হে নারী! মনের দাসত্ব থেকে বের হয়ে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠুন 

  • ফারজানা আক্তার 
  • মার্চ ৭, ২০২১

রাত পোহালেই নারী দিবস। নারীদের নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা বলা হবে, কেক কাটা হবে। সফল নারীদের ইন্টারভিউ নেওয়া হবে। পত্রিকার পাতা জুড়ে নারীদের নিয়ে বড় বড় ফিচার লেখা হবে।  

দিনে দিনে আমাদের চিন্তা - ভাবনা, মন - মানসিকতার নানান রকম পরিবর্তন হয়। অতীতের প্রতিটি নারী দিবসে আমার মনে হতো আলাদা করে নারী দিবস পালন না করে একটা মানুষ দিবস পালন করা হোক। কিন্তু এবার আমার চিন্তা - ভাবনাতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। কী কারণে পরিবর্তন এসেছে সেটা অন্য কোন লেখাতে লিখবো। এখন নারী দিবস নিয়ে কিছু কথা বলি। 

আমি ব্যক্তিগতভাবে নারী দিবস পালনের পক্ষে বা বিপক্ষে যাই হই না কেন! নারী দিবস পালন বন্ধ হবে না। তবে আমি সেদিন খুব ঘটা করে নারী দিবস পালন করবো যেদিন আমি দেখবো অধিকাংশ নারী তার নিজের মনের দাসত্ব থেকে বের হতে পেরেছে। আজকে আমি নারীদের গুনগান গাইবো না। নারীদের উদ্দেশ্য করে কিছু কথা বলবো। 

আরো পড়ুন : সব দোষ শুধু মায়ের ? বাবারা কেন দোষের ভাগিদার হন না ?

নিজে  একজন মেয়ে হওয়ার কারণে মেয়েদের সাইকোলজি সহজে বুঝতে পারি। নানান বয়সী মেয়েদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মেয়েদের সাইকোলজি সম্পর্কে মোটামুটি ভালো `অভিজ্ঞতা হয়েছে। ফেসবুকের মেয়েদের গ্রুপও আমার অভিজ্ঞতা অর্জনে বেশ ভালো ভূমিকা রেখেছে। 

নারীর উন্নয়ন, নারীদের  শিক্ষা, নারীদের অগগ্রতি, নারীদের নিরাপত্তা নানান বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত ফেসবুক গরম করছি। নারীকেন্দ্রিক প্রতিটি ইস্যুতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে দোষারোপ করছি। কিন্তু আমরা একবারো ভেবে দেখছি না নারী তার নিজের অগগ্রতি নিয়ে নিজে কতটা সজাগ! নারী তার নিজের প্রতি নিজের দায়িত্ব পালনে কতটা সচেতন! এই ২০২১ সালেও অনেক নারী অন্যের উপর নির্ভর করে চলতে পছন্দ করে।   

ছোট্ট একটি উদাহরণ দেই। পরিচিত একজন আপু ভালো ছাত্রী। প্রাইভেট থেকে পড়াশোনা  করেছেন। বিয়ে করেছেন। তবে স্বামীর আয়ে তিনি সন্তুষ্ট নন। খেয়ে পরে দিন চলে যায়। তবে তিনি বিলাসিতা চান। যেহেতু তার বাবার টাকা পয়সা ছিলো তাই বিয়ের আগে তিনি বেশ বিলাসিতা করেছেন। এখন করতে পারছেন না। এই নিয়ে তিনি প্রায় আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি যখন দুঃখ প্রকাশ করেন তখন আমি তাকে বলি কিছু করার জন্য। শিক্ষিত আছেন, সকল বিষয়ে বেশ ভালো বুঝেন, আবার যেহেতু বিলাসিতা করতে চান তবে নিজে কেন ইনকাম করছেন না! 

আমার কথা শুনে তিনি বলেন কাজের চাপ তিনি নিতে পারবেন না। বিয়ে করেছেন বর তাকে সবকিছু দিতে বাধ্য। তিনি কেন কষ্ট করে ইনকাম করতে যাবেন! একজন মেয়ে যদি ইচ্ছাকৃত পরনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকতে চায় তাকে আত্মনির্ভরশীল বানাবে কার সাধ্য!

আরো পড়ুন : তিন কবুল বলা সহজ, কিন্তু সত্যিকার অর্থে স্বামী হয়ে উঠা কঠিন। 

গার্লস গ্রুপগুলোতে ভালোবাসার দিবস বলুন, বিবাহবার্ষিকী কিংবা জন্মদিন! কমন কিছু পোস্ট, ' আপুরা, আমার স্বামী / প্রেমিক এই দিবসে এটা উপহার বা সারপ্রাইজ দিয়েছে। তোমরা এই দিনে কে কী পেয়েছো জানাও। ' কমেন্ট বক্সে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তারপর এই বিষয় নিয়ে সেই গ্রুপ বেশ কয়েকদিন গরম থাকে। তার মধ্যে অর্ধেক কমেন্ট আর পোস্ট হা হুতাশের আর না পাওয়ার। 

বিশেষ দিনে উপহার কেন শুধু নারীরা পাবে ? বিশেষ দিনে স্বামীরা সারপ্রাইজ দিতে বাধ্য ? নারীদের কোন দ্বায় - দায়িত্ব নেই ? আপনাকে বিয়ে করেছে বলে আপনার বিলাসিতার দায় - দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে ? আপনার নিজের প্রতি আপনার কোন দায়িত্ব নেই ? বা আপনার স্বামী বা প্রেমিক আপনার কাছ থেকে উপহার বা সারপ্রাইজ আশা করতে পারে। 

নারীর উন্নয়ন বলতে কী বুঝায় ? শুধু পড়াশোনা করে সার্টিফিকেট ঘরে নিয়ে এসে জমানো ? উন্নয়ন মানে উন্নয়ন। চিন্তা - ভাবনা, পড়াশোনা, ধ্যান - ধারণা, মন - মানসিকতা, দায়িত্ব - কর্তব্য সবকিছুতে উন্নয়ন। অগ্রগতি মানে অগ্রগ্রতি। চাকরি, ব্যবসা, উদ্যোক্তা সকল কিছুতে নিজেকে প্রমান করা। বিশেষ দিনে উপহারের জন্য অপেক্ষা না করে বিশেষ মানুষের জন্য উপহার রেডি করা । নিজে সারপ্রাইজের অপেক্ষায় না থেকে তার জন্য সারপ্রাইজ রেডি করো। কোন কারণে স্বামীর চাকরি চলে গেলে তার কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করা সংসার চালানোর যোগ্যতা আপনার নিজের আছে। সংসার সাজানো থেকে শুরু করে নিজেদের যৌথ স্বপ্ন পূরণে সমানে সমানে কন্ট্রিবিউশন রাখা। 

মেয়েদের চাকরি করা বা বাহিরে বের হওয়ার ব্যাপারে কিছু মানুষের বেশ এলার্জি আছে। তাদের উদ্দেশ্য বলা যার চরিত্র খারাপ সে ঘরে বসেও খারাপ, বাহিরে বের হয়েও খারাপ। পোশাক পরা, পড়াশোনা এবং চাকরির করার সাথে চরিত্র নষ্ট হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই।  ( এই লাইনটুকু শুধুমাত্র তাদের জন্য যারা মেয়েদের ঘরের বাহিরে পা রাখার সাথে চরিত্র গুলিয়ে ফেলে।  )

আরো পড়ুন : নারীদের লড়াইয়ের শেষ কোথায় ?

বহু বহু বছর ধরে যে সমাজ ব্যবস্থায় আমরা বসবাস করে এসেছি তার পরিবর্তন হচ্ছে। শুরুতে নতুনত্ব অনেকের হজম হয় না। তাই কিছু মেয়ে বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে, কিছু মেয়ে এই পরিবর্তনের সাথে নিজেদের খুব সুন্দরভাবে মানিয়ে নিচ্ছে, কিছু মেয়ে এখনো মনের দাসত্ব থেকে বের হতে পারছে না।  

লর্ড আমহার্স্টের একটি কথা আছে , ' যে কোন সংস্কার তা যত প্রয়োজনীয় হোক না কেন, তার ফলে অসন্তোষের সৃষ্টি হতে পারে। ' সমাজ ব্যবস্থার এই পরিবর্তন অনেকেই  নিতে পারছেন না। এই পরিবর্তন মেনে না নেওয়ার কারণে তারা উদাহরণ হিসেবে বেপরোয়া মেয়েদের দেখাচ্ছে, অপমান করার সময় উদাহরণ হিসেবে টানছে মনের দাসত্ব বরণ করে নেওয়া মেয়েদের। কিন্তু যে মেয়েরা এই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের পরিবর্তন করে সমাজ আর দেশে অবদান রাখছে তাদের তারা উদাহরণ হিসেবে টানছে না। উল্টো তাদের পথকে আরো কঠিন করে দিচ্ছে। 

নারী দিবসে নারীদের প্রতি আমার অনুরোধ আগে নিজেদের মনের দাসত্ব থেকে বের হয়ে আসুন। নিজের  যোগ্যতার প্রমাণ দিন। নিজের মেধাকে সবার সামনে তুলে ধরুন। আত্মনির্ভরশীল হন। আর, বেপরোয়া হয়ে কখনো কেউ নিজের , সমাজের বা দেশের কারো ভালো কখনো করতে পারে নি। এবং কখনো পারবে না।    

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Comment