স্বপ্নের সমাধি ( শেষ পর্ব )

  • ফারজানা আক্তার 
  • ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৮

নিষাদ : তুই তো আমাকে চিনতেই পারলি না। আর তোর যদি এতই মনে হয় সত্যিটা জানার পর আমি হারিয়ে যাবো তাহলে সত্যিটা বলার দরকার নেই। আমি আর শুনতেও চাইবো না। তবে আমার সাথে আর "এই শোন, এই শোন " খেলা খেলবি না। তুই "এই শোন " অর্ধেক কথা বলে হারিয়ে যাওয়া আমার একদম ভালো লাগে না। 

নিশি : আজ যেহেতু এতো কথা উঠে এসেছে আজ সত্যিটা তোকে শুনতে হবে।  তুই শুনলেও আমি বলে যাবো, তুই না শুনলেও আমি বলে যাবো। আজ সেই কথাটা বলে নিজেকে হালকা করবো। সেই কথাগুলো মনের মাঝে জমিয়ে রেখে রেখে নিজেকে অনেক ভারী করে ফেলেছি। এখন আর সেই ভার বহন করতে পারছি না। হালকা হবো আজ আমি। নিষাদ চুপচাপ আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কথা বলছে না। আসলে এখন ওর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছে। মন মেজাজ দুইটায় খারাপ লাগছে নিষাদের এখন। 

নিশি : আমার জন্মের সময় আমার মা মারা গেছে। পরিবারে আমার দাদা -দাদি, ছোট চাচা , ফুফু রয়েছে। আমার বয়স যখন ৬মাস , তখন আমার বাবা তার ছোটবেলার বান্ধবীকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসেন।  এই বিয়ের কথা পরিবারের অন্য কেউ জানতো না। হুট করেই বাবা বিয়ে করে নিয়ে আসেন। একদিকে মা মারা গেছেন মাত্র ৬মাস, আমার বয়সও ৬মাস আবার এদিকে বাবা কাউকে কিছু না বলে বিয়ে করে বউ নিয়ে বাসায় চলে এসেছেন সব মিলিয়ে পরিবারে খুব বাজে একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো তখন।  আমি তো তখন কিছু বুঝি নাই, সব দাদির কাছে শুনেছি।  এইটুকু বলেই নিশি জোরে একটা নিঃস্বাশ নিয়ে থামলো। তারপর কয়েক মিনিট একদম চুপচাপ। তারপর আবার বলতে শুরু করলো। 

নিশি : দ্বিতীয় বিয়ে করে বাবা একদম বদলে গেলো। আমাকে একদম সহ্য করতো না। বাবা নাকি কয়েকবার আমার গলা চেপে মেরেও ফেলতে চেয়েছিলো। আমার দুর্ভাগ্য আমার দাদি প্রতিবারই দেখে ফেলেছে এবং আমি প্রতিবারই বেঁচে গেছি। এই কথা শেষ করেই নিশি কাঁদতে শুরু করলো। নিষাদ কি করবে বুঝতে পারছে না। সে নিশির কাছে এসে নিশির কাঁধে হাত রাখলো। নিশি ঘাড় ঘুরিয়ে নিষাদের দিকে তাকালো। নিষাদ চোখের ইশারায় কান্না থামাতে বললো। কিছু কিছু সময় মুখের ভাষার থেকে চোখের ভাষা বেশি কথা বলে, বেশি গুরুত্ব বহন করে, বেশি অর্থও বহন করে । নিশি কান্না থামানোর চেষ্টা করে নাক টেনে টেনে আবার কথা বলতে শুরু করলো। 

নিশি : লাষ্ট যেদিন বাবা আমার গলা চেপে ধরতে গেলো সেদিন দাদি বাবার সাথে খুব ঝগড়া করলো। দাদা বাবাকে বাসা থেকে বের করে দিলো। আমার সৎ মা আর বাবা বাসা থেকে বের হওয়ার সময় হুমকি দিয়ে গেলো আমার জন্য তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে , তাই তারা আমাকে কোনো ভাবেই বাঁচতে দিবে না। কতদিন আমার দাদা -দাদি আমাকে আগলে রাখবে। একথা বলে রাখি আমার চাচা আর ফুফু আমাকে খুব ভালোবাসতো। তারা আমাকে আদরও করতো অনেক। আমার যখন দুই বছর বয়স, তখন আমার ফুফুর বিয়ে ঠিক হলো। বাবারা দুই ভাই আর এক বোন। আশপাশের সবাই দাদা -দাদিকে বলছিলো বাবাকে দাওয়াত করতে। ছেলেটা এমনি ঘর ছাড়া অনেকদিন, অতীতে হয়তো একটা ভুল করে ফেলছে আর তাছাড়া মানুষই তো ভুল করে। এতদিন পর এসব মনে রেখে লাভ আছে ! তাছাড়া একমাত্র বোনের বিয়ে, তাদের আসতে বলেন। এতটা নিষ্ঠুর হওয়া আপনাদের উচিত হবে না। আমার ফুফুও চাচ্ছিলো বাবা তার বিয়েতে আসুক। আমার চাচা যেয়ে আমার বাবা -মা'কে দাওয়াত দিয়ে আসে। বিয়ের দুইদিন আগেই তাদের চলে আসতে বলে। এইদিকে আমার দাদা -দাদি ঠিক করে বাবারা যতদিন এইবাড়িতে থাকতে ততদিন আমাকে তারা কারো কাছে যেতে দিবে না। তাদের সাথে সাথেই রাখবে। 

নিশি একটু দম নিলো। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে পানি খেলো। তারপর নিষাদের দিকে তাকিয়ে দেখে নিষাদ ওর দিকে কেমন অবাক নয়নে তাকিয়ে রয়েছে। চোখের পলকও ফেলছে না। নিশি নিষাদকে জিজ্ঞেস করলো, "কি হয়েছে ?"
নিষাদ : তাড়াতাড়ি বল এরপর কি হয়েছে ? আমার দম আটকিয়ে যাচ্ছে। 

নিশি : বিয়ে বাড়িতে যেমন ধুমধাম হয় আমাদের বাড়িতেও তেমন হয়েছে। দাদার একমাত্র মেয়ের বিয়ে কোনো কিছু কম করেন নি। আমার দাদার বিশাল বাড়ি। দুইটা বিল্ডিং, একটা একতলা আর অন্যটার কাজ তখন চলছিলো । দাদার বিশাল বাড়ির বিশাল উঠান। সেই উঠানে বর-কনের স্টেজ এবং অন্য সবার বসার জায়গা করা হলো। বাবারা আসলো, আনন্দ আরো বেড়ে গেলো। আমি নাকি বারবার বাবার কাছে চলে যাচ্ছিলাম, বাবাও আমাকে বারবার কোলে নিতে চাচ্ছিলো কিন্তু আমার দাদি কিছুতেই বাবার কাছে আমাকে দিছিলো না। বাবা নাকি কয়েকবার দাদিকে রিকোয়েস্ট করেছে আমাকে একটু কোলে দিতে, দাদি দেয় নি। 

দাদির মুখেই শুনেছি বাবা নাকি অনেকবার মাফও চেয়েছে তার ভুলের জন্য কিন্তু দাদা -দাদি আমাকে দেয় নি তার কাছে। বাবাকে তারা ক্ষমা করে দিয়েছে কিন্তু আমাকে বাবার কাছে দেয় নি। ফুফুর বিয়ের আগেরদিন সারা বাড়িতে যখন গান -বাজনাতে সবাই নাচানাচি করছে, বিভিন্ন রঙ্গের আলোতে চারদিক ঝলমল করছে তখন আমার বাবা মন খারাপ করে একপাশে বসে আছে। আমার ফুফু চুপিচুপি আমাকে নিয়ে যে বিল্ডিংয়ের কাজ চলছিলো সেটার ছাদে চলে গেলো। তারপর বাবাকে ডেকে পাঠিয়ে ছাদে নিলো। এতো আনন্দে ভাইয়ের মন খারাপ ফুফুর ভালো লাগছিলো না। আমার মুখ থেকে বাবা ডাক শুনে আর আমাকে দেখে বাবা যে অনেকটা বদলে গেছে সেটা ফুফু খুব ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন।  ফুফু চাচ্ছিলেন আমি যেন বাবার সাথে একা কিছু সময় কাটাই। 

ছাদে বাবা আমাকে একা পেয়ে কোলে তুলে নাকি হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলেন। আমাকে পাগলের মতো আদর করে বুকে শক্ত করে ধরে রাখলেন। আর আমিও নাকি চুপচাপ বাবার বুকে লেপ্টে ছিলাম। নিচে সবাই ফুফুকে খুঁজছিলো তাই ফুফু আমাকে বাবার কাছে রেখে নিচে চলে গেলেন আর বললেন ১০মিনিট পর এসে আমাকে আবার নিয়ে যাবেন। ফুফু চলে গেলে বাবা আমাকে ছাদের রেলিংয়ে বসিয়ে গল্প করছিলেন আর আকাশের চাঁদ তারা দেখাচ্চিলেন। হঠাৎ করে !!!!!!!

নিশি চুপ হয়ে গেলো। তারপর দুইহাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো। নিষাদ এগিয়ে গিয়ে নিশির মাথায় হাত রাখলো। নিশি মুখের থেকে হাত নামিয়ে নিলো। তারপর কান্না থামাতে থামাতে বলা শুরু করলো। 

নিশি : বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে আমার সৎ মা ছাদে চলে আসে। কারণ মা জানতেন বাবাকে কোথাও না পাওয়া গেলেও এখানে পাওয়া যাবে। কারণ বাবার মন খারাপ থাকলে একাকী থাকতে পছন্দ করেন এবং তিনি একাকী বসে বসে সিগারেট খান। এই বিয়ে বাড়িতে এই ছাদ ছাড়া অন্য কোথাও এখন নিরিবিলি নেই। ছাদে এসেই মা বাবার সাথে আমাকে দেখতে পান। মা আমাদের কাছে এসে বাবাকে বলেন, "এইতো সুযোগ কাজে লাগাও। " বাবা অবাক হয়ে মা'কে জিজ্ঞেস করেন, "কি সুযোগ ? কি কাজে লাগাবো ?"

মা : যে কাজ করতে যেয়ে আমরা এই বাড়ি থেকে বিতাড়িত হলাম। সোজা একটা কাজ ওকে ছাদ থেকে ফেলে দাও। বাবা অবাক হয়ে মাকে বললো ," তুমি এসব কি বলছো ? আগে আমি অমানুষ ছিলাম তাই এই ঘৃণিত কাজ করতে চেয়েছিলাম। এখন আমি সুস্থ এবং স্বাভাবিক। আমি আমার মেয়ের চুল পরিমান ক্ষতিও হতে দিবো না এখন। "

মা : ও তুমি এখন মানুষ হয়েছে কিন্তু আমি কিছুই হই নি ? আগে যা ছিলাম এখনো তাই আছি। 

মা কথা শেষ করেই আমাকে ধরতে যায়। বাবা আমাকে ছাদের রেলিং থেকে টান মেরে কোলে তুলে নেয়। আমি জোরে কান্না শুরু করে দেই। বিয়ে বাড়িতে যেমন থাকে হৈচৈ তেমন থাকে গানবাজনা। তাই নিচে , আশেপাশে কোথাও আমাদের কান্না, হৈচৈ কিছুই কেউ শুনতে পায় নি। মা বাবাকে নানাভাবে বুঝাতে থাকে , বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার প্রতিশোধ নিতে বলে। এক পর্যায়ে মা ছাদে কাজের জন্য ফেলা রাখা একটা কাঠ নিয়ে বাবাকে আঘাত করে। বাবা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে। মা পর পর কয়েকটা বাড়ি মারলে বাবা বসে পড়ে এবং আমাকে কোল থেকে ফেলে দেয়। বাবাকে মারা প্রতিটা আঘাত বাবা নিজের শরীরেই নিয়েছেন। একটাও আমার শরীরে লাগতে দেন নাই। বাবাকে পর পর কয়েকটা বাড়ি মারার পর বাবার বসার থেকে উঠার শক্তিও তখন হারিয়ে ফেলেছেন। বাবাটা ব্যথার জন্য যতটা না শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন, মায়ের এমন হিংস্র ব্যবহার দেখে তার থেকে বেশি অনুভূতিশক্তিহীন রোবট হয়ে গেছেন। আমি বাবার পাশে দাঁড়িয়েই চিৎকার করতে ছিলাম। মা আমাকে জোর করে কোলে তুলে নিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দিলো। আমি এই দুনিয়াতে কৈ মাছের প্রাণ নিয়ে এসেছি। তার প্রমান আমি ছাদ থেকে পরেও মরলাম না তবে মা হওয়ার ক্ষমতা চিরদিনের জন্য হারালাম। 

নিষাদ  প্রশ্ন না করে পারলো না। নিশির কথার মাঝখানেই জিজ্ঞেস করলো, "মা হওয়ার ক্ষমতা চিরদিনের জন্য হারালি মানে ? "

নিশি : আমাকে ছাদ থেকে মা ফেলে দিলো আর আমি নিচে পড়লাম চিৎ হয়ে না উপুড় হয়ে পড়ি নি। আমি নিচে পড়েছি বসে। পড়ার সাথে সাথে আমার প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। ৯-১২বছর বয়সে একটা মেয়ের শরীরে যে পরিবর্তন আসে সেটা তখন সেই আঘাতের কারণেই আমার শুরু হয়ে গেছে। কি এক ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে আমার সেই সমস্যাটা তখন বন্ধ করা হয়েছে তবে আমার মা হওয়ার ক্ষমতা চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গেছে। 

নিষাদ : তোর বাবা মা এখন কোথায় আছে ?

নিশি : সবাই যখন আমাকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেছে তখন বাবা নিজেই নিজের গলায় ফাঁসি দিয়েছে। আমার সৎমা বাপের বাড়ি চলে গেছে। আমার ফুফু তখন সে বিয়ে আর করে নি। আমার এই অবস্থার জন্য সে নিজেকে দ্বায়ী করে তাই জীবনে আর সে বিয়েই করে নি। আমাকে দেখাশোনা করার জন্য সে অবিবাহিতই রয়ে গেলো। আমার দাদা আমাকে সৎ মায়ের নাম মামলা দিতে চাইলো কিন্ত ফুফু সে মামলা করতে দেয় নি। তখন সে সব দোষ তার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলো । বাবার আত্মহত্যার পর আমার দাদা -দাদিও অনেক মুষড়ে পড়লো। তাই তারাও চাচ্ছিলো এই সমস্যাটা যতটা দ্রুত সম্ভব চাপা পরে যাক। তাই তারাও বেশি ঘাটায় নি। 

নিষাদ : এতবড় অন্যায় করার পরও এভাবে ছেড়ে দিলো তোর সৎ মা'কে?

নিশি : এই জীবনে কিছু কিছু ঘটনা, কিছু কিছু অন্যায় রয়েছে যেটার প্রতিশোধ নেওয়া বা  শাস্তি দেওয়ার থেকে ভুলে যেতেই আমরা বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করি। ওই ঘটনাটা আমাদের পরিবারের কাছে তেমনই একটি ঘটনা। 

নিষাদ : তোর ফুফু আর বিয়েই করলো না ? কি আজব ! পরদিন উনার বিয়ে ছিলো , না জানি মনে কত স্বপ্ন ছিলো ! সেই মানুষটা নিজের স্বপ্নের  সমাধি দিয়ে নিজেকে এতবড় শাস্তি দিলো ?

নিশি : হুম ! আমি বাবা মায়ের আদর ভালোবাসা পাই নি কিন্তু কখনো তাদের অভাব অনুভব করি নি। আমার ফুফু, চাচা , দাদা -দাদি আমার চারপাশ ঘিরে যতটা ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া -মমতা যতটা দরকার তার থেকে কয়েকগুন বেশি দিয়েছে। 

নিষাদ :  তুই তাহলে সবসময় এমন মন খারাপ করে থাকিস কেন ? তোর সব কথা শুনলে নাকি আমি হারিয়ে যাবো ?এতক্ষন ধরে তোর সব কথা শুনলাম হারিয়ে যাওয়ার মতো কি হয়েছে বুঝলাম নাতো !

নিশি : আমার বাবার আত্মহত্যার ইতিহাস, আমি কখনো মা হতে পারবো না। এইসব জানার পর কেউ আমার হাত ধরতে চাইবে, কারো পরিবার মেনে নিবে ?

নিষাদ নিশির খুব কাছে এসে নিশির হাত ধরলো তারপর বললো, "এইতো হাত ধরলাম। দেখি কে ছাড়াই !"

নিশি : এখনো তো নদীর তীরেই আছি। হাতটা ধরে মাঝ নদীতে যাই, তখন দেখা যাবে কতটা শক্তি তোমার হাতে আছে আর কতটা সাহস তোমার মনে আছে। 

  
 

Leave a Comment