ভয় ( পঞ্চম অংশ )

  • ফারজানা আক্তার 
  • ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১৮

বিয়ের দিন এমনিই বর -কনের অনেক ধকল যায় কিন্ত সেই ধকল শান্তির, সুখের আর স্বস্তির। আবুল হোসেন এবং জয়ীর আজ অনেক ধকল গেলো তবে সেটা শান্তি বা সুখের না হলেও, হোটেলে উঠে কিছুটা স্বস্তি অনুভব হচ্ছে। আবুল হোসেনের ধৈর্য আর সহনশীলতা দেখে জয়ীর বারবার মনে হচ্ছিলো সে মানুষ চিনতে ভুল করে নাই। বিয়ে সংসার নিয়ে যখন থেকে বুঝতে শিখেছে তখন থেকে এমনই একজন মানুষের স্বপ্ন দেখে এসেছে। জয়ীর বিশ্বাসই হচ্ছিলো না তার সামনে বসে থাকা মানুষটি আজ থেকে তার, সম্পূর্ণভাবে তার একান্ত নিজের ! হোসেন চুপচাপ বসে ছিলো। জয়ী যেয়ে পিছন থেকে হোসেনের কাঁধে হাত রাখলো। হোসেন মুখ না ঘুরিয়ে বললো - "আমাকে মাফ করে দিও। বিয়ের প্রথম দিন তোমাকে নিজের ঘরে তুলে নিতে পারলাম না। বাসর ঘর তো দূরে থাক ! " হোটেলে উঠার আগে পর্যন্ত জয়ীর খুব খারাপ লাগছিলো সত্যিই। কিন্ত হোটেলে উঠে খারাপ লাগা অনেকটাই কমে গিয়েছিলো। হোসেনের এমন মন খারাপ দেখে এখন জয়ীরও খুব কান্না পাচ্ছে।

জয়ী কান্না নিজের মধ্যে গোপন করে হাসার চেষ্টা করলো। একটু দুস্টুমি করে বললো - বাসর ঘর যে সবসময় অন্য কেউ সাজিয়ে দিবে এমনটা ভাবার তো কিছু নেই তাই না ? নিজেরাও সাজিয়ে নিতে পারি আর তাছাড়া বাসর ঘর ছাড়া যে বাসর করা যাবে না এমন কি কোনো কথা আছে ? এমন কিছু আমার জানা নেই, তোমার কি জানা আছে ?হোসেন তখনও মুখ না ঘুরিয়ে তার কাঁধে রাখা জয়ীর হাতটা শক্ত করে ধরলো। খুব শক্ত করে। মুখে কিছু না বললেও জয়ী বুঝতে পারলো শত বাধা বিপত্তিতেও এই হাত ছাড়বে না হোসেন , কখনোই না। সেদিন রাতেই হোসেন এক বন্ধুর মাধ্যমে একটা ফ্ল্যাটের খোঁজ পায়। তবে একটাই সমস্যা বাসাটা খুব পুরোনো এবং এই বাসাটা হোসেনের হাসপাতাল থেকে অনেক দূর হয়ে যাবে। তবুও হোসেন রাজি হয়ে গেলো। জয়ী অনেক আপত্তি করেছিলো। জয়ী বারবার বলছিলো আরো কয়েকটি বাসার খোঁজখবর নিতে কারণ এতদূরে বাসা নেওয়ার কোনো ইচ্ছা ওর নেই। আবার অনেক পুরোনো বাসা কেমন না কেমন হবে ! হোসেন চাচ্ছিলো তাড়াতাড়ি যেকোনো রকম একটা বাসায় আগে উঠে যেতে। তারপর ধীরে সুস্থে ভালো বাসা দেখে উঠা যাবে।

জয়ীর ভালো না লাগলেও হোসেনের কথায় রাজি হয়ে গেলো। কারণ হোসেনের কথার যুক্তি আছে। হোটেলে থাকা ওদেরও ভালো লাগছিলো না, আবার বন্ধু -বান্ধব , আত্মীয় - স্বজনরাও ভালো চোখে দেখছিলো না। পরদিন সকালে ওরা হোটেলের হিসাব মিটিয়ে নতুন বাসায় গেলো। বাসাটা ঢাকা থেকে অনেক দূরে হয়ে গেছে। বাসা দেখে ওদের চোখ কপালে উঠে গেলো। মনে মনে যতটা ভিতরে এবং পুরোনো ভেবেছিলো বাসাটা তার থেকেও অনেক ভিতরে এবং পুরোনো । নাই মামার থেকে কানা মামা অনেক ভালো হয়। তাই ওরা চোখ চোখ কান বন্ধ করে এই বাসায় উঠে গেলো। দুইজন মিলে বাজার থেকে টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনে আনলো। শুরু হলো হোসেন এবং জয়ীর নুতন সংসারের পদযাত্রা। জিনিসপত্র কিনে বাসায় উঠে দুইজন মিলে বাসাটা মোটামোটি সাজালো। এর মধ্যেই হোসেন বললো একবার ও হাসপাতালে যেয়ে ঘুরে আসবে। জয়ী কিছুটা আপত্তি করলো। একে তো নতুন বাসা, তারপরে আবার অপরিচিত জায়গা তাই আজ না যেয়ে কাল সকালে একেবারে গেলেই হয়। হোসেন বললো ও হাসপাতাল থেকে ছুটি নেয় নি, আবার কাউকে কিছু জানানোও হয় নি। এখন ফোন করে ছুটি চাইলে বিষয়টা খারাপ দেখাবে। তাই হাসপাতলে যেয়ে সরাসরি কথা বলে আসায় ভালো।

জয়ী রান্না করছিলো আর হোসেন গোসল করার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকলো। তখন হোসেনের ফোনে একটা ফোন আসলো। জয়ী ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো ফোনের স্ক্রিনে লিটনের নাম। জয়ী ফোনটা রিসিভ করলো। জয়ী হ্যালো বলতেই শুনতে পেলো এক মহিলার কণ্ঠ ! মহিলার কণ্ঠে অনেক ভয় আর উত্তেজনায় জড়ানো। কণ্ঠে এতটা উত্তেজনা জড়ানো যে তার কথাগুলোই জয়ী বুঝতে পারছিলো না। জয়ী বারবার শুনেও যখন বুঝলো না তখন হোসেনকে ডেকে বাথরুমেই ফোনটা ধরিয়ে দিলো। হোসেন ফোন ধরেই হ্যালো বলেই বুঝতে পারলো এটা সালেহা বেগমের কণ্ঠ। হোসেন কিছু না বলে রোবটের মতো কানে ফোনটা ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর ফোনটা কেটে দিয়ে জয়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই তাকানোর অর্থ জয়ী ঠিক বুঝতে পারলো না। তাকানোর অর্থ না খুঁজে জয়ী বারবার হোসেনের কাছে জানতে চাইলো - কি হয়েছে ? কার ফোন ছিলো ? কি বললো ? হোসেন কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। জয়ী দেখলো হোসেনের চোখ দিয়ে টপ টপ করে শিলা বৃষ্টির মতো পানি পড়ছে। জয়ী আর সহ্য করতে না পেরে হোসেনকে ধরে জোরে ঝাকি মারলো। চিৎকার করে জানতে চাইলো - "কি হয়েছে ? তুমি কাঁদছো কেন ? কার ফোন ছিলো ?"

হোসেন বললো কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে বললো - "তোমার সাথে এই জীবনে আমার হয়তো সংসার করা হবে না ! তুমি আমাকে যতটা ভরসা করেছো আমি তার বিন্দুমাত্র যোগ্য না। তোমাকে নিয়ে আমি যে যুদ্ধে নেমেছি সে যুদ্ধ শুরু হবার আগেই আমি হেরে গেছি। " জয়ীর সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। জয়ী কিছুই বুঝতে পারছে না। যে মানুষটা একটু আগ পর্যন্ত এতটা সহনশীল আর ধৈর্যশীল ছিলো , একটা ফোন পেয়েই সে এতটা অস্তির কিভাবে হয়ে গেলো ! লিটনের ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখে লিনার ফোন। লিটন তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলতে যেয়ে দেখে মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। অভিমান আর কষ্টে ভরা একরাশ কান্না তার কণ্ঠ চেপে ধরে বসে আছে। না ! এই মুহূর্তে লিনার ওপর ওর কোনো অভিমান নেই। অভিমানটা হচ্ছে নিজের ওপর। যেদিন তার চাচা হোসেন এবং চাচী জয়ীর কথা মনে পড়ে, সেদিনই নিজের ওপর অভিমান হয় আর কষ্টে মনটা তিক্ত বিরক্ত হয়ে যায়। সে সময় সে প্রাপ্তবয়স্ক যুবক ছিলো। একটু সাহস করলেই চাচার পাশে দাঁড়াতে পারতো কিন্ত কেন জানি এই কাজটা তার করা হয় নাই। আচ্ছা কেন সে সেদিন চাচার পাশে এসে দাঁড়াতে পারে নাই ? নিজের রাগী আর লোভী বাবার ভয়ে !

চলবে....

Leave a Comment