নিয়ে কারো কিচ্ছু যায় আসবে না জানি! আমার যদি বেশি কিছু করার থাকতো তবে হয়তো তাই করতাম। আপনাদের নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা নিজেদের করতে হবে। আপনারা নিজেদের সুরক্ষিত রেখে এই যুদ্ধ চালিয়ে চান। মানুষ আপনাদের অবদান মনে না রাখলে উপরওয়ালা আপনাদের অবদানের জন্য নিশ্চয় উত্তম পুরস্কার দিবেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে সুরক্ষিত রাখুক।

Leave a Comment