প্লাটফর্ম

  • এনায়েত হোসেন
  • ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৮

মনে যা আসছে তাই বলছে মেয়েটা। কত্তবড় সাহস মেয়েটার আমাকে এত কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার কি হয়েছে? আমি কেন তাকে কিছু বলতে পারছিনা। আমার মুখে কেউ কি তালা মেরে দিয়েছে। এ কি আশ্চর্য আমি আবার দাঁত বের করে অভদ্রদের মতো হাসছিও। এই মেয়েটির নাম জানি না। এর আগে কখনও দেখিও নি। স্টেশনে বসে ছিলাম কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া। মাঝে মাঝে আমি স্টেশনে এসে বসে থাকি। ভালো লাগে এমন উদ্দেশ্য ছাড়া এই জায়গাটাতে এসে বসে থাকতে। চারপাশে রঙ-বেরঙের অজানা অচেনা মানুষের ভীড় সবসময় লেগেই থাকে। এদের কাছে এসে এসে আমি কিছুটা শক্ত হতে শিখেছি। এই যে মেয়েটা আমায় কত কথা বলছে, তবুও আমি অসভ্যের মতো দাঁতগুলো বের করে হাসছি।

- আপনি হাসছেন কেন? অভদ্র, বেয়াদব।

আমি কেন জানি হাসি ছাড়া আর কিছুই বলতে পারছিনা। চারপাশে কিছু লোক জড় হয়ে আমাকে গালমন্দ করা দেখে তাদের মনের তৃপ্তি মেটাচ্ছে। কিন্তু কেউ আমাকে কিছুই বলছে না। মেয়েটি কপাল কুঁচকে নিয়ে আমার সামনে এতক্ষণ পর স্থির হয়ে দাঁড়ালো। মেয়েটি যথেষ্ট রকম ফর্সা বলেই তার মুখটা লাল টকটকে হয়ে উঠেছে। মেয়েটি আমার সামনে থেকে চলে গেল। আমি আবার আমার জায়গায় বসলাম। মেয়েটি এবার তার জায়গা বদলালো। আশেপাশের লোকজন খানিকক্ষণ কৌতুহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে যার যার অবস্থানে সে সে চলে গেল।

আমি একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে পড়ছি আর আশেপাশের অচেনা অজানা মানুষগুলোকে দেখছি। ফিনফিনে হাওয়া এসে আমার শরীর ছুঁয়ে কোথায় যেন আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি এবার ম্যাগাজিন থেকে মুখটা সরিয়ে আশেপাশের মানুষ দেখবো বলে তাকাতেই সামনে দেখি সেই মেয়েটি। মেয়েটির মুখটা এবারও লাল টকটকে হয়ে আছে। তবে আগের বারের চেয়ে এবার লাল হওয়া মুখের ধরনটা পুরোপুরি ভিন্ন। মেয়েটির মুখটা এবার দেখলাম লজ্জায় লাল হয়ে আছে। মাথাটা নিচু করে আমার দিকে পিটপিট করে তাকাচ্ছে। আমি তাকে আমার চোখের ইশারায় বললাম,

- কি হয়েছে?

মেয়েটি আমার সামনে আর একটু এগিয়ে এসে বললো,

- I am sorry. আসলে আমি একটুও বুঝতে পারি নি যে কাজটা আপনি করেন নি।

- এতটা শিওর কিভাবে হচ্ছেন?

- আপনি কাজটা করলে আমার ওড়নার এই কোণাটা ছেঁড়া থাকতো না। তাছাড়াও পরের বার যখন জায়গাটাতে গিয়ে ব্যাগ নিলাম তখন দেখি একটা তাঁরকাটা দেওয়ালের সাথে আটকানো।

- ও।

- শুধু ও? আপনি এখন আমায় কিছু বলবেন না?

- কি বলবো?

- আমার ওপর প্রতিশোধ নেন। আমি তো এখন আপনার শত্রু। এতক্ষণ যা না তাই বলে আপনাকে গালমন্দ করলাম। এবার আপনিও আমায় গালমন্দ করে তার প্রতিশোধ নিয়ে নেন।

- আমার আপনার ওপর কোনো রাগ নেই। এই মুহূর্তে আপনার জন্য আমার ভেতর মায়া জন্মাচ্ছে। খানিকটা ভালো লাগাও কাজ করছে।

- ভালো লাগা কাজ করছে কেন?

- কারণ খুব কম মেয়েরই মুখের ওপর এমন করে কথা বলার সাহস আছে। আমাদের বাংলাদেশের মেয়েরা যে এতটা এগিয়ে যাচ্ছে তার জন্যই ভালো লাগছে।

মেয়েটি ফিক করে হেসে ফেললো। এ হাসির ভেতরও কেমন যেন মনোমুগ্ধকর ব্যাপার লুকিয়ে আছে। মেয়েটি আমার পাশে বসতে বসতে বললো,

- আমি আমার সেলফ ডিফেন্সের জন্য হাতও চালাতে পারি।
- সত্যিই?
- হুম। দেখবেন নাকি?
- কিভাবে?
- আপনার নাক এক ঘুষিতে ফাটিয়ে দেবো।
- কি?
- হাহাহাহা।
- আপনি তো বড্ড অন্যরকম চরিত্র।
- চরিত্র? এই আপনি কি লেখালেখি করেন নাকি?
- একটু আধটু চেষ্টা করি।
- সত্যিই? ওয়াও।
- ওয়াও কেন?
- আমি একজন সাহিত্য জগতের মানুষের সাথে বসে আছি সেই জন্য।
- শুনুন, আমি অত বড় কেউ নই। আবার ছোট-খাটোও কেউ নই। আমি খুবই সাধারন একজন মানুষ। লেখালেখি শুধু চর্চা করি মাত্র।
- এটাই ক'জনে করে? আপনি যে চেষ্টাটুকু করছেন এতেই তো অনেক কিছু।
- হাহাহাহা।
- হাসছেন কেন। আচ্ছা বাদ দিন এসব কথা। আমার নাম নাওশিন রুমালী। আপনার নাম?
- অভ্রনীল।
- আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
- কোথাও না। এখানে এসে মাঝে মাঝে বসি। ভালো লাগে।
- ইন্টারেস্টিং তো। কোনো কাজ ছাড়াই কেউ কি প্লাটর্ফমে এসে বসে থাকে?
- আমি তো থাকি। বাদ দিন আমার কথা। আপনি যাচ্ছেন কোথায়?
- খুলনা বাগেরহাট। বড় চাচার বাড়িতে।
- দেখেন, ভুল করে আবার সুন্দরবনে ঢুকে পড়েন না যেন।
- কেন? ঢুকলে কি হবে?
- বাঘিনীদের সর্দারনী বলে ওরা আটকে রাখতে পারে।
- হিহিহিহি। আমি দেখতে কি বাঘিনীদের মতো?
- এখন যে রূপ সে রূপ একজন মানুষীর। একটু আগে যে রূপ ছিল তা নিঃসন্দেহে বাঘিনীর রূপই ছিল।
- হিহিহিহি।
- আপনার ট্রেন মনে হয় চলে এসেছে।
- আপনি বুঝলেন কি করে?
- ট্রেন আসার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
- আপনার কি কোনো আধ্যাত্মিক পাওয়ার আছে?
- কি কারণে বলুন তো?
- না, ট্রেন আসলে সচারচর শব্দ তো সবাই শুনতে পায়। কিন্তু আপনি এত আগেই কিভাবে শুনতে পেলেন?
- জানি না কিভাবে।
- আচ্ছা আমি কি আপনার মোবাইল নাম্বারটা পেতে পারি?
- অবশ্যই পেতে পারেন। এর আগেও ছয়জন নিয়ে গেছে। কিন্তু কেউ যোগাযোগ করে নি। হয়তো আপনিও করবেন না।
- না করলে করবো না। এতে আফসোস করার কি কিছু আছে?
- আফসোস বলতে আগের ছয়জনের চেয়ে আপনি অধিক সুন্দর। আপনার সাথে পরিচয়টাও বেশ অন্যরকম। মনে রাখার মতো একটা ব্যাপার আছে আজকের দিনের কথা।
- তাই। তো মিষ্টার সময়ই কথা বলবে। আমি আপনাকে মনে করি কি করি না।
- চলে যাচ্ছেন?
- যেতে তো হবেই। মানুষ তো স্থির বা জড় বস্তু নয়। মানুষ হলো গতিশীল। এদের সবসময় গতিতে থাকতে হয়।
- ধন্যবাদ। পৃথিবীটা গোল। হয়তো আবার কখনও দেখা হবে।
- এবারের দেখাটা যদি হয় তাহলে আমি কিংবা আপনি হতে পারি সৌভাগ্যবান।
-'ধন্যবাদ'।
- বাই।

একটি চলন্ত ট্রেন এসে আরেকটি চলন্ত মানুষকে আমার কাছ থেকে তুলে নিয়ে গেল। আমি সেই চলন্ত ট্রেনের পথের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার ভেতর কেমন যেন মন খারাপের ব্যাপারটা কাজ করছে। কি কারণে বা কেন করছে তা জানি না। বারবার শুধু পাশে বসে থাকা অচেনা অজানা রুমালীর কথা মনে পড়ছে। কোথাও যেন পড়েছিলাম রুমালী মানে ফুল। সেই অর্থে বলা যেতে পারে আমার পাশে বসে থাকা একটি অচেনা অজানা রুমালী তার নিজস্ব সৌরভ ছড়িয়ে দিয়ে গেল। যার সুভাষ অত্যন্ত সুগন্ধযুক্ত। কিন্তু সেই সুভাষ নিতেও খানিকটা কষ্টের ব্যাপার তৈরি হচ্ছে আমার ভেতরে।

মন খারাপ নিয়ে আবারো ম্যাগাজিন পড়তে শুরু করলাম। সামান্য দূর থেকে ভেসে আসা এক স্পষ্ট ক্ষীণ কণ্ঠস্বর - 'আফা ৫ টা টেহা দিবেন?' বলতেই একজন ভদ্র মহিলা বাচ্চা মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। বাচ্চা মেয়েটি না কেঁদেই আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেল। ভদ্র মহিলাটিকে যতটা ভদ্র ভেবেছিলাম ততটা ভদ্র সে নয়। সে একজন অভদ্র ও ঘৃণিত মহিলা। কিন্তু সাজগোজ দেখে মনে হয় যেন উনার ভেতরে অনেক দয়ামায়া। একবার ঘৃণার দৃষ্টি নিয়ে মহিলাটিকে দেখেই উঠে পড়লাম। আসলে মানুষকে বাহিরে থেকে যেমন মনে হয় তেমন হয় না। আমি সেই বাচ্চা মেয়েটিকে খুঁজছি। এই রেল ষ্টেশনের প্লাটফর্মে মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়াটা খুবই কঠিন। লোকজনের অনেক ভীড়। তবুও আমি খুঁজে চলেছি। আমার খোঁজা স্বার্থক হলো। মেয়েটিকে পেলাম। ও আরেকজনকে ধরেছে টাকার জন্য। একজন বয়স্ক লোক। দাদু বলে ডাকছে। লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে মেয়েটিকে এখনই ধাক্কা দেবে। কিন্তু না, লোকটি একটা দশ টাকার নোট বের করে মেয়েটিকে দিল। আমারও খুশি লাগলো। নাহ্ লোকটি ভালো। আর সেই জন্যই হয়তো উনার মাথায় চুল নেই। মেয়েটি দৌড়ে আমার দিকেই আসছে। এবার মনে হয় আমাকে ধরবে ও। এরা খুব সহজ সরলের হয়। মানুষের দুর্ব্যবহার এরা অল্পতেই ভুলে যায়। দশ টাকা পাওয়ার আনন্দটা খুব সহজেই লুকিয়ে ফেললো বাচ্চা মেয়েটি। কি অদ্ভুত গুণ। নিখুঁত অভিনয় করার ক্ষমতা এই মেয়ের আছে। কিন্তু কেউ তার মূল্য দেবে না। কারন মেয়েটি অভিনয়টা খুবই নিম্নমানের করছে। কিন্তু তবুও আমার মনে হচ্ছে মেয়েটি নিখুঁত অভিনয়ে পারদর্শী। ও আমার কাছে এসে চেহারায় দুঃখী ভাবটা ফুটিয়ে বললো,

- সাহেব পাঁচটা টেহা দিবেন? আমি বললাম -
- টাকা দিয়ে তুমি কি করবা?
- ওমা টেহা দিয়া মাইনষে কি করে?
- টাকা দিয়ে তো মানুষ অনেক কিছুই করে। তুমি কি করবা?
- আমিও টেহা দিয়া অনেক কিছু করুম।
- তো শুনি কি কি করবা?

মেয়েটি আমাকে বলতে যাচ্ছিলো এই সময় আমি ওকে বাধা দিলাম। এক মিনিট এক মিনিট। আচ্ছা তোমার নামটা কি? মেয়েটি তার ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে বললো - 'তুম্পা' । বুঝলাম ওর নাম টুম্পা। সামনের নিচের সাড়ির দুইটা দাঁত নেই ওর। বয়স আনুমানিক সাত বছর হবে হয়তো। আমি বললাম, আচ্ছা টুম্পা চলো আমরা ঐখানটায় বসে গল্প করি। টুম্পা রাজি হলো না। বললো, 'না, আমার অনেক লস হইয়া যাবো '। কি সাংঘাতিক ব্যাপার মেয়েটি এখনই লাভ-লোকসান কি বুঝে গেছে। আরও বড় হলে কি হবে কে জানে। আমি বললাম, 'তোমার যা ক্ষতি হবে আমি তা পুষিয়ে দেবো। চলো।'

অবশেষে সাত বছরের মেয়েটি যেতে রাজি হলো। ওকে নিয়ে প্লাটফর্মের বাধানো গোল বৃত্তাকার জায়গায় বসলাম। প্লাটফর্মে অনেক মানুষ। কিন্তু কারও নজর আমাদের দিকে নেই। টুম্পা ছেড়া একটা ফ্রগ পরে আছে। ওর গা থেকে বোটকা ঘামের গন্ধ বেরুচ্ছে। কিন্তু আমার খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। টুম্পাকে এবার জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কে কে আছে?

- আমার কেউ নাই। জন্মের পর থেকেই এইহানে বড় হইছি।
- তোমার মা?
- মা তো গত বছর শীতেই ঠান্ডা লাইগা মইরা গেছে।
দেখলাম মেয়েটির গলা একটুও কাঁপলো না, কাঁপছে শুধু শরীরটা। হয়তো শীতকালের ঠাণ্ডার কারণে। চোখের কোণে কোনো পানি নেই। বড্ড কাটখোট্টা স্বভাবের মেয়ে। এই পরিবেশ ওকে এমন বানিয়ে দিয়েছে।
- আচ্ছা তাহলে তুমি টাকা দিয়া কি করো?
- টেহা দিয়া পেটের ক্ষুধা মিটাই।
- দিনে তোমার কই টাকা করে লাগে খেতে?
- উমমম জানি না। ওদের টেহা দেই। আর ওরা আমায় খাইতে দেয়।
- তুমি গুনতে জানো না।
- না। লেহাপড়া শিখি নাই।

সাত বছরের মেয়েটিকে দেখে আমার সত্তর বছরের মহিলার কথা মনে পড়ছে। মেয়েটির কথাবার্তায় বড়মানুষি ভাব আছে। ও কথা বলতে বলতে দৌড়ে চলে গেল এক মহিলার কাছে। টুম্পার মা বয়সী হবে। দুর থেকে দেখলাম মহিলাটি ওকে দুরদুর করে তাড়িয়ে দিল। এই পৃথিবীতে খুব কম মানুষী জন্মেছে দয়ামায়া নিয়ে। তাছাড়া সবাই স্বার্থপর। মেয়েটি একটু পর একরাশ হতাশা নিয়ে ফিরে আসলো আমার কাছে। মনে হয় ও আমাকে বিশ্বাস করেছে। সচারচর এ ধরনের কোনো ছেলেমেয়ে কাউকে বিশ্বাস করে না। কারন তাদের বিশ্বাসটুকু অনেক আগেই নষ্ট হয়ে যায়। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার শীতের জামাকাপড় নেই? ও বললো, 'না'।

- নতুন শীতের জামাকাপড় নিবা?
- হুম করে তো। কিন্ত কেউ দেয়না। নতুন জামাকাপড় কিরম হয়?
আমি খুবই অবাক হলাম। মেয়েটি নতুন জামাকাপড় কি তাই চেনে না। শুধু টাকা ইনকাম করে পেটের ভাত জোগায়। আমি বললাম, তুমি নিবে নতুন জামাকাপড়? টুম্পা বললো, নিবো, কিন্তু আমার সগ বন্দুকেও দেওন লাগবো।
- আচ্ছা দেবো। তোমার সব বন্ধু কি তোমার মতোই ছোট?
- হ। কিন্তু একজন বড় আছে।
- কতো বড়?
- ম্যালা বড়।
- আচ্ছা সমস্যা নেই। তাহলে আগামী দিন তোমাদের সবার জন্যই নতুন শীতের-কাপড় আনবো কেমন। আজকে আমার সময় স্বল্প। আজকে যাই।'

উঠে চলে আসছিলাম। কিন্তু টুম্পার ক্ষতিপূরণ দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখছি মেয়েটা নিরুপায় বসে আছে। কেউ বিঃশ্বাসঘাতকতা করলে যেমন হয় আর কি। আমি ওর কাছে গিয়ে ৫০ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলাম। মেয়েটি চিলের মতো ছোঁ মেরে টাকাটা নিয়ে বুকে আগলে ধরলো। মনে হচ্ছে কেউ বুঝি ওর টাকাটা কেড়ে নিবে। আমি সেদিন চলে এসেছিলাম ষ্টেশন থেকে। আজ ১১ ডিসেম্বর। আমার কাঁধ ব্যাগে অনেকগুলো নতুন জামাকাপড় আছে। টুম্পা ও তার বন্ধুদের জন্য। রিক্সায় উঠে যাচ্ছি ষ্টেশনের দিকে। দূর থেকে রেল ষ্টেশনের নেমপ্লেটটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে মনে হচ্ছে বড় ধরনের হট্টগোল হয়েছে। সবাই দৌড়াচ্ছে ষ্টেশনের দিকে। ষ্টেশনের প্লাটফর্মের মাথার উপর ডজন তিনেক কাক উড়ছে। আমার মনটা কেমন জানি অস্থির হয়ে উঠলো টুম্পার জন্য। তাড়াতাড়ি করে ভাড়াটা মিটিয়ে প্লাটফর্মের দিকে দৌড় দিলাম। হ্যাঁ খুব বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। প্লাটফর্মের সাথে লেগে থাকা রেললাইনের ট্রেনটা বেসামাল হয়ে কাত হয়ে পরেছে। খুব নিচু এবং ছোট্ট প্লাটফর্মটার অর্ধেকটা ট্রেনের পেটের তলে। সবাই সবার আত্মীয়দের উদ্ধার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

আমি টুম্পাকে খুঁজছি। কোথাও পাচ্ছি না। অবশেষে তাকে দেখতে পেলাম। কিন্তু খুবই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখতে হলো আমাকে। টুম্পার পুরো শরীর ট্রেনের নিচে চাপা পড়ে আছে। মাথাটা শুধু বের হয়ে আছে। কেউ ওকে বের করার জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কারও মনে কষ্ট হচ্ছে না মেয়েটির জন্য। সবাই যেন খুব আনন্দের সাথে উপভোগ করছে। আমি টুম্পার মাথার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। দেখলাম মেয়েটির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। ওর চোখটা বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মুখটা হা করে আছে তাই ওর ফোঁকলা দাঁতের মাঝখানে মাছি উড়ছে। আমি টুম্পার হাতটা ধরলাম। খুব শীতল একটা হাত। কোনো পাল্স নেই। আমার দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ওর শখ নতুন জামা পড়ার। আমি এনেছি। কিন্তু আর টুম্পা নেই। সাত বছরের নিখুঁত অভিনয় শিল্পীর সমাপ্তি ঘটেছে। ওকে আর অভিনয় করতে হবে না। কিন্তু ও কোনো মর্যাদার সাথে দাফনও পাবে না। ওর দাফন হয়তো বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে হবে। আমার কাঁধের ব্যাগে নতুন শীতের জামা। আর আমার কোলে টুম্পার নিঃষ্প্রাণ মাথা। আমার সবকিছু কেমন জানি নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশটা ঝাপসা হয়ে আসছে। নিরুপায় টুম্পাকে রেখে চলে আসতে হচ্ছে। এখন যা কিছু হবে সবই পুলিশি নিয়মে হবে। হয়তো মেয়েটির শরীরটাকে কেটে বের করবে। এছাড়া কোনো উপায় নেই। আমি চলে যাচ্ছি। নতুন জামা গুলো আর কাউকে দিতে পারলাম না। চোখ থেকে পানি টা মুছে নিলাম। টুম্পার দিকে তাকিয়েই হাঁটছি। ধীরে ধীরে চোখের আড়াল হয়ে গেল টুম্পা।
 

Leave a Comment