ন্যাচারাল_রিভেঞ্জ ( প্রাকৃতিক প্রতিশোধ )

  • সোহাইল রহমান 
  • ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৮

এই জন্মে তেলাপোকা হওয়ার আগের জন্মে আমি মানুষ ছিলাম। একেবারে জলজ্যান্ত হোমো-স্যাপিয়েন্স। সেই কতবছর আগে আমি মারা গেছি। তারপর যখন আবার জন্ম নিলাম তখন উপলব্ধি করলাম আমি আর মানুষ নেই। আমি একটা খয়েরী রঙের শুঁড়ওয়ালা ঘিনঘিনে তেলাপোকা। এই সিস্টেমটা খুব সম্ভবত নতুন। আপনি মানব জন্মে কারো বড় কোনো ক্ষতি করলে পরের জন্মে আপনার উপর প্রতিশোধ নেওয়া হবে। আপনাকে সৃষ্টি করা হবে অন্য কোনো প্রানী হিসাবে। যেমন আমি একজনের কথা জানি সে কোনো প্রয়োজন ছাড়াই বন্দুক দিয়ে পাখি মারতো। শুধু খাওয়ার উদ্দেশ্যেই না। কারণ কাক, ময়না, কাকাতুয়া; যা পেত সব মারতো। সুতরাং পরের জন্মে সেই লোকটা একটা গুবরে পোকা হয়ে দুনিয়াতে আসে আর একটা কাক তাকে ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে ফেলে। ব্যাপারটা আমি জানতে পারি সেই গুবরে পোকাটার কাছ থেকে। এই এক অদ্ভুত নিয়ম। পোকা হয়ে জন্মানোর পরেও তার আগের মানব জন্মের সব কথা মনে থাকবে। যাতে সে বুঝতে পারে তাকে কেন শাস্তি দেয়া হচ্ছে। বুঝতে পেরে সেই পাপের জন্য তার অনুশোচনা হয়।

আমার জন্মটা হয়েছে এক নিম্ন মধ্যবিত্ত তেলাপোকা পরিবারে। ঢাকার ধানমন্ডিতে মোটামুটি বড়লোক ফ্যামিলির রান্নাঘরে আমাদের বাসা। আমার বাবা মা কেউ বেচে নেই। বাবা মারা গেছেন লাল হিটের স্প্রে তে আর মাকে ঐ বাসার কাজের বুয়া এক রাতে স্যান্ডেল দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে। যেসব তেলাপোকার জন্ম হয় ধনী ফ্যামিলিতে, ছোটবেলায় তাদেরকে লাল হিট- কালো হিট বা ম্যাজিক চক নিরোধক টিকা দেয়া হয়। তারা গায়ে সবসময় আঘাতপ্রুফ জ্যাকেট পরে থাকে। তাদের লাইফ অনেক বেশি সিকিউরড। কিন্তু আমাদের মতো মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র তেলাপোকাদের জীবন বড় সংগ্রামী জীবন। মাসুদ রানার মতো পদে পদে বিপদ, শিহরণ আর মৃত্যুর হাতছানী। তারপর আরো আছে। এই বাসার অধিকাংশ তেলাপোকার হার্টে রিং পরানো। অনেকেরই এক বা একাধিকবার বাইপাস সার্জারি করা। আর যাদের অপারেশনের টাকা নেই তারা মারা যায় বিনা চিকিৎসায় হার্ট এটাকে। এর পেছনের মূল কারণ এই বাসার মেয়েরা। বাড়ীওয়ালী আন্টি থেকে শুরু করে স্কুল পড়ুয়া পিচ্চি মেয়ে, প্রত্যেকেই তেলাপোকা দেখলে এমন চিৎকার দিয়ে ওঠে যে সাথে সাথেই অনেকের হার্ট ফেইল করে। যারা সামলে নিতে পারে তাদের হৃদয়েও স্থায়ী ব্লক পড়ে। এছাড়াও এখন অব্দি বাসার তিনটা তেলাপোকার কান নষ্ট হয়ে যাওয়ায়ার পেছনের কারণও এটাই। 

তবে এসবে আমার খুব বেশি কিছু হয়না কখনোই। আমি লাল কালা হিটের স্প্রে, রমনীদের চিৎকার, ম্যাজিক চকের লাইন, পোকা মারা বিষ বা বুয়াদের ঝাড়ু, স্যান্ডেলের বাড়ির মধ্যে থেকেও সারভাইভ করি। প্রতিবার বেচে যাই কোনোমতে ভাগ্যক্রমে। কখনো পা ভাঙা বা শুড় ছেড়ার চাইতে বেশি কিছু হয়নি। কারণ আমি জানি আমার মৃত্যু স্বাভাবিক ভাবে হবে না। আমার মৃত্যু হবে প্রকৃতির ঠিক করে রাখা কঠিন শাস্তিমূলক পদ্ধতিতে। প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবে আমার মানবজীবনের কৃত কর্মের। আমি টেনশনে বাড়িওয়ালার হাই প্রেশারের ঔষধ চুরি করে খেতে খেতে অপেক্ষা করি। কবে আসবে সেই দিন? তারপর একদিন আমার মনে হলো সেই দিনটা হয়তো এসে গেছে। তবে আমি খুব বেশি শিওর না। এক সকালে দুইটা ইয়াং ছেলে আমাকে ফাদে ফেলে ধরে ফেললো। ছেলেদুটোর চেহারা দেখে মনে হলো স্কুল বা কলেজে পড়ে। মুখে হালকা গোফের রেখা। এইসব পোলাপাইনদের নিয়ে প্রবলেম। এরা তেলাপোকা ভয় পায় না মোটেও। এখন আমাকে নিয়ে কি করবে কে জানে! এর আগে এক বেয়াদব ছেলে আমার পায়ে সুতা বেধে উলটো করে ঝুলাই রাখছিলো ছাদের সাথে। আর একটু হলে মাথায় রক্ত উঠে ব্রেইন স্ট্রোক হচ্ছিলো সেদিন। তবে এদের ভাবসাব দেখে ভদ্রই মনে হলো। আমাকে ধরে নিয়ে একটা সাদা বোর্ডের উপর উলটা করে রাখতেই সবকিছু হঠ্যাৎ করেই আমার কাছে একদম পরিষ্কার হয়ে গেলো। ভয়ে সারা শরীর জমে গেলো। বুঝতে পারলাম এরা এখন আমাকে কাটবে। কেটেকুটে এক্সপেরিমেন্ট করবে। আরো ভয় পেলাম যখন দেখলাম ক্লোরোফর্ম ইউজ না করে একজন আমাকে আঙুল দিয়ে বোর্ডের সাথে চেপে ধরলো। আরেকজন এগিয়ে আসলো সার্জিকাল ব্লেড হাতে। অজ্ঞান না করেই কাটবে। কি সর্বনাশ!

পেট অর্ধেক ফেড়ে ফেলেছে। আমার তীব্র কষ্ট হচ্ছে। চিৎকার দিচ্ছি গলা ফাটিয়ে, কিন্তু মানুষের শ্রবণ ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে শুনতে পাচ্ছেনা কেউ। আমার অতীত মনে পড়ে গেলো হঠ্যাৎ। আমি যখন মানুষ ছিলাম তখন ছাত্রদেরকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছি। নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট। এটাই কি তবে আমার শাস্তি? আমাকে মরতে হবে ছাত্রদের এক্সপেরিমেন্টের স্বীকার হয়ে? আমি আর সহ্য করতে পারছি না। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। এতো কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা ইশ্বর তেলাপোকাকে দেয়নি। আমার ফুসফুস, হার্ট, ব্রেইন সবকিছুতে ব্লেড চালানো হচ্ছে। আমি মনেপ্রাণে আমার মৃত্যু কামনা করছি। আমার সমস্ত চেতনা একীভূত হয়ে যন্ত্রনার অবসান চাচ্ছে। কিন্তু না! হঠ্যাৎ ছেলেদুটো ব্লেড চালানো বন্ধ করে দিলো। ইতস্তত করছে আমাকে কাটতে।ওদের কথা শুনে বুঝলাম কিছু একটা ভুল হয়েছে। কোনো কারণে এক্সপেরিমেন্ট ব্যার্থ হয়েছে। এটা বাদ দিয়ে অন্য তেলাপোকা আনতে হবে। একজন আমার শুঁড় ধরে ছিন্নভিন্ন অবস্থায় একপাশে ছুড়ে ফেলে দিলো। বুঝতে পারলাম আমি মারা যাবো না। আমি বেচে থাকবো। দুইজন ছাত্রের ব্যার্থ এক্সপেরিমেন্টের ফসল আমাকে ভোগ করতে হবে আজীবন। আমি বেচে থাকবো অথর্ব হয়ে। আমি বেচে থাকবো প্রচন্ড কষ্ট নিয়ে। আমি খুব আস্তে আস্তে ধ্বংস হয়ে যাবো আর এটাই হবে আমার মানবজনমের কার্যফল, প্রকৃতি প্রদত্ত নিষ্ঠুর প্রতিশোধ।

আর হ্যা, আগের জন্মে আমি ছিলাম খুব ক্ষমতাবান একজন ব্যক্তি। আমি ছিলাম পৃথিবীর খুব ছোট্ট একটা দেশের শিক্ষামন্ত্রী। ছাত্রদের উপর নিজের ইচ্ছামত এক্সপেরিমেন্ট চাপিয়ে দিয়ে আমি পুরো দেশের শিক্ষাব্যবস্থা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ধ্বংশ করে ফেলেছিলাম। আমার নাম ছিলো....*** সাতান্ন ধারা এলার্ট!!!
 

Leave a Comment