ভয় (৭ম পর্ব) 

  • ফারজানা আক্তার 
  • ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১৮

লিটন মন্ত্র মুগ্ধের মতো লিনার কথা শুনে যাচ্ছে । গল্প - নাটকের নায়িকাদের মতো করে লিনা কথা বলে যাচ্ছে । কথাতে কোন জড়তা নেই, কোন বাহানা নেই কিন্ত প্রতিতা কথাতে রয়েছে প্রবল আত্মবিশ্বাস । লিটন যন্ত্রের মতো জিজ্ঞেস করলো, পরীক্ষা করে কি পেলে ?

লিনা ঃ ভালোবাসা ! আপনার প্রতি আমার সবটাই ভালোবাসা।

লিটন ঃ কি করে বুঝলে সেটা ভালো বাসা ?

লিনা ঃ আমাদের জীবনে এমন অনেক জিনিসই রয়েছে যা আমাদের ভালো লাগে । ভালো লাগার জিনিসগুলোকে না পেলে আমাদের কিছু সময়ের শুধু খারাপ লাগে । জীবনের খুব অল্প জিনিসই রয়েছে যা আমারা ভালোবাসি, খুব ভালো বাসি। সেগুলো না পেলে আমাদের কান্না লাগে, খুব কান্না লাগে ।সে কান্না কষ্ট মিশানো কান্না । বুকের ভিতরে ঢেউ হয়ে চোখের ভিতর দিয়ে বের হয়ে আসে । লিটন কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না । তবে লিটনের খুব কান্না পাচ্ছে । লিটন বুঝতে পারছে না ওর কেন কান্না পাচ্ছে । ওর নিজের অজান্তে মনে যে চাওয়াটা তৈরি হয়েছিলো সেটা তো সে পেতেই যাচ্ছে তাহলে কান্না পাচ্ছে কেন ? কান্না সবসময় না পাওয়ার জন্য হয় না, মাঝে মাঝে পাওয়ার জন্যও হয় । লিটনের কান্না পাচ্ছে লিনাকে পাওয়ার জন্য । সেদিন রাত্রে লিটন - লিনা আর বেশি কিছু ভাবতে পারে নাই । কোন এক গভীর আত্মিক টানে তারা বিয়ে করে ফেলেছিলো । বিয়ে করে তারা লিনার বাবা -মায়ের সামনে গেলো । এক ঘর মেহমানের সামনে মেয়ের এমন আচরণে লিনার বাবা -মায়ের মুখ তুলে তাকানোর সাহস হয় নি । একমাত্র মেয়ের এমন বিয়ে তারা মেনেও নিতে পারে নি । সেদিন রাত্রেই লিনা এক কাপড়ে লিটনের হাত ধরে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছিলো ।

লিনার বাসা থেকে বের হয়ে লিটন লিনাকে নিয়ে নিজের বাসায় গেলো । লিনাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে বাবা -মাকে ডাকতে গেলো । লিটন ভাবতে পারছিলো না তার জন্য কি অপেক্ষা করছে ! লিটনের বেশি দূর ভাবতে হয় নি । লিটনের বাবা - মা কেউ রুম থেকেই বের হয় নি । দরজার ওপাশ থেকেই হাসান সাহেব বলে দিলো, দরজা খুলে তিনি লিটন বা লিনা যাকেই দেখবে তাদেরকে কাজের মানুষ দিয়ে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে । হাসান সাহেব দরজা খুলে লিটন বা লিনা কাউকে দেখতে পান নি । তবে তিনি যখন পুরো বাড়ি একবার চেক করে নিজের রুমে ঢুকলেন তখন দেখলেন সালেহা বেগম চলে গেছেন । অনেকদূর চলে গেছেন যতটা দূর গেলে কাউকে ফেরানো যায় না, কেউ ফিরে আসে না । সালেহা বেগম সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে আছেন । হাসান সাহেব চিৎকার করতে ভুলে গেলেন । তিনি দরজায় মাথা ঘুরে পরে গেলেন । হাসান সাহেবের যখন জ্ঞান ফিরলো তখন তিনি দেখলেন ঘর ভর্তি মানুষ জন আর সালেহা বেগমের পায়ের কাছে লিটন বসে আছে । লিটনের পাশে লিনা দাঁড়িয়ে আছে । হাসান সাহেব দৌড়ে যেয়ে লিটন কে সেখান থেকে সরিয়ে দিলেন । চিৎকার করে লিটনকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বললেন । হাসান সাহেব উম্মাতের মতো সমানে কান্না আর চিৎকার করতে লাগলেন । সাহেলা বেগমের আত্মহত্যার জন্য তিনি বারবার লিটন কে দ্বায়ী করতে লাগলেন ।

আত্মীয় -স্বজনরা সবাই লিটন কে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বললেন । লিটন কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিলো না । মা আর নেই এটাই সে মানতে পারছে না ! তার মা আত্মহত্যা করেছে সে কথা তো ভাবতেই পারছে না ! কেমন জানি সব গুলিয়ে যাচ্ছে । মনের ভিতর না জানি কত রাগ - অভিমান জমা হয়ে গেছিলো । সেই ভার বইতে পারছিলো না আর তাই হইতো মুক্তি নিলেন ।লিনা একেবারে পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে । বিয়ের দিন শ্বশুর শাশুড়ির দোয়া তো পেলো না, ওলটা শাশুড়ি অভিমানে আত্মহত্যা করেছে । লিনা এইজন্য মনে মনে নিজেকে দ্বায়ী করছে । নিজেকে নিজে গালাগাল করছে । তার জন্যই আজ লিটনের এত বড় অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো । বাসা থেকে বের হয়ে লিটন গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কান্না করে দিলো ।বারবার বলতে লাগলো - আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও মা । ক্ষমা করে দাও । আমি এততাই অভাগা মা শেষবারের মতো তোমার ভার বহন করার অনুমতি আমার নাই মা । তোমার কবরে ১মুথ মাটি দেবার অনুমতি নাই আমার মা। লিনা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না । একটু দূরে দাঁড়িয়ে সেও কান্না করছে । লিটন কে কিছু বলার সাহসও পাচ্ছে না । লিটনের ছোট বেলার বন্ধু প্লাস প্রতিবেশি বিপ্লব জোর করে লিটন কে তাদের বাসায় নিয়ে গেলো । লিনাও সাথে গেলো । বিপ্লবের ড্রয়িং রুমে তিনটা মানুষ বসে আছে কিন্ত কেউ কোন কথা বলছে না । এত কিছু হয়ে গেলো এবং যাচ্ছে কিন্ত কারো মুখে কোন কথা নেই ।লিনার মনে হচ্ছে এই রাত আর শেষ হবে না ? দিনের আলো কি আর ফুটবে না ? কষ্টের আর যন্ত্রণার রাতগুলো অনেক বড় হয় । আচ্ছা এমন হয় কেন ? বিপ্লবের দারোয়ান এসে জানাইলো কাল সকাল ১০টায় সাহেলা বেগমের জানাজা হবে । সালেহা বেগম নাকি একটা চিঠি লিখে গেছে কিন্ত চিঠিতে কি
লেখা আছে সেটা এখনো জানা যায় নি । দারোয়ান এইটুকু বলেই চলে গেলো । চিঠিতে লি লেখা আছে সেটা জানার জন্য লিটন উঠে দাঁড়াইলো । +কিন্ত বিপ্লব ওকে যেতে দিলো না । বিপ্লব বললো চিঠিতে কি লেখা আছে সেটা ও নিজে জেনে এসে লিটনকে জানাবে । বিপ্লব লিনা এবং লিটনকে ফ্রেশ হয়ে ওর রুমে যেয়ে বসতে বললো । 

বিপ্লবের রুমে ঢুকেই লিনা লিটনের হাত ধরলো । হাত ধরেই অঝোরে কাঁদতে শুরু করলো । মনের ভিতরের সব কষ্ট মনে হচ্ছে এক নিমিশেই ঝরে যাবে । লিনা বার বার বলতে লাগলো - "আমার জন্য এতকিছু হয়ে গেলো । আমার জন্যই আমার শাশুড়ি আত্মহত্যা করলো । তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও । আমি কি করবো এখন কিছুই বুঝতে পারছি না ।" লিটন লিনার হাত শক্ত করে ধরে বললো - "দূর পাগলি ! তোমার জন্য কেন এমন হবে ? তোমাকে তো তারা চিনেই না । তুমিও তাদের দেখো নি । আমার ভাগ্যে যেমনটা লেখা ছিলো সেটাই হয়েছে । এখানে তোমার কোন দোষ নেই ।" এইটুকু বলেই দুইজন কাঁদতে লাগলো । কখনো কখনো কান্না কথা বলে । মানুষ শুধু চোখের পানি ফেলে ।তুমি আমার পুত্র তুল্য দেবরকে খুন করেছো, মিষ্টি মেয়েটাকেও  বাঁচতে দাও নি। আজ আমার শেষ সম্বল ছেলেটাকেও বাড়ি থেকে বের করে দিলে। আমি জানি তুমি এদেরও বাঁচতে দিবে না। তোমার পরিকল্পনার বাহিরে কেউ কাজ করলে তুমি তাকে বাঁচতে দাও না। আমি জানি না আমি কেন তোমাকে সবসময় অন্ধের মতো অনুসরণ করে যাই ! অনেক সময় এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি কিন্ত পাই নি। আজ যখন আমার ছেলেটা বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলো , মনে হচ্ছিলো কেউ ধারালো কোনো অস্রের মুখে বিষাক্ত কোনো বিষ লাগিয়ে আমার কলিজা টাকে টুকরা টুকরা করে ফেলছে। ছেলেকে তুমি বাসা থেকে বের করে দিছো তাতেই আমার এমন অনুভব হচ্ছে। আর আমি যদি জানি তুমি আমার ছেলে আর ছেলের বউকে খুন করছো তখন কেমন লাগবে ? আমি কি সহ্য করতে পারবো ? 

সেইসব কিছু দেখার আগে, জানার আগে আমি এই পৃথিবী ত্যাগ করলাম। তোমার সব কাজের একমাত্র সাক্ষী এবং সঙ্গী আমি ছিলাম। কিছু না করেও, মনে থেকে না মেনেও আমি তোমার সমান অপরাধী। সেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত আমি এখন করলাম। তোমাকে সম্পূর্ণ একা রেখে গেলাম। এটা হচ্ছে আমার পক্ষ থেকে তোমাকে দেওয়া সবথেকে বড় উপহার। তুমি কিন্ত মানুষকে সবসময় কিছু না কিছু রিটার্ন গিফট দাও। আমি তোমাকে এতো বড় গিফট করলাম নিশ্চয় আমার জন্যও কিছু রিটার্ন গিফট রয়েছে ? আমি জানি না তুমি আমাকে কতটা রিটার্ন উপহার দিবা তবে আমার একটা চাওয়া ছিলো। আশা করি আমার শেষ চাওয়া তুমি পূরণ করবা। আমার ছেলে আর বউটাকে তুমি কোনো উপকার করতে না পারো ক্ষতি কইরো না প্লিজ। তাদেরকে তাদের মতো বাঁচতে দাও। তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দাও। তুমি তাদেরকে তাদের মতো ছেড়ে দাও, কথা দিচ্ছি পরকালে আমি তোমার সাথেই থাকবো, তোমার সবকাজের আমার সাক্ষী এবং সঙ্গী হবো। কথা দিচ্ছি !চিঠিটা পড়ে হাসান সাহেব ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লেন। তার মাথা কাজ করছে না। তিনি মানুষ যতই খারাপ হোন বউকে কিন্ত খুব ভালোবাসতেন। সবসময় চেয়েছেন বউ যেন ভালো থাকে, সুখে থাকে। কিন্ত কি থেকে কি হয়ে গেলো ! হাসান সাহেবের মন খারাপের পাশাপাশি রাগও লাগছিলো। যে মানুষগুলো তার কথা না ভেবে, তার মান - সম্মানের কথা না ভেবে, তার পছন্দের - অপছন্দের কথা না ভেবে নিজেরা নিজেরা বিয়ে করে নিয়েছে তাদের জন্য কিসের এতো মায়া ? তাদের জন্য কিসের এতো মন খারাপ ? আর খুন ! হাসান সাহেব খুন করেছেন তা সত্যি নয়। তিনি শুধু ভয় দেখানোর কথা বলেছিলেন কিন্ত হোসেনের সেই বন্ধু রফিক যার মাধ্যমে হোসেন বাসা ভাড়া নিয়েছিলো সে খুন করেছে।

রফিক জয়ীকে চেয়েছিলো কিন্ত পায় নি। রফিক সবসময় হোসেন হতে চেয়েছিলো কিন্ত পারে নি। রফিক মনে মনে খুব হিংসা করতো হোসেনকে। কিন্ত সেই হিংসা যে এতো হিংস্র হয়ে যাবে সেটা কে কবে ভেবেছে ! হোসেন যখন জয়ীকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছিলো হাসান সাহেব একজন লোক তার পিছনে লাগিয়ে রেখেছিলো। হোসেন যখন রফিকের রেফারেন্স বাসা ভাড়া নেয় , তখন রফিক মনে মনে পরিকল্পনা করে নেয় কিভাবে কি করবে। এইদিকে হাসান সাহেব অন্য ভাড়াটে গুন্ডা ভাড়া করেন হোসেন আর জয়ীকে ভয় দেখানোর জন্য। হোসেন আর জয়ী যেন আলাদা হয়ে যায়, তা না হলে যে কেউ একজন যেকোনো সময় খুন হয়ে যাবে। হাসান সাহেবের কথা সালেহা বেগম শুনে ফেলে। হাসান সাহেব তখন নিজের রুমে পায়চারি করতে করতে ফোনে কথা বলছিলেন। সালেহা বেগমের ফোন তখন নিজের রুমে ছিলো তাই তিনি দ্রুত লিটনের রুমে ঢুকে লিটনের ফোন থেকে হোসেনকে ফোন দেন। হাসান সাহেব যে গুন্ডাকে ভাড়া করেন তার বস হচ্ছে হোসেনের বন্ধু রফিক। রফিক ডাক্তার হতে যেয়ে নেতা হয়ে গেছেন। পড়াশোনা দিয়ে বেশি দূর এগোতে পারেন নি তাই নিজের এলাকায় আধিপত্য তৈরী করে নেতা হয়ে আছেন। সেই গুন্ডা যখন রফিককে জানাইলো সে একটা কাজের অফার পেয়েছে এবং কাজটা ভয় দেখানোর তখন রফিক যেন হাতে আসমানের চাঁদ পেলো। নিজেই সে কাজ নিজের হাতে তুলে নিলেন। ভয় দেখানোর বদলে নিজের মনের ঝাঁজ মেটালেন হোসেন এবং জয়ীকে ধাঁরালো কুঁড়াল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের শ্বাস পড়ছিলো ততক্ষন রফিক ওদের আঘাত করে গেলো। সালেহা বেগমের ফোন পাওয়ার পর হোসেন বুঝতে পারলো না কি করবে, কোথায় যাবে ! বিশেষ করে সে বুঝতে পারছিলো না তার নিজের ভাই কিভাবে, বাবার জায়গায় যাকে বসানো সে কিভাবে এই কাজ করতে পারে। নিজের বোধশক্তি, চিন্তাশক্তি কিছুই কাজ করছিলো না। তখনই দরজায় নক হলো। রফিককে দেখে হোসেন কিছুটা স্বস্তি অনুভব করলো। 

মনে হলো বন্ধুর সাথে শেয়ার করে কিছু একটা উপায় বের করা যাবে। হোসেন কি আর জানতো বন্ধু এখন প্রাণনাশক হয়ে গেছে বা যেতে পারে ? রফিকের সাথে আরো ৩-৪জন লোক ছিলো। রফিক বাসায় ঢুকার সময় বললো - "তোমরা নুতন এই এলাকায় এসেছো। অনেক কিছুই এখানে চিনো না, জানো না। আমিও সবসময় থাকবো না। তাই এদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে এলাম। "এরা সবাই বাসায় ঢুকেই দরজা বন্ধ করে হোসেন আর জয়ীর মুখ বেঁধে দিলো। তারপর রফিক রফিকের কাজ করে গেলো। হোসেন আর জয়ীর স্বপ্ন এবং সংসার রফিকের বের করে রক্তে ভেসে গেলো।

চলবে....

Leave a Comment