রহস্য

  • পলক হোসেন 
  • ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৮

বিয়েটা হলো একটি সুন্দরী যুবতী মেয়ের সাথে।গায়ের রঙ আর তার সৌন্দর্য অবাক করার মতো।তবে একটা বিষয় নিয়ে প্রায়ই অবাক হতে হয় সায়েমকে। এই রুপবতী মেয়েটির নাম 'রহস্য' রাখা হলো কেন! রুপা,অপরুপা,মাধুরী নাম হলে চমৎকার হতো। সায়েম তার স্ত্রীকে একবার প্রশ্ন করেই ফেললো-

-আচ্ছা,তোমার নাম 'রহস্য' রাখার পেছনে রহস্য কি? রহস্য কিছুই বললো না।প্রশ্নটা শোনা মাত্রই চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে থাকলো সায়েমের দিকে।সায়েম বললো-

-কি হলো রহস্য?তোমার নাম 'রহস্য' রাখার কারনটা কি তুমি জানো?

রহস্য না সূচক মাথা নাড়ালো।মেয়েটি হয়তো জানে না।আর জানলেও হয়তো বলতে পারছে না।মেয়েটির সাথে তার সংসার শুরু হয়েছে প্রায় এক সপ্তাহের মতো হবে।এই কয়দিনে সায়েম এই মেয়ের সম্পর্কে যতোটুকু বুঝেছে সে স্বামী ভীতু।তাকে স্বামী ভীতু মনে করার কারনও আছে অবশ্যি।বাসর রাতের দিনের কথা।সায়েম রহস্যকে বললো-

-শোনো বউ,তোমাকে কিছু কথা বলে রাখি।আমি ঢাকায় কাজ করি।আমার কর্মস্থল সেখানে।কাল পরশুর মধ্যেই তোমাকে আমার গ্রামের বাড়ি থেকে আমার সাথে করে সেখানে যাবো।সেখানে একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে একা থাকি আমি।সেখানে তুমি তোমার ইচ্ছেমত চলতে পারবে তবে সেটা আমার নির্দেশানুযায়ী।সেখানে তোমার ননদ-দেবর,শশুর-শাশুড়ি নিয়ে ঝামেলায় পরতে হবে না।সংসার নিজ ইচ্ছেমত চালাতে হবে।কি পারবে তো?

রহস্য বললো-
-জি পারবো।
-বিয়ের পর স্বামীর কথা মতো চলাই প্রতিটা স্ত্রীর ধর্ম।জানো তো?
রহস্য বললো-
-জী।
-আচ্ছা শোনো,আমি ঘুমাবো।তুমি আমার পা টিপে দেও।বসে বসে আমার সেবা করে স্ত্রী ধর্ম পালন করো। রহস্য ওই রাতে সত্যি সত্যি ঘুমায় নি।সারারাত বসে বসে স্বামীর পা টিপে দিয়েছে।ভোরের দিকে সায়েমের ঘুম যখন পাতলা হয়ে আসলো তখন মনে হলো তার পায়ে কেউ হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।সায়েম চোখ খুলে ধপ করে উঠে বললো-

-সে কি?তুমি ঘুমাও নি?
-আপনি তো বললেন পা টিপে দিতে।
-এর জন্য তুমি সারারাত জেগে ছিলে?
-জি।
সায়েম রহস্যকে ধরে বললো-
-ঘুমিয়ে পরো।
-ভোর তো হয়ে গেছে।
-তাতে কিছু আসে যায় না।এই মুহূর্তে তোমার চোখের বিশ্রাম দরকার।

এই ঘটনার পর থেকেই রহস্যর প্রতি মায়া জন্মে গেলো। আর সায়েম বুঝে গেলো এই মেয়ে স্বামীর কথা অমান্য করার মতো মেয়ে না। গতপরশু সায়েম রহস্যকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে এই বাড়িতে এসেছে।স্বামী-স্ত্রী ভালোভাবেই বসবাস শুরু করেছে। রহস্য সকালে উঠেই চা নাস্তা বানাতে লেগে যায়।সায়েম কাজ থেকে যখন বিকেলে বাসায় ফিরে আসে তখনও দেখা যায় রহস্য কোনো না কোনো কাজে নিজেকে বেধেই রেখেছে।
আজ ছুটির দিন হওয়ায় রহস্যকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা মাথায় ঘুর ঘুর করছে। সায়েম রহস্যকে ডেকে বললো-

-চলো,তোমাকে নিয়ে বাহিরে কোথাও যাই।যাবে আমার সাথে?

রহস্য কথা বললো না।ওকে দেখে স্বাভাবিক মনে হলো।স্বামী তার বউকে নিয়ে ঘুরতে যাবে।এইটা একজন নব বধুর কাছে অবশ্যই একটা আনন্দের ব্যাপার কিন্তু রহস্যকে দেখে তেমন আনন্দিত মনে হলো না।ওর চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে খুব ক্লান্ত।সায়েম বললো-

-তোমার কি শরীর খারাপ? রহস্য চোখ নামিয়ে বললো-
-জি,একটু খারাপ।
-শোনো রহস্য,যেকোনো অসুবিধা হলে তুমি আমাকে জানাবে।কোনো কিছু লুকিয়ে রাখবে না।কারন আমি তোমার স্বামী।এইখানে আমি ছাড়া তোমার ভালো মন্দ বিচার করার মতো কেউ নেই।সুতরাং তোমার সকল সুবিধা-অসুবিধা আমাকে জানানো হবে তোমার দায়িত্ব।
-জি আচ্ছা।
-যদি পারো আজ একটা নীল রঙের শাড়ি পরবে তো।সাদা ব্লাউজ আর নীল শাড়ির ক্যামিস্ট্রিতে তোমাকে দেখবো।

রহস্য গোসল সেরে ঠিকই নীল রঙের একটি শাড়ি পরলো।তবে সাদা ব্লাউজ পরে নি।পরেছে কালো ব্লাউজ।নীল শাড়ি আর কালো ব্লাউজে যে খুব বেশী খারাপ লাগছে তাও না। আয়নার সামনে বসে ভেজা চুল আচড়াতে বসেছে রহস্য।মেয়েটির এই রহস্যময় রুপের জন্যই তার নাম রহস্য রাখা হলো কি না কে জানে!আয়নার সামনে বসে মেয়েদের চুল আচড়ানোর দৃশ্য পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে একটি ঘোষণা করলে মন্দ হতো না।রহস্য খেয়াল করলো সায়েম তার দিকে তাকিয়ে আছে।স্বামী তার স্ত্রীর দিকে দিন-রাত তাকিয়ে থাকলে বিষয়টি হয় এক ধরনের অদৃশ্য ভালোবাসা।কিন্তু রহস্যর কাছে বিষয়টি খুব অস্বস্তিকর লাগছে।রহস্য আয়নার সামনে থেকে উঠে গিয়ে বললো-

-আপনার জন্য খাবার গরম করে আনি।
সায়েম ঘোর কাটিয়ে বললো-
-এখন কিছু খাবো না।তুমি চাইলে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসতে পারো।

রহস্য উঠে গিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো।রহস্য চা মজা করে বানাতে জানে।মজাদার চা বানানো বউ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।সায়েমের মাঝেমধ্যে মনে হয় সে খুব ভাগ্যবান।চমৎকার স্বাদের চা বানানোর মতো একটি বউ সে পেয়েছে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় একটি কান্ড হলো।রহস্য খাবার গরম করে এসেই বললো-
-আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।খাবার গরম করেছি।আপনি খেতে বসে পরুন।
সায়েম শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো-
-তুমি খাবে না?
-না।আমি ঘুমাবো।

রহস্য বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পরলো।সায়েম খাবার খেয়ে রুমে ফিরে এসে দেখলো রহস্য বিছানায় নেই।ওয়াশরুমের দরজা খোলা।রান্নাঘরটা ডাইনিং রুমের সাথে।রহস্য যদি রান্নাঘরে যেতো তাহলে ডাইনিং রুম দিয়েই যেতো।কিন্তু রহস্য সেখানেও যায় নি।তাহলে গেলো কোথায়? সায়েম খুঁজতে লাগলো রহস্যকে।ঘুমিয়ে পরা মেয়েটি হুট করেই গায়েব হয়ে যাবে!সায়েম হঠাৎ খেয়াল করলো পাশের রুমে খট খট আওয়াজ হচ্ছে।ইঁদুর রাতে যেইভাবে খট খট আওয়াজ করে আওয়াজটা ঠিক তেমনি।সায়েম সেখানে গিয়ে দেখলো রহস্য সেই রুমের আসবাবপত্র মুছছে।সায়েম কিছুটা অবাক হয়ে বললো-

-তুমি তো ঘুমাচ্ছিলে?ঘুম থেকে উঠে পরলে কেন?
রহস্য শান্ত গলায় বললো-
-ঘুমাই নি।শুধু চোখ বন্ধ করে রেখেছিলাম ।শোয়ার পর আর ঘুম আসে নি।
-রাত করে এসব মোছামুছির কাজ করছো কেন?তাছাড়া এই রুমে তো কেউ থাকছে না।আজ ঝাড়লে দুই দিন পর দেখা যাবে আবারও ময়লা জমে গেছে।
রহস্য নিচু স্বরে বললো-
-ঘরটা ঝাড়ু দিলেই কাজ শেষ হয়ে যাবে।
-আর ঝাড়ু টারু দেয়া লাগবে না।আমার সাথে এসো।তোমার ঘুম না আসলে আমরা বসে বসে গল্প করবো।তুমি এক্ষুনি কাজ বন্ধ করবে।এইটা আমার আদেশ।
রহস্য উঠে পরলো।সায়েম শোয়ার রুমে গিয়ে বসলো।রহস্যও বসলো পাশে।সায়েম বললো-
-খেয়ে নাও।
-আমার খিদে নেই।
-সারাদিন কাজ করেও তোমার খিদে পায় না কেন?খাবার রুচি কমে যাওয়া ভালো লক্ষণ না।খাবারের বেলায় ওসব অনিয়ম করবে না।
-জি আচ্ছা।

বিছানায় শুয়ে আর গল্পটল্প করাও হলো না।সায়েম অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেলো।রহস্য ঘুমাতে পারলো না।উঠে বসে পরলো।তার ঘুম আসছে না।তার প্রচণ্ড গরম লাগছে।গা থেকে কম্বল সরিয়ে শাড়ি খুলে ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।এইরকম অস্বস্তি নিয়েই আবার শুয়ে পরলো।চোখ দুটোও ঘুমে লেগে আসলো। ঠিক রাত আড়াইটার দিকে রহস্য সায়েমকে ডাকতে লাগলো-
-এই...ওঠো...
সায়েম ঘুমন্ত স্বরে বললো-
-কি হয়েছে?
-ইশ..ওঠো তো।

সায়েম উঠলো।কিন্তু অবাক করার মতো ব্যাপারটা ঘটলো রহস্যকে দেখে।রহস্য খুব সুন্দর করে সেজেছে।সাদা রঙের ব্লাউজের সাথে নীল শাড়ি।সেই কালো রঙের ব্লাউজটা আর দেখা যাচ্ছে না।আরও পরেছে নীল টিপ,হাতে চুড়ি।মেয়েটির চোখেমুখে সেই অসহায় অসহায় ভাবটা এখন আর নেই।তবে এতো রাতে এইভাবে সেজে থাকার কারনটা কি!রহস্য বললো-
-দেখো তো আমাকে কেমন লাগছে?
'আপনি আপনি' করে কথা বলাও এখন 'তুমি'তে পরিণত হলো।রহস্যকে দেখে খুব অবাক লাগছে।সায়েমের মনে হলো এইটাই কি সেই মেয়ে যেই মেয়েটির সাথে সে এতোদিন সংসার করে এসেছে। সায়েম বললো-
-খুব সুন্দর লাগছে।
-আমারও মনে হচ্ছে আমাকে খুব সুন্দর লাগছে।এই দেখো,তোমার কথা মতো সাদা আর নীল রঙে সেজেছি।কালো ব্লাউজটা পালটে সাদা ব্লাউজ পরেছি।
-কিন্তু এতো রাতে এসব সাজগোজের কারনটা কি?
-তুমি কি বিরক্ত হচ্ছ?আসলে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো।আর ঘুম আসছিলো না।তাই ভাবলাম সেজেগুজে তোমাকে সজাগ করে তুলে অবাক করে দেই।
-এসো এখন ঘুমাবে।অনেক রাত।সকালে এইরকমভাবে সাজলে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতাম।
রহস্য গলার স্বর পালটে বললো-
-তুমি ঘুমাও।আমার যখন ঘুম আসবে আমি তখনি ঘুমাবো।

এই বলে রহস্য উঠে পরলো।যেই রুমটায় মুছামুছি করে পরিষ্কার করেছিলো ওই রুমে ঢুকে খট করে দরজা বন্ধ করে দিলো।সায়েমের মনে হতে লাগলো সে 'রহস্য' নামের যেই মেয়েটিকে বিয়ে করেছিলো এতোক্ষণ সে তার সাথে কথা বলে নি,বলেছে অন্য একটি মেয়ের সাথে।এই মেয়ে যেখানে স্বামীর হুকুম মাথা পেতে নেয় সেখানে এই মেয়ের এইরকম আচরণ অবাক করে দিচ্ছে।রহস্য কখনো চোখে চোখ রেখে কথা বলে নি।আজ ওর চোখ দেখে মনে হলো সবরকম ভয় ওর চোখ থেকে দৌড়ে পালিয়েছে। রহস্যকে ওই রুমের দরজা খুলতে আর দেখা গেলো না।সায়েম একাই বিছানায় শুয়ে রইলো।ঘুমও এসে গেছে চোখে। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে সায়েমের ঘুম ভাঙলো।রহস্য আশেপাশে নেই।নিশ্চয়ই রান্নার কাজে লেগে গেছে।কিছুক্ষণ পরই হাতে চা নিয়ে রহস্যকে আসতে দেখা গেলো।রহস্য নিচে তাকিয়ে চায়ের কাপটা সায়েমের দিকে এগিয়ে দিলো।কাল রাতের সেই ভাবটা এখন আর রহস্যর চোখেমুখে দেখা যাচ্ছে না।পরনের সাদা ব্লাউজটা এখন আবার কালো দেখা যাচ্ছে।কাল রাতের রহস্য আর এই রহস্যর মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট। সায়েম বললো-
-আমার পাশে বসো রহস্য।
রহস্য সায়েমের পাশে বসলো।মেয়েটির হাত দুটো কাঁপছে।সায়েম বললো-
-রাতে খুব সুন্দর করে সেজেছিলে।রাত করে ঘুম ভেঙে গেলে কি তুমি এইভাবেই সাজগোজ করতে পছন্দ করো রহস্য?
রহস্য কথা বললো না।এমন ভাব যেন সায়েমের কোনো কথার অর্থই সে বুঝছে না।সায়েম হো হো করে হেসে বললো-
-এখন এতো লজ্জা পাচ্ছ কেন?তবে তোমার এই লজ্জা লজ্জা ভাবটাই আমার খুব পছন্দের।
সায়েম চায়ে চুমুক দিয়ে গেলো।রহস্য মাথা নিচু করে পাশে বসে আছে।দেখে মনে হচ্ছে সে খুব লজ্জা পাচ্ছে।শাড়ির আচল মাথায় টেনে লজ্জা ঢাকতে চেষ্টা করছে।

তবে আজ রাতেও একইরকম ঘটলো।রহস্যর রাতের রুপ একরকম আর দিনে রুপ আরেকরকম।রাতের রুপ চাঞ্চল্য ধরনের আর সকালের রুপ লজ্জাবতী এক গৃহবধূর।রহস্য মেয়েটির এই দুটি রুপের সাথে বসবাস করতে সায়েমের ভালোই লাগছে।মানুষ একটি বিয়ে করলে একটি বউ পায়।আর সে একটি বিয়ে করে দুটি বউ পেয়েছে। একের ভিতর দুই।মেয়েটির মধ্যে এই অদ্ভুত দুইয়ের ব্যাপারটা কি ওর মা-বাবা জানতো!হয়তো জানেন।আর এর জন্যই মেয়ের নাম রেখেছেন রহস্য।নয়তো এই সুন্দরী মেয়েটির জন্য এইরকম একটা অদ্ভুত টাইপ নাম রাখতেন না কখনো।নিজে নিজেই যুক্তি সাজাতে পেরে সায়েমের ভালো লাগছে।একই চেহারার দুই বউয়ের সংসার চালানো স্বামী সে।মাঝেমাঝে তার আনন্দ হয় এই ভেবে যে সে এক বিয়ে করেই আরেক বউ বোনাস পেয়েছে।যাক-গে।তবে এই দুই রুপের দুইটা নাম দেয়া দরকার।সকালে যে শান্তশিষ্ট রুপ ধারণ করে তার নাম রাখা হবে দিবা।আর রাতে সে যেই রুপ ধারণ করে তার নাম রাখা হবে রাত্রি। সায়েম রহস্যকে ডেকে শান্ত গলায় বললো-

-শোনো বউ,তোমার দুইটা নাম আমি ঠিক করেছি।সকালে আমি তোমাকে দিবা নামে ডাকবো আর রাতে ডাকবো রাত্রি।রহস্য নামটা বদলে এই দুইটা নাম রাখলাম তোমার।সকাল রাত দুই বেলায় দুই নামে ডাকা হবে তোমাকে।বুঝেছো? রহস্যর ঠোট কাঁপছে।চোখ দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি কেঁদে দিবে!ওকে তো ভয়ংকর কোনো কথা শোনানো হয় নি।ওকে কাঁদোকাঁদো অবস্থায় দেখে সায়েম বললো-
-কি হলো তোমার?
দিবা মৃদু স্বরে বললো-
-কিছু না।
-তোমার শরীর ভালো তো?
-জি ভালো।
সায়েম বসে খবরের কাগজের দিকে চোখ তুলে পড়তে লাগলো।দিবা চলে যাওয়ার মতো করেও গেলো না।সে সায়েমের পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো।কিছু একটা বলবে বলবে ভাব কিন্তু বলছে না।হয়তো ভয় পাচ্ছে।সায়েম বললো-
-কিছু বলবে দিবা?
-জি না।দিবাকে নিয়ে চিন্তায় পরতে হলো।ইদানিং দিবা এইরকম করে।কিছু বলতে গিয়েও বলে না।কিন্তু রাত্রিটা ঠিক এইরকম না।যা মুখে আসে বলে দেয়।মাঝরাতে সেজেগুজে বসে থাকে।আর সায়েমের কাচা ঘুম ভাঙিয়ে জানতে চায় তাকে তার নতুন সাজে কেমন লাগছে।গতরাতে রাত্রি খুব জালিয়েছে।রাতের খাবার খাওয়া শেষ হতেই বলে ছাদে যাবে।অন্ধকার ছাদে হাত ধরে হাটবে,চাঁদ দেখবে।শীতের রাতে লেপ কম্বল দিয়ে ঘুমানোর মতো আরামের কিছু দ্বিতীয়টা আছে নাকি!শীতের দিনে ছাদে উঠে চাঁদ দেখার মানেই হচ্ছে ঠান্ডায় জমে কাঠ হওয়ার অন্যতম পদ্ধতি।রাত্রিকে অনেক বলেও কাল বোঝানো যায় নি।রাত করে চাদরে গা ঢেকে কাঁপতে কাঁপতে ওকে নিয়ে ছাদে গিয়ে চাঁদ দেখতে হয়েছে।সায়েমের ঝিমুনি ভাব হচ্ছে।খবরের কাগজটা পাশে রেখে বিছানায় শুয়ে পরলো সে।তবে ঘুম বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না।পনের মিনিটের মাথায় হুট করেই জেগে উঠলো।দিবা এসে পাশে দাঁড়িয়ে বললো-

-বাজারে যেতে পারবেন?
-কিছু লাগবে?
-জি।সামান্য আটার প্রয়োজন ছিলো।
-তোমাকে একটা অলিখিত রুলস জানিয়ে রাখি।এইভাবে একেক সময় একেক জিনিস আনতে বলা যাবে না আমাকে।এখন থেকে এক মাসের বাজারের লিস্ট একেবারে করে রাখবে।প্রতি মাসের প্রথম শনিবার সেই লিস্ট অনুযায়ী আমি এক মাসের বাজার করে রাখবো।
-জি আচ্ছা।
সায়েমকে বাজারে যেতে হলো।মানুষটাকে অসময়ে বাজারে পাঠিয়ে দিবার কাছে খুব খারাপ লাগছে।দিবার চোখে সামান্য পানিও এসে গেলো।দিবার মনে হচ্ছে সে এই মানুষটাকে ঠকিয়েছে।তার অসুস্থতার ব্যাপাটা না জানিয়ে লোকটাকে বিয়ে করেছে।লোকটাকে যদি বিয়ের আগেই সব কথা জানানো হতো তাহলে নিজেকে এতোটা অপরাধী মনে হতো না।
দিবা একটি কাগজ নিয়ে বসলো।মুখে যেই কথা বলতে পারছে না কাগজে সেই কথা লিখে বলবে।দিবা লিখলো-

সায়েম সাহেব,
আপনাকে খুব ভালোবাসি।আপনি চিঠিটা পড়ে আমাকে ভুল বুঝবেন না।চিঠিটা লেখার উদ্দেশ্যই হচ্ছে আমি যেই কথাগুলো আপনাকে গুছিয়ে মুখে বলতে পারছি না সেই কথাগুলো তাই আমি গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করছি।প্রথমে আমি আমার নামের অভিধান দিয়ে শুরু করছি।আমার নাম 'রহস্য' রাখার কারন আপনি প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করতেন।ছোট বেলায় বাবা আমার নাম 'রহস্য' রেখেছিলেন।'রহস্য' খুব অদ্ভুত একটা নাম।এই অদ্ভুত নামটা রাখার কারনটা আমি আপনাকে বলছি।ছোটকালে আমি রোগাটে টাইপের একটা মেয়ে ছিলাম।আমার মধ্যে অসুখবিসুখ লেগেই থাকতো।একদিন মা আমাকে নিয়ে আমার খালার বাসায় বেড়াতে গেলেন।খালার বাড়িটা এমন একটা জায়গায় যেখানে রাতের বেলায় একা চলতে গেলেও খারাপ লাগে।এক কথায় পরিবেশটা কিছুটা নীরব নিস্তব্ধ।আশেপাশে বাড়িঘরও নেই।গাছগাছালির মাঝে বিশাল একটা বাড়ি।একদিন মাঝরাতের কথা।বাড়ির সবাই ঘুমাচ্ছে।আমার কাছে হঠাৎ মনে হলো কেউ একজন আমাকে বাহির থেকে 'সুরমা' 'সুরমা' বলে ডাকছে।আমার নাম তখন সুরমা ছিলো।সুরমা নামটা আমাকে আমার দাদী দিয়েছিলো।আমি ডাক শুনে মাকে ঘুম থেকে জাগানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু মা আমার কথা বুঝলেন না।ঘুমন্ত স্বরে ধমক দিলেন।আমি তখন নিজেই সাহস করে গেট খুলে বাহির পর্যন্ত বের হলাম।এরপর কি ঘটেছিলো আমার কিছুই মনে নেই।চোখ খুলে দেখি মা আমার কপালে পানির পট্টি দিচ্ছেন এবং আমি প্রচণ্ড জ্বরে কাঁপছিলাম।ঠিক ওই দিনের পর থেকেই রাতে আমি অনেকবার জেগে উঠি।তখন যা করি কিছুই সজ্ঞানে করি না। সকালে আমি একরকম থাকি,রাতে হই আরেকরকম।এই দুই প্রকৃতি আমার মাঝে চেপে বসে আছে।মা-বাবা দুইজনেই ব্যাপারটা নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন।অনেক কবিরাজি করিয়েছেন কিন্তু লাভ হয় নি।কবিরাজি করানোর পর দেখা গিয়েছে সপ্তাহ খানেকের মতো আমি ভালো থাকি কিন্তু পরে আবার আগের মতো হয়ে যাই।এরপর থেকেই বাবা আমাকে 'রহস্য' নামে ডাকতেন।আমার এই অসুস্থতা আপনাকে লুকানোটা ঠিক হয় নি।বিয়ের আগেই সবকিছু জানানো উচিত ছিলো।আমি ভেবেছিলাম বিষয়টা আপনার কাছ থেকে লুকিয়ে সংসার করবো।কিন্তু আপনি তো আমার স্বামী।তাই লুকিয়ে রেখেও পারা যায় নি।আপনি যখন আমার সকালের রুপের নাম রাখলেন 'দিবা' আর রাতের রুপের নাম রাখলেন 'রাত্রি' তখনি আমি বুঝেছি আপনি এখন সব টের পেতে শুরু করেছেন।আপনি বিষয়টা নিয়ে কতোটুকু চিন্তিত আমি জানি না।তবে আমি সুস্থ হতে চাই।আপনার সাথে একজন সুস্থ মানুষের মতো জীবন কাটাতে চাই।একজন অসুস্থ মানুষকে নিয়ে অস্বাভাবিক সংসার বেশীদিন টিকতে পারে না।আমি আপনাকে ছেড়ে যেতে চাই না।আমার সমস্যাগুলো বুঝতে চেষ্টা করুন।ভুল বুঝে আমাকে তাড়িয়ে দিলে আমি মরে যাবো।আপনার পাশে থেকেই আপনার সেবা করে আমি আমার দুই রুপেই স্ত্রী ধর্ম পালন করে যেতে চাই।

ইতি
রহস্য (দিবা)

সায়েম পলিথিন ভর্তি আটা নিয়ে এলো।দিবা তাকে দেখেই চমকে দাঁড়িয়ে গেলো।সায়েম দিবাকে পলিথিন এগিয়ে দিয়ে বললো-
-কি করছিলে?
দিবা কাগজটা মুচড়ে আচল দিয়ে ঢেকে লুকানোর চেষ্টা করে বললো-
-না তো।কিছু না।
এই এক আজব মেয়ে।তখন দেখা যাচ্ছিলো কি যেন মনোযোগ দিয়ে করছে আর এখন চোখে ভয় নিয়ে বলছে 'কিছু না'।দিবা কাগজটি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করলো।চিঠিটা পড়ে যদি সায়েম রেগে যায় বা ঘর থেকে তাড়িয়ে দিলে সেই লজ্জা রাখবে কোথায়!চিন্তাটা হঠাৎ করে মাথায় বসে পরলো।এখন আর সাহস হচ্ছে না এই চিঠিটা দিতে। রাত হলো।রহস্যর মধ্যে রাত্রি আবার আসলো।রাত্রি কালো রঙের পাতলা সিল্কের শাড়ি পরেছে।চোখে মোটা করে কাজল দেয়াতে খুব সুন্দর দেখা যাচ্ছে।সায়েম বিছানায় পা তুলে ম্যাগাজিন পড়ছে।ম্যাগাজিনের এক পাশে ছোট করে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের টেলিফোন নাম্বারসহ যোগাযোগের ঠিকানা দেয়া আছে।বার বার সেই জায়গাটায় চোখ যাচ্ছে।রাত্রি আজ সেজেগুজে বসে আছে ঠিকই কিন্তু কথা বলছে না।সায়েম সাইকিয়াট্রিস্টের ঠিকানার পাতাটি ভাজ করে রেখে রাত্রিকে বললো-

-আজ জানতে চাইলে না তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে?
রাত্রি বললো-
-তুমি প্রতিবারের মতোই বলবে আমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে তাই আজ আর জানতে চাইলাম না।
-ভুল করলে।আজ জানতে চাইলে একটা ব্যাতিক্রম উত্তর পেতে।
-উত্তরটা কেমন হতো?
-তোমাকে বলতাম দিবার মতো করে সাজতে।এই সাজে তোমাকে মানায় নি।
রাত্রির চোখ ছলছল করতে লাগলো।সে রাগ করে উঠে পাশের রুমে ঢুকে খট করে দরজা বন্ধ করে দিলো।সায়েমের মনে হলো রহস্য নামটি পালটে ঠিকই করেছে সে।দিবা আর রাত্রি এরা যখন একটি সুস্থ স্বাভাবিকভাবে এক রুপে ফিরে আসতে পারবে তখন এই দুই নাম মিলিয়ে দিবাত্রি নামে ডাকা যাবে যার সন্ধিবিচ্ছেদ করলে হবে দিবা+রাত্রি।
পাশের রুমের দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া গেলো।রাত্রি অভিমান ভেঙে বললো-
-এই রুমে আসো তো।একা একা শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না।ঘুম আসছে না আমার। জলদি এসো।
সায়েম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-
-আসছি।

Leave a Comment