এক স্বার্থপর মেয়ের আত্মকথা ( দ্বিতীয় পর্ব )

  • রীপা চক্রবর্তী  
  • মার্চ ৪, ২০১৮

"আমার জন্ম হলো....হৃদির কথা " হৃদি ঘরে ফিরছে, ৫ বছরের প্রবাসজীবন কাটিয়ে। এই ৫ বছরে অর্জিত অভিজ্ঞতা,স্বাধীনতা,সম্মান ও শিক্ষা ছিল অমূল্য।  হৃদি ভাগ্যবতী। অরুনাভের জন্যেই আজ এতকিছু সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সেই অরুনাভকে ফেলে আর ৬মাসের রিদিতকে নিয়ে আজ আবার হৃদি অতীতের  গর্ভে প্রবেশ করতে যাচ্ছে কিন্তু কেন???হিথ্রো এয়ারপোর্টে ঘুমন্ত রিদিতকে নিয়ে বসে আছে হৃদি। কেবলি সমস্ত ইমিগ্রেশন কার্যাবলি শেষ হল।  বার বার মনে চাইছিল ফিরে যেতে,অরুনাভের কাছে,ছোট্ট ঘরটায়, তিনজনে মিলে জরিয়ে ধরে ঘুমোতে,এক থালায় ভাত মেখে খেতে,একসাথে খুনশুটি করে রান্না করতে,ঘুরতে বেরোতে... অরুনাভ কি করছে এখন?এখনো কি জয়ের সাথেই আছে?ওর কি মনে পরছে আমার কথা,রিদিতের কথা?আজ নিশ্চয়ই ও বাড়ি ফিরবে না। আর জয় এই সুযোগটাই নেবে.... হাজারো চিন্তায় ঝাপসা হয়ে আসছে চারপাশ। 

"মা-টা আমার খুব অসুস্থ। যত কিছুই অন্যায় করুক,এই বিপদে তার পাশে থাকা উচিত আমার। ""কিন্তু তারা আজ অবধি অরুনাভকে মেনে নেয়নি। আমার এখন কারদিকে থাকা উচিত?" "আমি কখনই কোনকিছু তাদের কথামত করিনি। কারণ নাহলে আজ আর আমার কিছুই থাকতোনা । আমার সব স্বপ্ন,সাধনা তৃতীয় ব্যক্তিদের কুমন্ত্রনায় হারিয়ে যেত। "" তবে কেন পারছিনা এই বন্ধন ছিন্ন করতে?"......হাজারো রকমের প্রশ্নের মুখোমুখি দাড়িয়ে আজ হৃদি নামের মেয়েটি.... 'বউদি,ভাই এর কথা মনে পরছে?মন খারাপ করবেন না। মাত্র তো কয়টা দিন,আবার তো চলেই আসবেন। দেশের সবকাজ গুলো শেষ করে ফেলতে কয়জন পারে বলেন?' পাশের সিটের বউদির কথায় সামান্য হেসে হৃদি প্লেনের জানালার বাইরে তাকায়। শুধুই দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ..কোলে ঘুমন্ত রিদিতের মুখটা কত শান্ত,মায়াভরা লাগছে। ও কি বুঝতে পারছে আবার কবে বাবাকে দেখবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই! 'যে পরিবার,বাবা-মা কে ছেড়ে আর কখনো দেশে আসবনা পণ করেছিলাম,আজ সেই প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেলতে বাধ্য হলাম আমার থেকেও না থাকা মায়ের জন্যে। জানিনা কি অপেক্ষা করছে আমার জন্যে'। যে কালো অধ্যায় কে মুছে দিয়ে নিজেকে সকল পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করে নেয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল মেয়েটি, মুক্ত ডানায় উড়ে বেড়ানোর তীব্র ইচ্ছা ছিল যার,আত্মপ্রত্যয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ থেকে স্বকীয় পরিচয় বানাতে গিয়ে যাকে সর্বহারা হতে হয়েছিল, সেই মেয়েটি কেন আবার অতীতে পদার্পণ করছে?

পরিবারের প্রতি ভালোবাসা কি তৈরি করছে হৃদি আর অরুনাভের মাঝে এক অদৃশ্য দূরত্ত্বের দেয়াল?কে এই জয়?কেন অরুনাভ এই যাত্রায় হয়নি জীবনসাথীর সঙ্গী ? "আমার জন্ম হলো.....হৃদির কথা", হৃদি ওর ডায়েরীটা বের করে লিখতে শুরু করলো। প্রিয়তমেষু রিদিত,আজ তুমি তোমার মায়ের সাথে তার পিতৃকূল-মাতৃকূল দর্শন করতে যাচ্ছো । যাচ্ছো তোমার বংশধারার উৎপত্তি উদভাবনে। অবাক হলে বাবা?আমাদের কাছে কখনোই এমন কিছু জানতে পারনি। শোনোনি কখনো ইউকে এর বাইরে তোমার কেউ আছে। হঠাৎ আজ ঝড়ো বাতাসের ন্যায় তোমার অজ্ঞাতে এমন টা?বাবা,আমার কিছু ঋণ আছে,যা আমাকে পরিশোধ করতে হবে। তুমি জানো তোমার মা স্বাবলম্বী। কখনো তোমার বাবাকেও কোন কিছুতে ভারগ্রস্থ করেনা। মিলে মিশে চলার একটি আদর্শ উদাহরণ আমাদের তিনজনের পরিবার,যা তোমার মায়ের আজন্ম লালিত স্বপ্নও। বাবা রে,আমি তোমায় সেই সবকিছু দিতে চাই যা আমি সবথেকেও পাইনি। সঠিক শিক্ষা,মূল্যবোধ,বিবেকবোধ,সুরক্ষা আর সারাজীবনের জন্যে অর্থের সিকিউরিটি। এমনকি কোন দায়িত্ব অর্পণ করবোনা আমি তোমায়। তোমার বাবা আর তুমিই যে আমার সব! আজ আমার অনেক হ্যালুসিনেসন হচ্ছে বাবা!আমি কি মৃত্যুর খুব সন্নিকটে বাবা?আমার সমস্ত কষ্টের দিনগুলো একের পর এক ভেসে উঠছে চোখের সামনে! যদি এমন হয়,আবার আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে ওরা?যদি আলাদা করে দিতে চায় তোমার বাবা আর আমাকে?যদি তোমাকে আমার মতো কষ্ট দেয়?

জানো ওরা কারা?ওরা আমারি বাবা-মা,ভাই-বোন,মামা-মামী,দাদা-বউদি,আত্মীয়-স্বজন! সত্যি বলছি বাবা,আমার একটি কথাও মিথ্যে নয়। আমিই সেই হতভাগী যার নিজের রক্তই বেঈমান। যার অস্তিত্ব-ই সংকটে। এজন্যেই আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি আজো...... আমার ঘরের লোক আমার শত্রু,আমার জীবনকাহিনী দিয়ে সিনেমা,গল্প,উপন্যাস সব লেখা যাবে,তবুও শেষ হবেনা বাবা রে। আজ আমি তোমায় সব বলছি বাবা। এরপর যদি আমার কিছু হয়ে যায়,তোমার বাবা যদি আমায় ভুল বুঝে,তবুও তুমি আমাকে ভালোবেস বাবা প্লিজ। কারণ এত বড় পৃথিবীতে আমার পরে তুমিই এই অন্ধকার,কদর্য আর ষড়যন্ত্রের খেলার সব জানবে। তোমার জানা খুব-ই দরকার বাবা। নাহলে ভুলে-ভুলে তুমিও একদিন জড়িয়ে যাবে এই জালে,আর এই ফাঁদ তোমায় ও যে শেষ করে দেবে বাবা!কেন হৃদির এই করুণ আর্তি???কেন এত দ্বিধা??এই আর্তি কি সবমেয়ের-ই নয়??এই সমাজে মেয়ে হয়ে বেঁচে থাকার জন্যে যে কি যুদ্ব করতে হয়,তা জানে সবাই?? আসলেই কি হৃদি স্বার্থপর??নাকি পরিস্থিতির স্বীকার??

Leave a Comment