ভয় ( শেষ পর্ব )

  • ফারজানা আক্তার 
  • ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১৮

সালেহা বেগমের জানাজার জন্য লিটনদের বাসার পাশের ঈদগাহ ঠিক করা হয়েছে। সকাল ১০টা বাজতে না বাজতেই অনেক মানুষ ঈদগাহে ভিড় করতে শুরু করেছে। আত্মহত্যা করা মানুষগুলোর নাকি জানাজা করা হয় না। কিন্ত একটা মানুষ যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় তখন কি তার ওপর কোনো অভিমান বা নিয়ম খাটানো যায় ? না জানি কত লুকানো মান - অভিমান আর রাগে দুঃখে একটা মানুষ নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ! এরকম মানুষগুলোর জীবন অপূর্ণতায় পরিপূর্ন থাকে। তাই পৃথিবী ছাড়ার আগে যে কয়টা নিয়ম থাকে সেগুলো ঠিকমতো পালন করার দায়িত্ব বেঁচে থাকা মানুষগুলোর কাঁধে এমনিই এসে যায়। ইমাম সাহেব জানাজা শুরু করলেন। অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে লিটনও জানাজা করলো। জানাজা শেষে সবাই লাশের পাশে হাঁটতে হাঁটতে কবরে গেলো আর লিটন গেলো চুপিচুপি অনেকটা চোরের মতো। লাশ কবরে নামানোর সময় লিটন ছুটে আসতে চাইলো, মায়ের কফিনটা একবার ছুঁয়ে দেখতে চাইলো কিন্ত বিপ্লব তাকে ধরে রাখলো। কবরস্থানে কোনো চিৎকার চেঁচামেচি হোক সেটা বিপ্লব চায় নি। লিটনও চায় না কোন চিৎকার চেঁচামেচি হোক কিন্ত মা তো, একবার শেষ দেখার অধিকার তার তো রয়েছে। মাটি দেয়া শেষ করে সবাই যখন চলে গেলো তখন লিটন মায়ের কবরের সামনে গেলো। কবরের সামনে যেয়েই লিটন হাউমাউ করে পাগলের মতো কান্না শুরু করে দিলো। বিপ্লব কোনো রকমে লিটনকে তুলে ধরে বাসায় নিয়ে গেলো। বাসায় লিনা চুপচাপ ড্রইং রুমে বসে ছিলো। লিটন বাসায় ঢুকতেই লিনা ছুটে গেলো লিটনের দিকে।

জানতে চাইলো জানাজা হয়ে গেছে কিনা, কবর দেয়া হয়েছে কিনা, লিটন জানাজায় অংশগ্রহণ করেছে কিনা ! লিনা লিনার নিজস্ব স্বভাবের মতো একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে। লিটন কোনো উত্তর দিচ্ছে না, চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বিপ্লব লিনাকে হাতে ইশারা দিয়ে থামিয়ে দিলো। চোখের ইশারায় বলবো জানাজা এবং কবর দেওয়া হয়ে গেছে। পরে সব ডিটেলসে বলবে। এমন সময় লিটনের ফোনে একটা ফোন আসলো। লিটন পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলে হাসান সাহেব ফোন করেছেন। লিটন একবার বিপ্লব আর একবার লিনার দিকে
তাকাইলো। দুইজনেই ফোন রিসিভ করতে বলবো। লিটন ফোন রিসিভ করে কোনোরকমে হ্যালো বললো।

হাসান সাহেব : কি নতুন সংসার কেমন লাগছে ?

লিটন : আপনি কি এই কথাটা জিজ্ঞেস করার জন্য আমাকে ফোন দিয়েছেন ?

হাসান সাহেব : না। তোমার কাছ থেকে কিছু জানার জন্য ফোন দেই নি। তোমাকে জানানোর জন্য ফোন দিয়েছি। আর সংসারের কথা জিজ্ঞেস
করলাম ফর্মালিটির জন্য।

লিটন : কি জানাবেন আপনি ?

হাসান সাহেব : তোমার মা একটা চিঠি লিখে গেছে সেটা জানো নিশ্চয় ? কি লিখে গেছে সেটা জানবা না ?লিটন মনে মনে অস্থির হয়ে ছিলো তার মা চিঠিতে কি লিখে গেছে সেটা জানার জন্য। তাই সাত পাঁচ না ভেবেই জিজ্ঞেস করলো - কি লিখে গেছে মা ? 

হাসান সাহেব : লিখে গেছে তোমাদের সে কখনো ক্ষমা করবে না। আর আমাকেও ক্ষমা করতে নিষেধ করে গেছে। তোমাদের সে ঘৃণা করে , খুব ঘৃণা করে। তোমার মতো ছেলেকে পেটে ধরেছে তাই তার নিজের প্রতিও খুব ঘৃণা হচ্ছিলো তাই সে তার জীবন শেষ করে দিয়েছে। আর তোমাকে
এই কথাটা জানানোর দায়িত্ব আমাকে দিয়ে গেছে। লিটন কিছু না বলে ফোনটা কেটে দিলো। তারপর চুপচাপ বিপ্লবের রুমে ঢুকে দরজা ভিতর থেকে লোক করে দিলো। লিনা দৌঁড়ে দরজার দিকে যাচ্ছিলো বিপ্লব না করলো। শুধু বললো ওকে কিছুক্ষন ওর মতো থাকতে দাও। হাসান সাহেব বউয়ের শেষ কথাও রেখেছে আর নিজের প্রতিশোধও নিয়েছে। সালেহা বেগম চিঠিতে লিখে গেছেন লিটনদের খুন না করতে , তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দিতে। হাসান সাহেব ওদের খুনও করবে না আবার তাদেরকে তাদের মতোই থাকতে দিয়েছে , শুধু মনের মাঝে একটু বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে। এই বিষের জ্বালা তারা দুইজন যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন জ্বলবে। লিটন রুমের ভিতর ঢুকে লাইট অফ করে দিলো। সব কয়টা জানালা বন্ধ করে দিলো। তারপর খাটের ওপর বসে ভাবতে লাগলো - মা এমন কথা লিখেছে ? মা এমন করে ভাবতে পারে ? মা আমাকে ঘৃণা করতে পারে ? না , আমার মা এমনটা করতে পারেন না। বাবা নামের সেই শয়তান মানুষটা বানিয়ে বানিয়ে বলছে এসব। তাহলে মা হটাৎ নিজের আত্মহনন কেন করলো ? মা আমার ওপর রাগকে ওরে এসব করেছে ?আচ্ছা লিনাকে কি বলবো এখন ? ওর তো কোনো দোষ নেই। আমার নিজের পরিবারের আগুনে কেন মেয়েটা জ্বলবে ? কিন্ত যাকে বিয়ে করেছি বলে আমার মা আমাকে ঘৃণা করে, আমার মতো সন্তান পেটে ধরেছে বলে আত্মহত্যা করেছে তাকেই কি আমি ভালোবাসার মতো ভালোবাসতে পারবো ? তাকে কি ভালো রাখতে পারবো ?এমন হাজারটা প্রশ্ন লিটনের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। 

কোনোটার উত্তরই তার জানা নেই। কয়েক ঘন্টা নিজের সাথে প্রশ্ন উত্তর খেলার পর লিটন সিন্ধান্ত নিলো যে, যা হবার হয়ে গেছে। কিন্ত সামনে যেন খারাপ কিছু না হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। তার মা এমন কথা বলার মানুষ নয়, আর যদি বলেও থাকে সে কথার কোনো প্রমান তার কাছে নেই। তার বাবার মতো মানুষের কথায় যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে তাকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। তার মতো মানুষকে ভরসা করে মেয়েটাও আজ ঘর ছাড়া, বাবা -মা ছাড়া। লিটন রুম থেকে বের হয়ে বিপ্লবকে বললো তার বাসায় আরো দুইদিন তারা থাকতে চায়। এই দুইদিনে
একটা বাসা দেখে তারা চলে যাবে। বিপ্লব বললো দুইদিন না, তাদের যতদিন ইচ্ছে এই বাসায় থাকতে পারে। বাবা -মা এখন দেশের বাহিরে আছে, বিপ্লব একাই এতো বড় বাসায় থাকে এখন। দুইদিন না, লিটন আর লিনা বিপ্লবের বাসায় ৭দিন ছিলো। ৭দিন পর তাদের ভাড়া করা নতুন বাসায় উঠলো। দুইজনই কেমন রোবোটিক হয়ে গেছে এই কয়দিনে। বিয়ে করার পর থেকে দুইজনের ওপর দিয়ে যা গেলো এবং চোখের সামনে যা যা ঘটে গেলো সেটা কাটিয়ে উঠতে পারছে না কেউ। সেদিন লিটন দরজা খুলে যখন বের হলো লিনা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো হাসান সাহেব
ফোনে তাকে কি বলেছিলো ? লিটন শুধু বলেছিলো এই বিষয়ে সে কোনো কথা বলতে চায় না। সেই কথা সেখানেই শেষ। লিনা আর এই বিষয়ে
কোনো কথা বলে নাই। দুই -তিন মাস পর তারা দুইজন কিছুটা স্বাভাবিক জীপনযাপনে ফিরে এসেছিলো। লিনার সেই সেমিষ্টার গ্যাপ হয়ে গেছিলো। ফাইনাল পরীক্ষা দেয়া হয় নি। তাই সে নতুন করে আবার সেমিষ্টার শুরু করলো। লিনা আগের মতো কথা বলে না, হাসে না। যতটুকু
দরকার ঠিক ততটুকুই কথা বলে। লিটন এমনিই চুপচাপ ছিলো এখন আরো হয়ে গেছে। সে যদি পারতো তাহলে একেবারেই মুখে কুলুপ এঁটে
থাকতো। কিন্ত দিন চলে যাচ্ছিলো। লিটন আজ এখনো বাসায় ফিরে আসে নি। লিনা বাসায় একা রয়েছে। ও এমনি খুব ভীতু মেয়ে। লিটন
কখনো বাসায় দেরি করে আসে না। ফোনটাও অফ করে রেখেছে। লিনা কি করবে বুঝতে পারছে না। বাসা থেকে বের হয়ে কোথাও খুঁজবে সেটাও বুঝতে পারছে না। লিনা বিপ্লবকেফোন দিলো , বিপ্লবও কিছু বলতে পারলো না। কিছু না বুঝে লিনা কান্না শুরু করে দিলো। একটা সময়
যে মেয়েটা কারণে অকারণে হেসে বেড়াত ,আজ সে মেয়েটা কারণে অকারণে কেঁদে ফেলে। 

লিনা কলিং বেলের শব্দ শুনে দৌঁড়ে গেলো। দরজা খুলে দেখে লিটন দাঁড়িয়ে আছে। দরজায় লিটন মিটমিট করে হাসছে। লিটনের হাসি দেখে লিনার অভিমান বেড়ে যেয়ে চোখ দিয়ে পানি হয়ে বের হয়ে আসলো। এই কান্না কিছুটা স্বস্তির , কিছুটা আনন্দের আর বাকি সবটা অভিমানের। লিনার মাথায় হাত রেখে লিটন বললো , "সব চোখের পানি এখনই শেষ করে ফেলবা ? কিছুটা রাখো এখনই দরকার হবে আবার " লিনা কিছু না বুঝে হা করে তাকিয়ে রইলো। লিটন সামনে থেকে সরে গেলে লিনা দেখে লিনার বাবা - মা পিছনে তাকিয়ে আছে। লিনা স্বপ্ন দেখছে নাকি বাস্তবে এমনটা হচ্ছে বুঝতে পারছে না। বুঝার দরকারও নেই। লিনা দৌঁড়ে যেয়ে নিজের বাবাকে ঝাপটে ধরে চিৎকার করে কান্না শুরু করলো।
এরকম কান্না শুধু মরা বাড়িতেই হয়ে থাকে। একেবারে হারিয়ে ফেলার কান্না আর হারিয়ে যাওয়া প্রিয় কিছু ফিরে পাওয়ার কান্নার সুর মনে হয় একই ! লিনার সংসারে এই প্রথম লিনার বাবা - মা আসলো। অভিমান দুঃখ-কষ্ট সব ভুলে চারজন মিলে গল্প করছে। আজ এই পরিবারটাকে পরিপূর্ন মনে হচ্ছে। কারো চেহারায় দুঃখ দুঃখ সেই ভাবটা আজ নেই। গল্প করতে করতে কখন যে রাত হয়ে গেছে কেউ বুঝতেই পারলো না। ১১.৫৯মিনিটে হঠাৎ করে লিটন চিৎকার করে উঠলো - না ভয় পাবার কিছু নেই। ভয়ের বা কষ্টের কোনো চিৎকার নয় ! লিটন চিৎকার করে লিনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাইলো। লিনার কাছে যেয়ে বললো , "তোমার জন্মদিনের উপহার আনতে যেয়েই আমার আজ বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে গেলো। আর ফোনে চার্জ ছিলো না তাই অফ হয়ে গেছিলো "একসাথে এতো কিছু ঘটে গেছে যে লিটনের ফোন বন্ধ কেন ? আর আজ ওর কেন বাসায় আসতে দেরি হলো, হঠাৎ করে ও তার বাবা -মাকেই বা কোথায় পেলো কিছুই জিজ্ঞেস করা হয় নি।

লিনা বললো, "তুমি আমার বাসায় গিয়েছিলে ?" লিটন বললো, "তুমি তোমার বাবা -মায়ের ম্যারিজ ডেটে আমাকে দিতে চেয়েছিলে কিন্ত পারো নি ! তোমার জন্মদিনে আমি তোমার বাবা -মাকে তোমায় দিতে চেয়েছিলাম , আমি পেরেছি। নাউ সে সামথিং স্পেশাল " । লিটন কথা শেষ করতে না করতেই লিনার বাবা -মা কেক সামনে নিয়ে হাজির। অনেক দিন পর একটা পরিবার আনন্দের মুখোমুখি হলো। সেই আনন্দের ভাগিদার হতে রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদও নিজস্ব আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। লিটন অফিস শেষ করেই সোজা লিনাদের বাসায় চলে যায় । লিটনকে হটাত দেখে লিনার মা কিছুটা চমকে যায় । মনে মনে ভাবে মেয়েটার কিছু হয় নি তো ! কিন্ত একা একা এই কথা জিজ্ঞেস করার সাহস পায় না । লিটনকে ড্রয়িং রুমে বসতে বলে নিজের রুমে চলে গেলো । নিজের স্বামীকে রুম থেকে সাথে করে নিয়ে তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হয়ে আসলো । স্বামী – স্ত্রী দুইজনেই ইদ্ধিগ্ন মনে জানতে চাইলো লিনার কথা ! ও কেমন আছে ? ওর কিছু হয়েছে ? ও কি করছে ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারটা কথা । লিটন কোন রকমে দুইজনকে শান্ত করে নিজে বলতে শুরু করলো – লিনা ভালো আছে কিন্ত সুখে নেই । মানুষ একা একা ভালো থাকতে পারে, সুখে না । সুখ ভাগাভাগি করতে হয় , সুখকে ভাগ না করলে সে সুখ পরিপূর্ণ হয় না । আমরা প্রিয় জনের সাথেই সুখ ভাগ করতে পছন্দ করি । কিন্ত লিনার প্রিয়মুখ দুটো তো অভিমান করে অনেক দূরে রয়েছে তাই লিনা একটুও সুখে নেই । এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে লিটন দম ফেললো । লিটন থামতেই লিনার মা হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো । লিনার বাবা মাথা নিচু করে বললো – আমরাও ভালো আছি কিন্ত সুখে নেই । আমার ঘরের সুখটাই তো আমার ঘরে নাই ?

লিটন ঃ বাবা, আপনার ঘরের সুখটা আমার ঘরে আছে কিন্ত সুখের আলো নেই , সারাক্ষণ অন্ধকার হয়ে থাকে ! একবার আসবেন আমার ঘরে আলোটা জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য ?লিটন এই প্রথম লিনার বাবাকে বাবা বলে ডাকলো । বাবা শব্দটা শুনে লিনার বাবা এবং মা একসাথে লিটনের দিকে তাকাইলো । 

লিটন উঠে যেয়ে লিনার মা’র হাত ধরে বললো – মাযাবেন তো একবার আমার ঘরে ? মা – বাবাহীন জীবনে আমাদের দুইজনের দম আটকিয়ে
আসছে । লিনার মা লিটনের এক গালে হাত রেখে বললো – “আমার মেয়ে মানুষ চিনতে ভুল করে নাই । কিন্ত আমরা আমাদের মেয়েকে চিনতে ভুল করেছি । যাবো বাবা যাবো !”লিনার বাবা উঠে লিটনের মাথায় হাত রাখলো । ধীরে ধীরে বললেন, “বাবা, ক্ষমা করো আমাদের । মান -
অভিমানের পরিমান এত বেশি হয়ে গেছিলো যে তোমার মায়ের সব খবর কানে এসেছে , তারপরেও তোমাদের খোঁজ খবর নেই নি । কখনো কখনো অতিরিক্ত অভিমান দায়িত্ব –কর্তব্যকে ভুলিয়ে দেয়” 

লিটন বসা থেকে উঠে বললো, “’বাবা আমরা সব অতীত ভুলে যেয়ে নতুন করে শুরু করি । আমি আর লিনা যে কাজ করেছি সেটা অভিমান করার মতোই । আমরা একটু বেশীয় আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলাম যে কারনে আমাদের দায়িত্ব-বোধ লোপ পেয়েছিলো !

Leave a Comment